ঘরের আগুনে পুড়ছে রাজবাড়ী জেলা বিএনপি, প্রকট আকার ধারণ করেছে কোন্দল
- প্রকাশের সময় : ০৮:১৮:৩৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৭ জুলাই ২০১৭
- / ১৬৫৮ জন সংবাদটি পড়েছেন
বিশেষ প্রতিনিধি ॥ দ্বন্দ্ব, বিভেদ, কোন্দল এসব শব্দ যেন রাজবাড়ী জেলা বিএনপির সাথে সমার্থক হয়ে গেছে। প্রায় দুই যুগের মধ্যে খুব কম সময়ের জন্যই জেলা বিএনপির নেতাকর্মীদের এক সাথে দেখা গেছে। দীর্ঘদিন ধরে চলা খৈয়ম গ্রুপ আর খালেকÑহারুন গ্রুপের মধ্যে বিরাজমান দ্বন্দ্ব নতুন কমিটি ঘোষণার পর যেন আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। নতুন কমিটিতে দুটি গ্রুপের প্রায় সমান ভাগে পদ পদবী দেয়া হলেও সন্তুষ্ট হতে পারছে না কোনো পক্ষই। চলছে অভিযোগ আর পাল্টা অভিযোগ। এসব কারণে তৃণমূল নেতাকর্মীরা এক প্রকার হতাশ হয়ে পড়েছেন। কেউ কেউ দূরে সরে গেছেন রাজনীতি থেকেই। কোন্দল নিরসনে দলের চেয়ারপার্সনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তারা। যদিও দু পক্ষের নেতারা বলছেন, তারা নিজেরা বসেই কোন্দল নিরসন করে নেবেন।
রাজবাড়ী জেলা বিএনপি সূত্র জানা গেছে, জেলা বিএনপির সভাপতি সাবেক এমপি আলী নেওয়াজ মাহমুদ খৈয়মের নেতৃত্বে একটি গ্রুপ পরিচালিত হয় জেলা বিএনপির দলীয় কার্যালয় থেকে। অপর গ্রুপের নেতৃত্বে রয়েছেন বর্তমান সদর উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা বিএনপির সহ সভাপতি অ্যড. এমএ খালেক এবং সাধারণ সম্পাদক হারুন অর রশীদ। এই গ্রুপটি অ্যড. এমএ খালেকের নিজস্ব কার্যালয় থেকে দলীয় কর্মকান্ড পরিচালনা করে আসছে। দলীয় এবং কেন্দ্রীয় সকল কর্মসূচী পালিত হয় পৃথক পৃথকভাবে। গত ১০ জুলাই হঠাৎ করেই কেন্দ্র থেকে জেলা বিএনপির ১৫১ সদস্য বিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়। কমিটিতে স্থান পাওয়া ৭৮ জন খৈয়ম গ্রুপের এবং ৭৩ জন খালেকÑহারুন গ্রুপের বলে জানা গেছে। যেকারণে কমিটিতে এসেছে আমূল পরিবর্তন। পদবঞ্চিতরা হয়েছেন চরমভাবে ক্ষুব্ধ। দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির রাজনীতির সাথে যুক্ত এমন অনেকেই বাদ পড়েছেন। কমিটিতে স্থান পাওয়া অনেককে নিয়ে এক পক্ষ আরেক পক্ষের বিরুদ্ধে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করছেন। খৈয়ম গ্রুপতো সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েই দিয়েছে এ কমিটি তারা কিছুতেই মানবেন না। প্রয়োজনে মামলা করবেন। কমিটি ঘোষণার পরদিনই হামলার শিকার হয়েছেন ঘোষিত কমিটির দফতর সম্পাদক খন্দকার নুরুল নেওয়াজ নুরু। তিনি খালেক-হারুন গ্রুপের বলে পরিচিত। বিষয়টি দলীয় কোন্দল কীনা তা এখনও পরিষ্কার নয়।
খৈয়ম গ্রুপের নেতারা অভিযোগ করেছেন কমিটিতে স্থান পাওয়া আব্দুল হক, কেএ বারী, অ্যড. কামরুল আওয়ামী রাজনীতির সাথে জড়িত। খায়রু যুবদল নেতা বাবলু হত্যার আসামি। আসলাম মিয়া, লুৎফর রহমান, আব্দুস সালামকে কখনও বিএনপির কর্মসূচীতে দেখা যায়নি।
খৈয়ম গ্রুপ যেমন কমিটির কিছু নেতার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সম্পৃক্ততার অভিযোগ এনেছে তেমনি খালেকÑহারুন গ্রুপও কমিটিতে স্থান পাওয়া অ্যড. আক্কাছ আলী, আলতাফ মাহমুদ পিয়াল, আতিয়ার রহমান, হাবিবুর রহমান রাজা, অ্যড. এমএ গফুরের বিরুদ্ধে আওয়ামী রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ততার অভিযোগ করেছে। নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ করেছেন অনেকের বিরুদ্ধে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এক গ্রুপের নেতৃত্বে থাকা অ্যড. এমএ খালেক বিএনপির জন্মলগ্ন থেকেই দলটির সাথে যুক্ত। একজন ত্যাগী ও পরীক্ষীত রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত তিনি। ২০০১ সালের নির্বাচনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীতার অন্যতম দাবিদার ছিলেন তিনি। ওই নির্বাচনের আগে তৎকালীন পৌরসভা চেয়ারম্যান আলী নেওয়াজ মাহমুদ খৈয়ম ওয়ার্কার্স পার্টি থেকে বিএনপিতে যোগ দিয়ে রাজবাড়ীÑ১ আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। মূলতঃ তখন থেকেই বিভেদটা শুরু। এরপর দীর্ঘদিন বহিষ্কৃত ছিলেন অ্যড এমএ খালেক। ২০০৬ সালে বিএনপি ক্ষমতা হারানোর পর রাজনীতিতে সক্রিয় হন অ্যড. খালেক। রাজনীতির পালা বদল হলেও বিএনপির মধ্যে বিভেদটা বেড়েছে বৈ কমেনি। ২০১৪ সালে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের ঠিক আগে কোন্দল নিরসন হয় এবং দুপক্ষই একসাথে কাজ শুরু করে। ওই নির্বাচনে সদর উপজেলার চেয়ারম্যান পদে বিএনপির প্রার্থী হয়ে জয়লাভ করেন অ্যড. খালেক। তবে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে এ দুই নেতার সম্পর্কে আবার চিড় ধরে। ফলে আবারও শুরু হয় গ্রুপিং। যা এখনও বিরাজমান। আর এসব দ্বন্দ্ব কোন্দলের কারণে বিএনপির মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা হতাশ। প্রবীণ অনেক নেতা রাজনীতি থেকে দূরে সরে রয়েছেন অভিমানে। এদিকে এক সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালে রাজবাড়ী পৌরসভা নির্বাচনে দলের সভাপতি আলী নেওয়াজ মাহমুদ খৈয়ম তার নিজ ছেলেকে মেয়র পদে মনোনয়ন দেন। বিষয়টি অনেক নেতাকর্মীই ভালোভাবে নিতে পারেননি। এটিও গ্রুপিংয়ের আরেকটি কারণ বলে জানায় সূত্রটি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির মাঠ পর্যায়ের একজন নেতা বলেন, এই দুই নেতার দ্বন্দ্বে বিএনপির লাভ তো কিছু হচ্ছে না, ক্ষতিই হচ্ছে। তাদের দ্বন্দ্ব দেখে বিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতারা মুচকি হাসে। এর অবসান হওয়া খুব জরুরী। এজন্য কেন্দ্রের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।
দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির রাজনীতির সাথে যুক্ত রয়েছেন বর্ষীয়ান নেতা অ্যড. লিয়াকত আলী। তিনি বলেন, জেলা বিএনপির মধ্যে দ্বন্দ্ব কোন্দলের একমাত্র কারণই হলো ক্ষমতার। কে কার চেয়ে বেশি ক্ষমতাবান এটা প্রমাণ করতেই ব্যস্ত সবাই। রাজবাড়ীতে খৈয়ম এবং খালেক দুজনই এমপি হতে চান। এসব দ্বন্দ্ব কোন্দলের কারণে আমি রাজনীতি থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছি।
জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম পিন্টু বলেন, ঘোষিত কমিটিতে বিএনপির অনেক ত্যাগী নেতাকর্মী বাদ পড়েছে। তারা থাকলে আরও ভালো হতো। পার্টির স্বার্থে সকলে যদি এক হয়ে কাজ করতে পারি তাহলে আগামি সংসদ নির্বাচনে রাজবাড়ীর দুটি আসনই আমরা বেগম জিয়াকে উপহার দিতে পারব।
খালেকÑহারুন গ্রুপের নেতৃত্বে থাকা রাজবাড়ী জেলা বিএনপির সহ সভাপতি ও সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অ্যড. এমএ খালেক বলেন, দলের চেয়ারপার্সন বেগম জিয়া যে কমিটি আমাদেরকে উপহার দিয়েছেন তাতে আমরা খুশী। তবে কমিটিতে অনেক অযোগ্য লোককে ঠাঁই দেয়া হয়েছে। এদের কাছ থেকে রিটার্ন কিছু পাওয়া সম্ভব নয়। অনেকে আছেন যারা আন্দোলন সংগ্রামে কখনও রাজপথে ছিলেন না। আবার নজর মওলা, গাজী মানিক, ফারজানা লিপির মতো অনেক ত্যাগী নেতাকর্মীও বাদ পড়েছেন। দলের ত্যাগী এসব নেতাকর্মীদের বিএনপির পৌর ও থানা কমিটিতে অন্তর্ভূক্ত করতে হবে। তিনি অভিযোগ করেন, দলের মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনায় আমরা ঠিকই কর্মসূচী পালন করেছি। কিন্তু ওরা (খৈয়ম গ্রুপ) কোনো কর্মসূচী পালন করে নাই।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, জেলা বিএনপির কোন্দল নিরসন না হলে আগের মতোই পৃথকভাবে আমর্ াকর্মসূচী পালন করবো। আমরাও কোন্দল চাইনা। কোন্দল নিরসনের জন্য দলের চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।
রাজবাড়ী জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হারুন অর রশীদ বলেন, আমি বিএনপিকে ভালোবাসি। কোনো স্বার্থের জন্য রাজনীতি করিনা। জেলা বিএনপির কোন্দল নিরসনের জন্য আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করবো। সকল ভুল বোঝাবুঝি দূর করে এক প্লাটফর্মে এসে রাজনীতি করবÑ সে চিন্তা ভাবনা নিয়েই আমরা এগুতে চাই। সামনে নির্বাচন। এসময়ে দলের মধ্যে বিভেদ থাকলে কারো জন্যই ভালো হবেনা। একথা সবাইকেই অনুধাবন করতে হবে।
খৈয়ম গ্রুপের নেতৃত্ব দানকারী রাজবাড়ী জেলা বিএনপির সভাপতি সাবেক এমপি আলী নেওয়াজ মাহমুদ খৈয়ম বলেন, বিএনপি একটি বড় দল। এ দলে মত পার্থক্য থাকাটাই স্বাভাবিক। আমরা এক জায়গায় বসে সব ঠিক করে নেব। যারা পৃথক রয়েছে তাদের শঙ্কা ছিল আমি বুঝি তাদের বাদ দিয়ে দেব। সে শঙ্কা তো তাদের দূর হয়েছে। এখন তো পৃথক থাকার কোনো কারণ নেই। আমি সবাইকে ঐক্যবদ্ধ ভাবে কাজ করার আহ্বান জানাচ্ছি। যারা দলের কল্যাণ চায়, ভালো চায়, খালেদা জিয়াকে ভালোবাসে তাদের উচিত হবে ব্যক্তিগত স্বার্থ পরিহার করে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার। কারণ পৃথক থাকলে শত্রু পেছনে লেগে যায়। অতীতে যা হবার হয়েছে। আগামি নির্বাচনকে সামনে রেখে এখন ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সময়।