এনআইডি স্বরাষ্ট্রে নেওয়ার আইন বাতিল করতে সরকারকে ইসির প্রস্তাব
- প্রকাশের সময় : ০১:২৫:৩০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২৫
- / 10
জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) কার্যক্রম সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিতে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে করা জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন-২০২৩ বাতিল করতে অন্তর্বর্তী সরকারকে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
একই সঙ্গে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন-২০১০ কার্যকর করে এনআইডি কার্যক্রম ইসির অধীনেই রাখার জন্য বলেছে সংস্থাটি।
এনআইডি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিতে সরকার ২০২১ সালের ২১ মে প্রথমবারের মতো ইসিকে চিঠি দেয়। সে সময়কার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের যুগ্ম সচিব শফিউল আজিম ইসি সচিব মো. হুমায়ুন কবীর খোন্দকারকে পাঠিয়ে এনআইডি কার্যক্রম ছেড়ে দিতে বলে। ইসি কর্মকর্তারা এতে ঘোর আপত্তি জানালেও কেএম নূরুল হুদার কমিশন এ নিয়ে কোনো জোর আপত্তি তোলেননি। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ায় ২০১০ সালের আইনটি। ফলে সে সময় আর নিতে পারেনি সরকার।
পরবর্তীতে ২০২৩ সালে নতুন আইন প্রণয়ন করে সরকার। তবে নিজস্ব লোকবল ও অবকাঠামো না থাকায় ওই আইনটি কার্যকর করা হয়নি। বলা হয়, সরকার যখন গেজেট আকারে কার্যকর করবে তখন কার্যকর হবে আইন। এরমাঝে নির্বাচন কমিশনে পরিবর্তন আসে। কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশন এলে কর্মকর্তারা আন্দোলনে যেতে চাইলে কমিশন নড়েচড়ে বসে। পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতিকে এক চিঠিতে এনআইডি ইসির অধীনে কেন থাকা উচিত তার ব্যাখ্যা করে। যদিও তারা সরকারের কাছে আইনটি বাতিলের সরাসরি কোনো সুপারিশ বা দাবি রাখেনি। সরকারের ওই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে সুশীল সমাজ থেকে শুরু করে সচেতল মহল ‘ভোটার তালিকা প্রশ্নবিদ্ধ’ হওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করে। এরই মাঝে সরকার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এনআইডি’র একটি পৃথক শাখাও খুলে ফেলে। প্রস্তুতি নিতে শুরু করে আনুষ্ঠানিক হস্তান্তরের। তবে গণঅভ্যুত্থানের পর পটপরিবর্তন হলে সেই আলোচনা ফের সামনে আসতে থাকে। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা থেকে শুরু করে ইসি কর্মকর্তা, সেবাগ্রহীতারা সব পক্ষই এনআইডি ইসির অধীনেই রাখার জোর দাবি তোলেন। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আন্দোলনের ডাকও দেন।
পরবর্তীতে গত ২১ নভেম্বর নিয়োগ পান এএমএম নাসির উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন নতুন নির্বাচন কমিশন। বিষয়টি তাদের কাছে উত্থাপন করা হলে প্রথম বৈঠকেই কমিশন সরকারের করা নতুন আইনটি বাতিলের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করেন। এবং এনআইডি কার্যক্রম ইসির অধীনে রাখতে সরকারের সঙ্গে পত্রালাপের সিদ্ধান্ত নেন। সে মোতাবেক বুধবার (১৬ জানুয়ারি) রাতে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব এবং আইন ও বিচার বিভাগের সচিবের কাছে আনুষ্ঠানিক চিঠি দেন ইসি সচিব আখতার আহমেদ।
চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১৯ (১) অনুসারে রাষ্ট্রপতি পদের ও সংসদের নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা প্রস্তুতকরণের তত্ত্বাবধান, নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণ এবং অনুরূপ নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত। পাশাপাশি, ভোটার তালিকা আইন, ২০০৯-এর ধারা ১১ ও ভোটার তালিকা বিধিমালা, ২০১২-এর বিধি ৩(গ) এবং এ সংক্রান্ত বিষয়ে উচ্চ আদালতের আদেশ অনুসারে ভোটার তালিকা প্রণয়নের ক্ষেত্রে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সে অনুযায়ী, ধারাবাহিকভাবে প্রাথমিক স্তর থেকে তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে ভোটার তালিকা প্রস্তুত, হালনাগাদসহ প্রাসঙ্গিক কার্যাদি নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত। এই কার্যক্রম থেকে ফলাফল হিসেবে যে দু’টি বিষয় পাওয়া যায় তা হচ্ছে; ক) ভোটার তালিকা, এবং খ) জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি)।
উল্লেখ্য যে, জাতীয় নির্বাচনের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও একই ভোটার তালিকা ব্যবহার করা হয়। ২০২১ সালের ১৭ মে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন কার্যক্রম নির্বাচন কমিশনের পরিবর্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন ন্যস্ত করার বিষয়ে তৎকালীন সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এতে একই বছরের ৭ জুন নির্বাচন কমিশন সচিবালয় থেকে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বরাবর পাঠানো চিঠির মাধ্যমে এনআইডি কার্যক্রম নির্বাচন কমিশনে রাখার পক্ষে মতামত প্রেরণ করা হয়।
অতঃপর, নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ/আলোচনা ব্যতিরেকেই বিগত ২০২৩ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন, ২০১০ (২০১০ সনের ৩ নং আইন) বাতিলপূর্বক জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন, ২০২৩ (২০২৩ সনের ৪০ নং আইন) প্রণয়ন করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায়, ২০২৩ সালের ১৪ নভেম্বর Rules of Business, 1996 এর Allocation of Business among different Ministries and Divisions-এ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের দায়িত্বসমূহের মধ্যে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
এদিকে ২০২৩ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন, ২০২৩ জারি করা হলেও আইনের ধারা ১(২) অনুযায়ী গেজেট বিজ্ঞপ্তি জারির মাধ্যমে আইনটি কার্যকর করার শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে, যা অদ্যাবধি করা হয়নি বিধায় ধারা ৩০(৩)-এর উপধারা ১(খ) অনুযায়ী জাতীয় পরিচয়পত্র কার্যক্রম নির্বাচন কমিশন থেকে পরিচালিত হচ্ছে। ২০২৪ সালের ১০ সেপ্টেম্বর জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন, ২০২৩ বাতিল করতঃ এনআইডি কার্যক্রম নির্বাচন কমিশনের কাছে বহাল রাখার কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্যে রাষ্ট্রপতির কার্যালয় বরাবর নির্বাচন কমিশন থেকে অনুরোধ করা হয়।
ইসি সচিব তার চিঠিতে আরও উল্লেখ করেন, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান-এর ১১৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি পদের ও সংসদের নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা প্রস্তুতকরণের তত্ত্বাবধান, নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণ নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত এবং ভোটার তালিকা আইন ২০০৯ এর ধারা ১১ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনকে ভোটার তালিকা হালনাগাদকরণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন, ২০২৩ কার্যকর করা হলে তা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ার পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক ক্ষমতাও খর্ব হতে পারে।
নির্বাচন কমিশনের স্বাধীন সত্তা অক্ষুণ্ন রাখা এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান-এর ১১৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ভোটার তালিকা প্রস্তুত ও এ সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যাদি নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব বিধায় জাতীয় পরিচয়পত্র কার্যক্রম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্তকরণের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন, ২০২৩ বাতিল করার বিষয়ে ১৪তম নির্বাচন কমিশনের ২য় বৈঠকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। তাই জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন, ২০২৩ (২০২৩ সনের ৪০ নং আইন) বাতিলপূর্বক জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন, ২০১০ এর (২০১০ সনের ৩ নং আইন) আইন পুনঃবহাল, এবং কার্যতালিকা (Rules of Business, 1996 এর Allocation of Business among different Ministries and Divisions) সংশোধন করে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন সংক্রান্ত কার্যাদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের পরিবর্তে নির্বাচন কমিশনে পুনঃন্যস্তকরণের প্রস্তাব সদয় বিবেচনার জন্য উপস্থাপন করা হলো।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে ২০০৮ সালে ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা প্রণয়ন করেন তৎকালীন ড. এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন। পরবর্তীতে তারা ভোটার তালিকা বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে নাগরিকদের পরিচয়পত্র দেয়। এরপর ২০১১ সালে এসে লেমিনেটিং করা কাগজের জাতীয় পরিচয়পত্রটি বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় একটি প্রকল্প নিয়ে আধুনিকায়ন করে। এই প্রকল্পের মাধ্যমেই দেওয়া হয় স্মার্টকার্ড, যা দিয়ে পরবর্তীতে ভোট দেওয়ার প্রচলনও শুরু করা হয়েছিল ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে।