সবাই যেতে চায় গন্তব্যে, কজন পারে
- প্রকাশের সময় : ০৪:৩৭:৪১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪
- / ১০২৪ জন সংবাদটি পড়েছেন
সুবর্ণভূমি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বসে আছি অনেকক্ষণ। সকাল সাড়ে ১০টায় ফ্লাইট। এসেছি পৌনে ৭টায়। তিন ঘণ্টা আগে আসার নিয়ম। বাংকক প্রচন্ড জ্যামের শহর। তাই হাতে সময় নিয়ে এসেছি। কিন্তু আজ কোন এক ভাগ্যবলে রাস্তায় এতটুকুও জ্যামে পড়িনি। অনেকে ভাবতে পারেন এত সকালে জ্যাম কীসের। থাইল্যান্ডের জন্য এটা কিন্তু সকাল না। সকাল ৭টার মধ্যেই কর্মচঞ্চল হয়ে ওঠে পুরো শহর। সন্ধ্যা নামতেই ঝাঁপ নেমে আসে সবকিছুর। তাই আমি যে সময়টাকে খুব সকাল ভাবছি ওদের জন্য সেটা বেশ বেলা। আমরা আরাম-আয়েশ করে ১০-১১টা পর্যন্ত ঘুমাতে পারি, ইচ্ছা হলে অফিস যেতে পারি, দোকান খুলতে পারি, ইচ্ছা না হলে না। এরা তেমন না। তাই তো এদের এত উন্নতি!
আমাকে বসিয়ে দিয়ে ছেলে গেছে লাগেজ বুকসহ অন্যান্য কাজ সারতে। বসে বসে দেখছি কর্মচাঞ্চল্য। একের পর এক মানুষ আসছে। আসছে একের পর এক প্লেন। প্লেনের পেট থেকে উগরে দেওয়া মানুষগুলো বেরিয়ে যাচ্ছে এ পথ দিয়েই। আবার উড়ে যাচ্ছে একের পর এক। কিছু মানুষ গিয়ে ঢুকছে সেসব প্লেনের পেটে। তারা ছড়িয়ে যাচ্ছে সারা দুনিয়ায়, দেশ থেকে দেশে, নগর থেকে নগরে।
জড়ো হওয়া মানুষগুলোর কেউ বসছে, কেউ এগিয়ে যাচ্ছে, কেউ ছবি তুলছে, কেউ দৌড়াচ্ছে, কেউ মোবাইল ফোনে কথা বলছে। একেকজনের একেক রকম ব্যস্ততা। এক নবীন মাকে দেখলাম সন্তানকে দুধ খাওয়াতে হিমশিম খাচ্ছেন। বাবা বেচারা সাহায্য করার চেষ্টা করছেন কিন্তু বাচ্চা পণ ধরেছে, খাবে না। তারস্বরে চেঁচাচ্ছে। দেখলাম একটা ছেলে তার মাকে নিয়ে ঢুকল। মা হুইলচেয়ারে। ছেলেটা পরম যত্নে মাকে ঠেলে ঠেলে নিয়ে আসছে যাতে মা ব্যথা না পায়, হুইলচেয়ার আটকে যেন মায়ের ধাক্কা না লাগে। আমার থেকে কিছুটা সামনে গিয়ে হুইলচেয়ার ফিক্সড করে ছেলেটা গেল কাজ সারতে। এর মধ্যে এলো একটা জুটি, যুবক-যুবতী। তারা আমার সামনে চেয়ারে বসেই আলিঙ্গনাবদ্ধ হলো। চুমু, জাপ্টাজাপ্টি আরও অনেক কিছু। কেউ ফিরেও দেখছে না। আমি বাংলাদেশি মানুষ। তটস্থ হয়ে গেলাম! যদি ছেলে এর মধ্যে এসে যায় আর দেখে ফেলে। এর কিছুক্ষণ পর এলো আরেক জুটি। দেখেই বুঝলাম এরা বাঙালি। দু-চারটা বাংলা কথাও শুনলাম। এরাও বিপরীত দিকে বসে জড়াজড়িতে মত্ত হলো, বিদেশি জুটির চেয়ে আরও অনেক খারাপভাবে। এটা ওদের দেশে স্বাভাবিক। ওরা জানে, কতটুকু পর্যন্ত যাওয়া যায় বা যাওয়া উচিত। কিন্তু বাঙালি ছেলেমেয়ে তা জানে না। তাদের দেখানো হয়েছে ‘হাভাতাকে শাকের খেত’। পারলে তারা ওই চেয়ারগুলোকেই বিছানা বানিয়ে ফেলে। অন্যদিকে তাকিয়ে রইলাম। আর তাকিয়ে থাকতে থাকতেই দেখলাম একজন মহিলা ঢুকলেন সঙ্গে সম্ভবত তার স্বামী। ঘন ঘন রুমাল দিয়ে চোখ মুছছেন তিনি। স্বামী তাকে সান্ত¡না দিচ্ছেন। নিশ্চিত বুঝলাম, এ মহিলার একান্ত আপনজন কেউ চলে গেছেন!
এয়ারপোর্ট এক অদ্ভুত জায়গা। এখান থেকে কত মানুষ, কত দিকে যায়। চলে যায় দূরদূরান্তে। উচ্চশিক্ষার জন্য যায় কত সন্তান। বাপ-মাকে বলে যায় ডিগ্রি নিয়ে ফিরবে, ফেরে না। বিয়ে করে মেয়ে স্বামীর সঙ্গে চলে যায়। দু-চার বছরে একবার আসে। কখনো তাদের সন্তানদের দেখার ভাগ্য বাবা-মায়ের হয়, কখনো হয় না। আবার অনেকে নিজে গিয়ে পুরো পরিবারকে টেনে নিয়ে যায়। কতজন প্রতারকের খপ্পরে পড়ে নিঃস্ব হয়। ভুয়া ওয়ার্ক পারমিট তাদের বিদেশে থাকার অনুমতি দেয় না, দেয় না কাজ। মাঝখান দিয়ে চলে যায় ঘটিবাটি। প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে প্রতারণার ফন্দি-ফিকিরও বেড়েছে। সরল মানুষকে ঠকানো এখন অনেক সহজ। অনেক স্বপ্ন নিয়ে টেলিফোনে বিয়ে করে বিদেশে গিয়ে দেখে স্বামীর দিব্যি আরেকটা সংসার আছে। সে ও ফিরে আসে খালি হাতে এ রকম কোনো এয়ারপোর্ট দিয়ে। একেকজনের জীবনের গল্প একেক রকম। কত বাবা-মা একা মরে পড়ে থাকে নিঃসঙ্গ। ছেলেমেয়ে জানতেও পারে না। তারা তখন উচ্চ বেতন, উচ্চ ডিগ্রি ডলার পাউন্ডের নেশায় মত্ত। একদিন যে বাবা-মা তাদের জন্ম দিয়েছিল, মায়া-মমতা দিয়ে বড় করেছিল, নিজেরা না খেয়ে খাইয়েছিল, নিজেরা না পরে পরিয়েছিল তারাই এখন অনেক দূরের মানুষ। তাদের কাছে টানতে গেলে ক্যারিয়ার গোছানো হয় না। এ গল্প শুধু বাংলাদেশের নয়, সারা পৃথিবীর। একবার ভিয়েনা থেকে ইতালি যাওয়ার পথে ট্রেনে এক যুবকের সঙ্গে তার পৌঢ়া মাকে দেখে খুশি হয়েছিলাম খুব। মনে মনে ভেবেছিলাম, আমাদের ধারণা, বিদেশিরা বাবা-মাকে দেখে না। কিন্তু কই এই ছেলেটা তার পৌঢ়া মাকে নিয়ে তো ঠিকই যাচ্ছে কোথাও। জানতে চেয়েছিলাম। ইচ্ছা করেই জমিয়েছিলাম গল্প। ছেলেটা বলেছিল, সে আমেরিকায় একটা সফটওয়্যার কোম্পানিতে চাকরি করে। পাঁচ বছর পর দেশে এসেছে। মায়ের বহুদিনের ইচ্ছা ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে একবার বেড়াবে। তাই মাকে নিয়ে বেড়াতে বেরিয়েছে। অর্থাৎ সেই একই কেচ্ছা, সেই একা থাকা। প্রশ্ন করে জানতে চাইনি, তার মা একা একা কীভাবে কাকে নিয়ে থাকে। কারণ আমি জানি, জানতে চাইলেই শুনতে হবে একটা কমন গল্প। যা এখন আমাদের ঘরে ঘরে। বরং বিদেশিরাই তুলনামূলকভাবে ভালো। তারা জানে ১৮ বছর পর্যন্ত বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকবে, তারপর তাদের গন্তব্য আলাদা, জীবন আলাদা। বাবা-মাও সেটা জানেন। কাজেই ওটাই তাদের সিস্টেম। কেউ আশা করে না সন্তানরা তাদের জড়িয়ে থাকবে। বাবা-মা নিজেরা না খেয়ে ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতের জন্য সবকিছু জমা করেন না। এর মধ্যেও দুচারজন সন্তান বাবা-মায়ের সঙ্গে থেকে যায়। তারা ব্যতিক্রম।
আমাদের দেশে বাবা-মাকে ভালোবাসা, তাদের কেয়ার করার নামে এখন যা চলছে তা রীতিমতো মিথ্যাচার। অধিকাংশ সংসারে ছেলে পুত্রবধূ নিয়ে সমস্যা রয়েছে। বাড়ছে দূরত্ব। একসময় খুব খারাপ অবস্থার মধ্য দিয়ে তারা আলাদা হয়ে যাচ্ছে। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে মুখ দেখাদেখি। তার চেয়ে ভালো বিদেশিরা যেটা করে সেটাই। তাতে অন্তত সম্পর্কটা স্বাভাবিক থাকে। ভাঙা জিনিস যতই সুপার গ্লু দিয়ে আটকানোর চেষ্টা করা হোক না কেন, তা টেকে না। তাই যে সম্পর্ক টেকানো যাবে না, তা না টেকানোর চেষ্টা করাই ভালো।
বাবা-মা তাদের নয়নমণি ছেলেমেয়েকে অনেক আশা নিয়ে বিদেশে পড়তে পাঠান। ছেলে বড় হবে, মানুষের মতো মানুষ হবে, তাদের নতুন বাড়িঘর হবে, এলাকায় মানসম্মান বাড়বে। বাস্তবে হয় কিন্তু তার কমই। একবার ভেনিসের রাস্তার পাশে বসে একজন ছেলেকে অনর্গল ইংরেজিতে কথা বলতে দেখে চলতে চলতে থমকে দাঁড়ালাম। ছেলেটা পত্রিকা বিক্রি করছিল। থমকে দাঁড়ালাম কারণ ছেলেটাকে আমার খুব চেনা মনে হলো। এগিয়ে গিয়ে পাশে দাঁড়ালাম। পত্রিকা উল্টেপাল্টে দেখতে দেখতে আস্তে জিজ্ঞাসা করলাম, আর ইউ ফ্রম বাংলাদেশ? ছেলেটা চকিতে তাকাল। তার চোখ বলে দিল আমি ঠিকই ধরেছি। আবার প্রশ্ন করলাম, আর ইউ ফ্রম নড়াইল? এবার ছেলেটা ঝটিতি মুখ ঘুরাল। একবারও আমার দিকে ফিরে তাকাল না। অনর্গল ডয়েস ভাষায় কথা বলতে লাগল। আমি আরও দু-একবার ওকে প্রশ্ন করলাম। ফিরেও তাকাল না। অর্থাৎ আমি যা ভেবেছি সেটাই। বাবা-মা এলাকায় বলে বেড়াচ্ছেন তাদের ছেলে ভেনিসে অনেক বড় চাকরি করে। মানুষের অবশ্য সন্দেহ হয়েছিল, কারণ যতটা ওরা বলে ঘরদোরের অবস্থা তেমন বদলায়নি।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এমনটাই ঘটে। এয়ারপোর্ট সবার ভাগ্য বদলে দেয় না। বরং অনেকের ভাগ্য চিরতরে অন্ধকারে হারিয়ে যায়। কিন্তু তখন আর বিদেশে যাওয়া ছেলে বা মেয়েটার ফেরার পথ থাকে না। যেমন সাবু। সাবু আমার দূরসম্পর্কের আত্মীয়। আমি ইতালি গেলে ভীষণ উৎফুল্ল হয়ে ওরা আমাকে বাসায় নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু গিয়েই বুঝতে পারি, ওরা মোটেই সুখে নেই, বেশ কষ্টে আছে। সাবু কোনো একটা কোম্পানিতে ছোট্ট একটা কাজ করে। বউ নিয়ে থাকার অবস্থা তার নয়, তবু আছে সম্ভবত বউয়ের চাপাচাপিতে। আছে আরেকজনের সঙ্গে, ভাগে। আমি যে দু-একবেলা সে বাড়িতে ছিলাম স্পষ্ট বুঝেছিলাম, একটা বাড়তি ডিম খাওয়াতেও ওদের কষ্ট হচ্ছে। প্রচণ্ড ঠান্ডায় ওদের ঘরে একটা রুমহিটারও ছিল না। অথচ ওদের আন্তরিকতার কমতি ছিল না। অবস্থা বুঝে দ্রুত চলে এসেছিলাম। ওরা অসন্তুষ্ট হয়েছিল। ওদের ডলার ছিল না, মন ছিল। কিন্তু মানুষকে বাড়িতে রাখতে হলে, খাওয়াতে হলে টাকাপয়সা লাগে। যে আকাক্সক্ষা নিয়ে ওরা ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে প্লেনে উঠেছিল, যে স্বপ্ন নিয়ে দিন গুনছে ওদের বাবা-মা, তাদের সে স্বপ্ন কোনো দিন ফলবে বলে মনে হয় না। অথচ সাবুও আর কোনো দিন ফিরতে পারবে না।
এয়ারপোর্ট তাই এক অদ্ভুত জায়গা। আসা-যাওয়ার পথের মাঝে এ জায়গাটুকুতে সব সময় মুকুল ঝরে না। এ জায়গা সবার ভাগ্য ফুলে ফুলে সাজায় না। এমন অনেকে আছে যারা এক ফ্লাইটে গিয়ে আরেক ফ্লাইটে ফিরে আসে, কিংবা বিদেশের এয়ারপোর্টে নেমে জেলে ঢোকে দালালের খপ্পরে পড়ে। জমিজমা বিক্রি করে বিদেশে গিয়ে চাকরি পায় না। অবৈধ হয়ে পালিয়ে বেড়ায়। কাজ করতে না পেরে না খেতে পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করে। কত নারী সংসারের সাশ্রয়ের আশায় বিদেশে গিয়ে মালিকের লালসার শিকার হয়ে স্বামী সংসার হারায়। আবার কিছু মানুষের ভাগ্য সত্যিই খুলে দেয় এমন কোনো কোনো এয়ারপোর্ট। এসব ভাবনার মধ্যেই ছেলে ফিরে আসে। আমাদের বোডিংয়ের ঘোষণা হয়ে গেছে। মনিটরের সামনে দাঁড়ানো অনেক লোক। প্রত্যেকেরই চোখ চকচকে। সবাই যেতে চায় গন্তব্যে। কজন পারে! আমরা এগোই।
লেখক : কথাশিল্পী, গবেষক
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন।