Dhaka ১১:৩৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অ্যড.লিয়াকত আলী বাবুর গল্প : ‘নিশি রাতে-ভুতের সাথে’

সংবাদদাতা-
  • প্রকাশের সময় : ০১:০৬:০৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৭ নভেম্বর ২০১৯
  • / ১৮১৯ জন সংবাদটি পড়েছেন

 

হঠাৎ পা’ পিছলে পড়তে পড়তে দাঁড়িয়ে যায় আকবর আলী। ভয়ানক পিচ্ছিল রাস্তা। গুুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। বাতাসের বেগটাও ক্রমশ্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভীষন অন্ধকার রাত। টর্চ লাইটের চার্জও শেষ হয়ে যাওয়ার জন্য লাল সিগন্যাল দিচ্ছে। আকাশে বিদুৎ চমকানোর আলোতে কোন মতে পথ চলছে আকবর আলী। এই আষাঢ় শ্রাবন মাসে আসলে বাড়ীর বাইরেই আসা উচিৎ না। এই তাস খেলাট’ই যেন জীবনের কাল হয়ে দাঁড়াচ্ছে আকবরের। আকবর আলী একটু দ্রুত পা’ চালায় বাড়ীর পথে। কাঁচা এটেল মাটির রাস্তা। একটু ভিজলেই পিচ্ছিল হয়ে যায়। ঘড়িটা অনেক আগেই রাত দু’টোর কাঁটা পার করে ফেলেছে। একেই বলে ভয়ানক দুর্যোগপূর্ন ঘোর নিশি রাত। এবার পথের বাঁকটা কিছুটা বাম দিকে মোড় নিয়ে কাঁশিনাথ পুরের পাল পাড়ার বাঁশ ঝাড়ের মধ্যে ঢুকে গেছে। এখন আর বিদুৎ চমকানোর আলোটা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। কিছুটা অনুমানে পথ চলতে হচ্ছে। সরাৎ সরাৎ শব্দে দু’একটা খেক শিয়াল রাস্তার এপার ওপার করছে। এই রাস্তাটায় সন্ধ্যার পর থেকেই লোক চলাচল কমে আসে। আর রাত নয়টা দশটার পরে আকবর আলীর মত মহা বিপদে কেউ না পরলে এ পথে কেইই পা বাড়ায় না। এ রাস্তাটায় নাকি বেশ বড় ধরনের দোষের ভাব আছে। ভয়ানক দোষের ভাব। অনেকেই বলে এটা নাকি ভুত-প্রেত চলা চলের প্রধান পথ। ঘোর অমাবশ্যায় এ এলাকার সব ভুত-প্রেত এ পথ দিয়েই নাকি চলাচল করে থাকে। আবার অনেকে বলে এই কাঁশিনাথপুর পাল পাড়ার বাম পাশের মোড়ের জটানো শ্যওরা গাছটায় ভুত-প্রেতের একটা স্থায়ী আস্তানাও নাকি আছে। পথের উত্তর পাশ সংলগ্ন ঠিক কালীবাড়ী সোজা চন্দনা নদীর পাড়েই আবার শশ্মান ঘাট। শশ্মান ঘাটের ভয়টাতো একেবারে চিরন্তন সত্য। যদিও ভুত প্রেতের সব কথাই শোনা গল্প। তার পরেও এলাকার সবার মুখে মুখে এমন সব ভুতের গল্প গুলো খুব ভারী ভাবেই প্রচলিত আছে। ভুত প্রেত বলে একটা কিছু আছে এ কথাটা আকবর আলী বিশ্বাস না করলেও রাত বিরাতে পথ চলতে কিছুটা ভয় পায় সে। গভীর রাতে হঠাৎ কোন শব্দ শুনলে তাঁর গা’ ছম ছম করে উঠে। শরীরের লোম গুলো সজারুর কাঁটার মত দাঁড়িয়ে যায়। তাঁর ভাষায় কোন এক অজানা আশঙ্খায় এটা হয়তো হয়। যেমন চাঁদে মানুষ গেছে এ কথাটা কিছু কাঠ মোল্লা কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায় না। কিন্তু চাঁদ থেকে ফিরে এসে নীল আর্মষ্ট্রং মুসলমান হয়ে গেছে এ কথাটা খুব আস্থার সাথে জোর গলায় প্রকাশ করে বেড়ায়। ভুতের বিষয়টাও ঠিক তেমনই। ভুত বলে কিছু নাই এটা জোর গলায় প্রকাশ করলেও ভয় আছে এমন পথে ঐ সাহসী লোক গুলোও সাধারনতঃ চলাচল করতে চায় না। আর কবি গুরু রবীন্দ্র নাথের ভাষায় বৈদ্যুতিক আলোতে বসে ভুতকে আস্বীকার করাটা যতটা সহজ ,গভীর অন্ধকার রাতে জনমানবহীন কোন ভুতুরে জঙ্গলে গিয়ে ভুতকে অস্বীকার করা ততটা সহজ কাজ নয়। ওঁয়াও ওঁয়াও-ওঁয়াও ওঁয়াও !!। ছোট বাচ্চার কান্নার শব্দ ভেসে আসছে মনে হয়। আশে পাশেতো কোন বাড়ী ঘরই নাই। ছোট বাচ্চার কান্নার আওয়াজ আসবে কি ভাবে ? নাকি শিয়াল কুকুরে কোন বাচ্চা টাচ্ছা নিয়ে এসেছে বাঁেশর ঝাড়ে ? আকবর আলী দাঁড়িয়ে পরে। দাঁড়িয়ে পরার সাথে সাথেই হঠাৎ চার পাঁচটা বাঁশ কড় কড় শব্দে প্যাচ খেতে খেতে আকবর আলীর সামনে রাস্তার উপর শুয়ে পরেই আবার কড় কড় শব্দে উপরের দিকে উঠে যেতে থাকে। হাতে থাকা প্রায় চার্জহীন টর্চ লাইটের হাল্কা আঁধারী আলোতে বাঁশ মোড়ানোর ঘটনা দেখে আকবর আলীর কলিজার মধ্যে ছ্যানাৎ করে চিলিক দিয়ে উঠে। মুুহুর্তের মধ্যে শরীরের সব গুলো লোম সজারুর কাঁটার মত দাঁড়িয়ে যায়। আবারও ওঁয়াও ওঁয়াও শব্দে বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ওদিকে বহু দুর থেকে কুকুরের ভয়ার্ত আর্তনাদ ভেসে আসছে। বাঁশ ঝাড়ের কড় কড়ানি শব্দটাও যেন ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। আকবর আলী ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কারন বাঁশের ঝাড়ের মধ্য দিয়ে চলার পথটা বেশ লম্বা। আধা কিলোমিটারেরও বেশী হবে। প্রায় মাঝামাঝি পথে এসে ফিরে যাওয়াটাও আবার বোকামী হতে পারে। হঠাৎ আগর বাতি জ্বালানোর গাঢ় ঘ্রান ভেসে আসতে থাকে। আগর বাতির ঘ্রানের মধ্যে সব সময়ই এক ধরনের লাশের ঘ্রান মেশানো থাকে। আগর বাতির ঘ্রান ভালো না। বড় অমঙ্গলের লক্ষন এটা। এখন আকবর আলী বাঁশ ঝাড়ের রাস্তার ঠিক মাঝখানটায় ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। সামনে আগানোর শক্তি নাই পায়ে। শরীরটা পাথরের মত ভারী বলে মনে হচ্ছে। গাঢ় আতরের ঘ্রানও পাওয়া যাচ্ছে। নাহ্ এবার আর অশরীরি বিষয়কে একেবারে অবজ্ঞা করা যাচ্ছে না। দেও দানব বা ভুত প্রেত বলে কিছু একটা আছেই। আগরবাতি আর আতরের ঘ্রান ভালো লক্ষন না। এ গুলোর ঘ্রান মানেই লাশের অস্তিত্ব। এবার একেবারে তিন সত্য তওবা। রাতের বেলা আর কোনদিনও এ রাস্তায় আর পা রাখাবো না। হঠাৎ বাঁশ ঝাড়ের উপর থেকে কি যেন সরাৎ সরাৎ শব্দে নিচে নেমে আসছে। না আর কিছুতেই দেরী করা যায় না। পেছন দিকে দৌড় দেওয়াই উত্তম। শালার তাস খেলার খেঁতা পুড়ি। চির জীবনের মত তাস খেলা বন্ধ। ভয়ে আবার কিছুতেই চিৎকার দেওয়া যাবে না। ভুতের ভয় পেয়ে যারা যারা চিৎকার দেয় তারাই নাকি জ্বরে আক্রান্ত হয়ে সাত দিনের মধ্যে মারা যায়। কিন্তু দৌড় দেওয়ার সময় পেছন থেকে যদি কেউ জাপটে ধরে ? বাতাসের গতিটাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাথে বৃষ্টির গুঁড়ি। বাঁশের পাতা ঝড়া বৃষ্টির পানি পরে আকবর আলী প্রায় আধা ভেজা হয়ে গেছে। না আর সামনে আগানো যাবে না। মনোবল বৃদ্ধি করতে হবে। দোয়া দরুদ যা মুখস্থ ছিল সবই পড়তে শুরু করে দিল। কিন্তু অজু না থাকাতে দোয়া দরুদ কাজে লাগবে বলে মনে হচ্ছে না। আর তাস খেলা হারাম জেনেও তাস খেলে এসে রাস্তায় ভয় পেয়ে দোয়া দরুদ পড়লে তা কাজে লাগবে কেন ? বরঞ্চ বিনা অজুতে দোয়া দরুদ পড়াও পাপের কাজ। কি যে ভয়ানক অবস্থা। সবই যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। কি যে ভালো আর কি যে মন্দ কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না আকবর আলী। ঐ যে আবার আগর বাতি আর আতরের ঘ্রান গভীর ভাবে ভেসে আসছে। সাথে লাশের গন্ধ। শ্যাওরা গাছের পেছনের খালের পাড়ে কান্নার আওয়াজ। আকবর আলীর সমস্ত শরীর হীম হয়ে আসতে থাকে। জীবন মৃত্যুর শেষ সন্ধিক্ষন। শেষ বারের মত আধো আলোর টর্চ লাইটটা জ¦ালাতেই চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। শ্যাওরা গাছটার নিচেয় একটা লাশ কাফনের সাদা কাপড় দিয়ে খাটিয়ার উপর রাখা। আকবর আলী আরেকবার লাশটার দিকে লাইট মেরে লাশের বিষয়টা নিশ্চিত হয়ে যায়। তার পরেই চন্দনা নদীর দিকে ভৌঁ দৌড়। তারপর যা ঘটলো তার সবটুকু মনে নেই আকবর আলীর। চন্দনা নদীর পাড় ধরে দৌড় দিতেই দেখে শশ্মান থেকে বিশাল মাথাধারী তিনজন লোক হেঁটে রাস্তার উপরের দিকে উঠে আসছে। প্রায় দশ ফুট ব্যাসের মাথা হবে ! তিনজনই দুই হাত দিয়ে ঐ বিশাল মাথা ধরে হাঁটছে। তারপর আর কিছু মনে নেই। ধবাস করে রাস্তার উপর পরে যায় আকবর আলী। ধবাস করে পরেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। যখন জ্ঞান ফেরে তখন ভোরের আজান হচ্ছিল। জ্ঞান ফিরেই ‘আমি কোথায়’ ‘আমি কোথায়’ বলে চিৎকার করে উঠে। ঐ বিশাল মাথাওয়ালা লোক তিনজনই আকবর আলীকে উদ্ধার করে আকবরের বাড়ীতে নিয়ে আসে। ঐ তিনজন ছিল জেলে সম্প্রদায়ের লোক। তাঁরা রাতে চন্দনা নদী থেকে মাছ ধরে বড় সাইজের মাছের ডালি মাথায় করে নিয়ে রাস্তার দিকে উঠছিল। একটু দুর থেকে তাঁদেরকে দেখে মনে হচ্ছিল বিশাল বিশাল মাথাওয়ালা মানুষ। আকবর আলী যখন মাটিতে পরে গোংরাতে থাকে তখন ঐ তিনজন জেলে আকবরকে অজ্ঞান অবস্থায় উদ্ধার করে তাঁর বাড়ীতে নিয়ে যায়। সাত সকালেই আকবরের বাড়ী বিশাল জনসভায় পরিনত হয়। বাড়ীতে যেন তিল ধরানোর ঠাঁই নেই। ঘটনা শুনে চেয়ারম্যান সাহেবও চলে এসেছেন। চেয়ারম্যান সাহেব আবার সব ঘটনাতেই তদন্তে বিশ^াসী। শুরু হলো তদন্ত করার পালা। চেয়ারম্যান সাহেব ঘটনা নিজেই তদন্ত করার জন্য আকবর আলী ও স্থানীয় লোকজন নিয়ে ঘটনাস্থলের দিকে রওনা হলেন। ঘটনার একটা সুষ্ঠ তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। যাওয়া হলো কালী বাড়ীর পাশের সেই খাল পাড়ের শ্যাওরা গাছটার নিচে। যেখানে লাশ দেখা গিয়েছিল। হ্যাঁ সেখানে সত্যি লাশটার অস্তিত্ব পাওয়া গেল। সত্যিকার অর্থেই যেন সাদা কাফনে মোড়ানো একটা লাশ। পাঁচ সারে পাঁচ ফিট লম্বা একজন মানুষের সাইজের এক খন্ড কাঠের গুঁড়ি। তার উপরে সাদা রঙের ব্যাঙের ছাতায় এমন ভাবে আচ্ছাদিত হয়ে আছে যা রাতের আধো আলোতে একটা লাশের মতই মনে হবে। আর কালীবাড়ীর বারান্দায় একজন সাধু বাবাকে পাওয়া গেল যিনি তখনো ধুপ জ¦ালিয়ে ধ্যান মগ্ন ছিলেন। ঐ ধুপের ঘ্রানটাই আগর বাতির ঘ্রান বলে মনে হচ্ছিল। আরও জানা গেল যে ঐ বাঁশের ঝাড়ে বড় একটা হনুমান এসে আশ্রয় নিয়েছে। হনুমানটা মানুষের আওয়াজ পেলেই এক বাঁশ থেকে আরেক বাশের উপর লাফ দেওয়ার কারনে সর সর শব্দ হওয়া সহ কিছু বাঁশ নূয়ে পরে এবং আবার বাঁশ গুলো উপরে উঠে যায়। সব চাইতে অবাক কান্ড হলো ঐ বিশাল বাঁশের ঝেপের মাঝে খেক শেয়ালে বাচ্চা ফুটিয়েছে। রাতের বেলায় শেয়ালের বাচ্চার উঁ উঁ শব্দের কান্না মানুষের বাচ্চার কান্নার মতই মনে হয়। তদন্তে একে একে গত রাতের সকল আজগুবি ঘটনাই উদ্ঘাটিত হয়ে গেল। সর্বশেষ ভুত আছে কি নাই তদন্তে তা উদ্ধার করা না গেলেও গত রাতের ঘটনা গুলো যে ভুতের কান্ড ছিল না তা দিবালোকের মতই সবার কাছে পরিস্কার হয়ে গেল। গত রাতের ঘটনাগুলো ভুতের কান্ড না হলেও আকবর আলী সেই দিন থেকে তাস খেলা তো বাদ দিয়েইে দিলো এমন কি সন্ধ্যার আগেই সুবোধ বালকের মত বাড়ীতে এসে হাত মুখ ধুয়ে সোজা ঘরে গিয়ে বসে। কারন চেয়ারম্যান সাহেবত যত কথাই বলুক না কেন ঐ দিন বাঁশ ঝাড়েরর নিচে বৃষ্টির মধ্যে দু’পাশলা গরম বাতাস তার গা ছুয়ে গেছে। সাথে উটকো আঁসটে গন্ধ। এর উত্তর কি ? ঠান্ডা বাতাসের মধ্যে গরম বাতস এলা কোত্থেকে ? আকবর সেদিন রাতে আরো অনেক কিছুই বুঝে ফেলেছে। ঐ সব ধানাই পানাই কথার বুঝ দিয়ে অন্ততঃ আকবরকে আর বোঝানো যাবে না। ভুত প্রেত বলে কিছু নাই, তাই না ? তাসের পার্টনার’রা তাকে বাড়ী পর্যন্তু পৌঁছে দেওয়ার শত ভাগ নিশ্চয়তা দিলেও আকবর পার্টনারদের মুখের উপর সোজা ‘না’ শব্দটা ব্যাবহার করে দিয়েছে। ন্যাড়া আর কোন দিনও বেল তলায় যাবে না। সর্বশেষ আকবর আলী এখন আকবর মুসল্লি নামে পরিচিত।

Tag :

সংবাদটি আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন-

অ্যড.লিয়াকত আলী বাবুর গল্প : ‘নিশি রাতে-ভুতের সাথে’

প্রকাশের সময় : ০১:০৬:০৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৭ নভেম্বর ২০১৯

 

হঠাৎ পা’ পিছলে পড়তে পড়তে দাঁড়িয়ে যায় আকবর আলী। ভয়ানক পিচ্ছিল রাস্তা। গুুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। বাতাসের বেগটাও ক্রমশ্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভীষন অন্ধকার রাত। টর্চ লাইটের চার্জও শেষ হয়ে যাওয়ার জন্য লাল সিগন্যাল দিচ্ছে। আকাশে বিদুৎ চমকানোর আলোতে কোন মতে পথ চলছে আকবর আলী। এই আষাঢ় শ্রাবন মাসে আসলে বাড়ীর বাইরেই আসা উচিৎ না। এই তাস খেলাট’ই যেন জীবনের কাল হয়ে দাঁড়াচ্ছে আকবরের। আকবর আলী একটু দ্রুত পা’ চালায় বাড়ীর পথে। কাঁচা এটেল মাটির রাস্তা। একটু ভিজলেই পিচ্ছিল হয়ে যায়। ঘড়িটা অনেক আগেই রাত দু’টোর কাঁটা পার করে ফেলেছে। একেই বলে ভয়ানক দুর্যোগপূর্ন ঘোর নিশি রাত। এবার পথের বাঁকটা কিছুটা বাম দিকে মোড় নিয়ে কাঁশিনাথ পুরের পাল পাড়ার বাঁশ ঝাড়ের মধ্যে ঢুকে গেছে। এখন আর বিদুৎ চমকানোর আলোটা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। কিছুটা অনুমানে পথ চলতে হচ্ছে। সরাৎ সরাৎ শব্দে দু’একটা খেক শিয়াল রাস্তার এপার ওপার করছে। এই রাস্তাটায় সন্ধ্যার পর থেকেই লোক চলাচল কমে আসে। আর রাত নয়টা দশটার পরে আকবর আলীর মত মহা বিপদে কেউ না পরলে এ পথে কেইই পা বাড়ায় না। এ রাস্তাটায় নাকি বেশ বড় ধরনের দোষের ভাব আছে। ভয়ানক দোষের ভাব। অনেকেই বলে এটা নাকি ভুত-প্রেত চলা চলের প্রধান পথ। ঘোর অমাবশ্যায় এ এলাকার সব ভুত-প্রেত এ পথ দিয়েই নাকি চলাচল করে থাকে। আবার অনেকে বলে এই কাঁশিনাথপুর পাল পাড়ার বাম পাশের মোড়ের জটানো শ্যওরা গাছটায় ভুত-প্রেতের একটা স্থায়ী আস্তানাও নাকি আছে। পথের উত্তর পাশ সংলগ্ন ঠিক কালীবাড়ী সোজা চন্দনা নদীর পাড়েই আবার শশ্মান ঘাট। শশ্মান ঘাটের ভয়টাতো একেবারে চিরন্তন সত্য। যদিও ভুত প্রেতের সব কথাই শোনা গল্প। তার পরেও এলাকার সবার মুখে মুখে এমন সব ভুতের গল্প গুলো খুব ভারী ভাবেই প্রচলিত আছে। ভুত প্রেত বলে একটা কিছু আছে এ কথাটা আকবর আলী বিশ্বাস না করলেও রাত বিরাতে পথ চলতে কিছুটা ভয় পায় সে। গভীর রাতে হঠাৎ কোন শব্দ শুনলে তাঁর গা’ ছম ছম করে উঠে। শরীরের লোম গুলো সজারুর কাঁটার মত দাঁড়িয়ে যায়। তাঁর ভাষায় কোন এক অজানা আশঙ্খায় এটা হয়তো হয়। যেমন চাঁদে মানুষ গেছে এ কথাটা কিছু কাঠ মোল্লা কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায় না। কিন্তু চাঁদ থেকে ফিরে এসে নীল আর্মষ্ট্রং মুসলমান হয়ে গেছে এ কথাটা খুব আস্থার সাথে জোর গলায় প্রকাশ করে বেড়ায়। ভুতের বিষয়টাও ঠিক তেমনই। ভুত বলে কিছু নাই এটা জোর গলায় প্রকাশ করলেও ভয় আছে এমন পথে ঐ সাহসী লোক গুলোও সাধারনতঃ চলাচল করতে চায় না। আর কবি গুরু রবীন্দ্র নাথের ভাষায় বৈদ্যুতিক আলোতে বসে ভুতকে আস্বীকার করাটা যতটা সহজ ,গভীর অন্ধকার রাতে জনমানবহীন কোন ভুতুরে জঙ্গলে গিয়ে ভুতকে অস্বীকার করা ততটা সহজ কাজ নয়। ওঁয়াও ওঁয়াও-ওঁয়াও ওঁয়াও !!। ছোট বাচ্চার কান্নার শব্দ ভেসে আসছে মনে হয়। আশে পাশেতো কোন বাড়ী ঘরই নাই। ছোট বাচ্চার কান্নার আওয়াজ আসবে কি ভাবে ? নাকি শিয়াল কুকুরে কোন বাচ্চা টাচ্ছা নিয়ে এসেছে বাঁেশর ঝাড়ে ? আকবর আলী দাঁড়িয়ে পরে। দাঁড়িয়ে পরার সাথে সাথেই হঠাৎ চার পাঁচটা বাঁশ কড় কড় শব্দে প্যাচ খেতে খেতে আকবর আলীর সামনে রাস্তার উপর শুয়ে পরেই আবার কড় কড় শব্দে উপরের দিকে উঠে যেতে থাকে। হাতে থাকা প্রায় চার্জহীন টর্চ লাইটের হাল্কা আঁধারী আলোতে বাঁশ মোড়ানোর ঘটনা দেখে আকবর আলীর কলিজার মধ্যে ছ্যানাৎ করে চিলিক দিয়ে উঠে। মুুহুর্তের মধ্যে শরীরের সব গুলো লোম সজারুর কাঁটার মত দাঁড়িয়ে যায়। আবারও ওঁয়াও ওঁয়াও শব্দে বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ওদিকে বহু দুর থেকে কুকুরের ভয়ার্ত আর্তনাদ ভেসে আসছে। বাঁশ ঝাড়ের কড় কড়ানি শব্দটাও যেন ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। আকবর আলী ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কারন বাঁশের ঝাড়ের মধ্য দিয়ে চলার পথটা বেশ লম্বা। আধা কিলোমিটারেরও বেশী হবে। প্রায় মাঝামাঝি পথে এসে ফিরে যাওয়াটাও আবার বোকামী হতে পারে। হঠাৎ আগর বাতি জ্বালানোর গাঢ় ঘ্রান ভেসে আসতে থাকে। আগর বাতির ঘ্রানের মধ্যে সব সময়ই এক ধরনের লাশের ঘ্রান মেশানো থাকে। আগর বাতির ঘ্রান ভালো না। বড় অমঙ্গলের লক্ষন এটা। এখন আকবর আলী বাঁশ ঝাড়ের রাস্তার ঠিক মাঝখানটায় ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। সামনে আগানোর শক্তি নাই পায়ে। শরীরটা পাথরের মত ভারী বলে মনে হচ্ছে। গাঢ় আতরের ঘ্রানও পাওয়া যাচ্ছে। নাহ্ এবার আর অশরীরি বিষয়কে একেবারে অবজ্ঞা করা যাচ্ছে না। দেও দানব বা ভুত প্রেত বলে কিছু একটা আছেই। আগরবাতি আর আতরের ঘ্রান ভালো লক্ষন না। এ গুলোর ঘ্রান মানেই লাশের অস্তিত্ব। এবার একেবারে তিন সত্য তওবা। রাতের বেলা আর কোনদিনও এ রাস্তায় আর পা রাখাবো না। হঠাৎ বাঁশ ঝাড়ের উপর থেকে কি যেন সরাৎ সরাৎ শব্দে নিচে নেমে আসছে। না আর কিছুতেই দেরী করা যায় না। পেছন দিকে দৌড় দেওয়াই উত্তম। শালার তাস খেলার খেঁতা পুড়ি। চির জীবনের মত তাস খেলা বন্ধ। ভয়ে আবার কিছুতেই চিৎকার দেওয়া যাবে না। ভুতের ভয় পেয়ে যারা যারা চিৎকার দেয় তারাই নাকি জ্বরে আক্রান্ত হয়ে সাত দিনের মধ্যে মারা যায়। কিন্তু দৌড় দেওয়ার সময় পেছন থেকে যদি কেউ জাপটে ধরে ? বাতাসের গতিটাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাথে বৃষ্টির গুঁড়ি। বাঁশের পাতা ঝড়া বৃষ্টির পানি পরে আকবর আলী প্রায় আধা ভেজা হয়ে গেছে। না আর সামনে আগানো যাবে না। মনোবল বৃদ্ধি করতে হবে। দোয়া দরুদ যা মুখস্থ ছিল সবই পড়তে শুরু করে দিল। কিন্তু অজু না থাকাতে দোয়া দরুদ কাজে লাগবে বলে মনে হচ্ছে না। আর তাস খেলা হারাম জেনেও তাস খেলে এসে রাস্তায় ভয় পেয়ে দোয়া দরুদ পড়লে তা কাজে লাগবে কেন ? বরঞ্চ বিনা অজুতে দোয়া দরুদ পড়াও পাপের কাজ। কি যে ভয়ানক অবস্থা। সবই যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। কি যে ভালো আর কি যে মন্দ কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না আকবর আলী। ঐ যে আবার আগর বাতি আর আতরের ঘ্রান গভীর ভাবে ভেসে আসছে। সাথে লাশের গন্ধ। শ্যাওরা গাছের পেছনের খালের পাড়ে কান্নার আওয়াজ। আকবর আলীর সমস্ত শরীর হীম হয়ে আসতে থাকে। জীবন মৃত্যুর শেষ সন্ধিক্ষন। শেষ বারের মত আধো আলোর টর্চ লাইটটা জ¦ালাতেই চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। শ্যাওরা গাছটার নিচেয় একটা লাশ কাফনের সাদা কাপড় দিয়ে খাটিয়ার উপর রাখা। আকবর আলী আরেকবার লাশটার দিকে লাইট মেরে লাশের বিষয়টা নিশ্চিত হয়ে যায়। তার পরেই চন্দনা নদীর দিকে ভৌঁ দৌড়। তারপর যা ঘটলো তার সবটুকু মনে নেই আকবর আলীর। চন্দনা নদীর পাড় ধরে দৌড় দিতেই দেখে শশ্মান থেকে বিশাল মাথাধারী তিনজন লোক হেঁটে রাস্তার উপরের দিকে উঠে আসছে। প্রায় দশ ফুট ব্যাসের মাথা হবে ! তিনজনই দুই হাত দিয়ে ঐ বিশাল মাথা ধরে হাঁটছে। তারপর আর কিছু মনে নেই। ধবাস করে রাস্তার উপর পরে যায় আকবর আলী। ধবাস করে পরেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। যখন জ্ঞান ফেরে তখন ভোরের আজান হচ্ছিল। জ্ঞান ফিরেই ‘আমি কোথায়’ ‘আমি কোথায়’ বলে চিৎকার করে উঠে। ঐ বিশাল মাথাওয়ালা লোক তিনজনই আকবর আলীকে উদ্ধার করে আকবরের বাড়ীতে নিয়ে আসে। ঐ তিনজন ছিল জেলে সম্প্রদায়ের লোক। তাঁরা রাতে চন্দনা নদী থেকে মাছ ধরে বড় সাইজের মাছের ডালি মাথায় করে নিয়ে রাস্তার দিকে উঠছিল। একটু দুর থেকে তাঁদেরকে দেখে মনে হচ্ছিল বিশাল বিশাল মাথাওয়ালা মানুষ। আকবর আলী যখন মাটিতে পরে গোংরাতে থাকে তখন ঐ তিনজন জেলে আকবরকে অজ্ঞান অবস্থায় উদ্ধার করে তাঁর বাড়ীতে নিয়ে যায়। সাত সকালেই আকবরের বাড়ী বিশাল জনসভায় পরিনত হয়। বাড়ীতে যেন তিল ধরানোর ঠাঁই নেই। ঘটনা শুনে চেয়ারম্যান সাহেবও চলে এসেছেন। চেয়ারম্যান সাহেব আবার সব ঘটনাতেই তদন্তে বিশ^াসী। শুরু হলো তদন্ত করার পালা। চেয়ারম্যান সাহেব ঘটনা নিজেই তদন্ত করার জন্য আকবর আলী ও স্থানীয় লোকজন নিয়ে ঘটনাস্থলের দিকে রওনা হলেন। ঘটনার একটা সুষ্ঠ তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। যাওয়া হলো কালী বাড়ীর পাশের সেই খাল পাড়ের শ্যাওরা গাছটার নিচে। যেখানে লাশ দেখা গিয়েছিল। হ্যাঁ সেখানে সত্যি লাশটার অস্তিত্ব পাওয়া গেল। সত্যিকার অর্থেই যেন সাদা কাফনে মোড়ানো একটা লাশ। পাঁচ সারে পাঁচ ফিট লম্বা একজন মানুষের সাইজের এক খন্ড কাঠের গুঁড়ি। তার উপরে সাদা রঙের ব্যাঙের ছাতায় এমন ভাবে আচ্ছাদিত হয়ে আছে যা রাতের আধো আলোতে একটা লাশের মতই মনে হবে। আর কালীবাড়ীর বারান্দায় একজন সাধু বাবাকে পাওয়া গেল যিনি তখনো ধুপ জ¦ালিয়ে ধ্যান মগ্ন ছিলেন। ঐ ধুপের ঘ্রানটাই আগর বাতির ঘ্রান বলে মনে হচ্ছিল। আরও জানা গেল যে ঐ বাঁশের ঝাড়ে বড় একটা হনুমান এসে আশ্রয় নিয়েছে। হনুমানটা মানুষের আওয়াজ পেলেই এক বাঁশ থেকে আরেক বাশের উপর লাফ দেওয়ার কারনে সর সর শব্দ হওয়া সহ কিছু বাঁশ নূয়ে পরে এবং আবার বাঁশ গুলো উপরে উঠে যায়। সব চাইতে অবাক কান্ড হলো ঐ বিশাল বাঁশের ঝেপের মাঝে খেক শেয়ালে বাচ্চা ফুটিয়েছে। রাতের বেলায় শেয়ালের বাচ্চার উঁ উঁ শব্দের কান্না মানুষের বাচ্চার কান্নার মতই মনে হয়। তদন্তে একে একে গত রাতের সকল আজগুবি ঘটনাই উদ্ঘাটিত হয়ে গেল। সর্বশেষ ভুত আছে কি নাই তদন্তে তা উদ্ধার করা না গেলেও গত রাতের ঘটনা গুলো যে ভুতের কান্ড ছিল না তা দিবালোকের মতই সবার কাছে পরিস্কার হয়ে গেল। গত রাতের ঘটনাগুলো ভুতের কান্ড না হলেও আকবর আলী সেই দিন থেকে তাস খেলা তো বাদ দিয়েইে দিলো এমন কি সন্ধ্যার আগেই সুবোধ বালকের মত বাড়ীতে এসে হাত মুখ ধুয়ে সোজা ঘরে গিয়ে বসে। কারন চেয়ারম্যান সাহেবত যত কথাই বলুক না কেন ঐ দিন বাঁশ ঝাড়েরর নিচে বৃষ্টির মধ্যে দু’পাশলা গরম বাতাস তার গা ছুয়ে গেছে। সাথে উটকো আঁসটে গন্ধ। এর উত্তর কি ? ঠান্ডা বাতাসের মধ্যে গরম বাতস এলা কোত্থেকে ? আকবর সেদিন রাতে আরো অনেক কিছুই বুঝে ফেলেছে। ঐ সব ধানাই পানাই কথার বুঝ দিয়ে অন্ততঃ আকবরকে আর বোঝানো যাবে না। ভুত প্রেত বলে কিছু নাই, তাই না ? তাসের পার্টনার’রা তাকে বাড়ী পর্যন্তু পৌঁছে দেওয়ার শত ভাগ নিশ্চয়তা দিলেও আকবর পার্টনারদের মুখের উপর সোজা ‘না’ শব্দটা ব্যাবহার করে দিয়েছে। ন্যাড়া আর কোন দিনও বেল তলায় যাবে না। সর্বশেষ আকবর আলী এখন আকবর মুসল্লি নামে পরিচিত।