ডা. আবুল হোসেন; একজন আলোকিত মানুষ, মহৎ প্রাণের প্রতিকৃতি
- প্রকাশের সময় : ০৮:৫৩:১৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪
- / ১০২৬ জন সংবাদটি পড়েছেন
“সৃজনে তুমি মহাগরীয়ান
দীপ্ত সূর্য আকাশে
তোমার কীর্তি সুবাসে ভাসে
¯িœগ্ধ মধুর বাতাসে”
ডা. মোঃ আবুল হোসেন রাজবাড়ী সদর উপজেলার শান্ত-¯িœগ্ধ, পাখি ডাকা, ছায়াঘেরা, সবুজ এ আচ্ছাদিত ভবদিয়া গ্রামে ১৯৩০ সালের ২০ নভেম্বর জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পিতার নাম মোঃ আব্দুল করিম মোল্লা ও মাতা মোছাম্মৎ আসিরন খাতুন। তিন ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন একমাত্র ছেলে সন্তান। তাঁর পিতা ছিলেন তৎকালীন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং একজন হোমিওপ্যাথি ডাক্তার। তৎকালীন সময়ে ডা. আবুল হোসেনের পিতা স্কুল, মাদ্রাসা, শিশু সদনসহ বিভিন্ন ধরনের সেবামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য আলহাজ¦ এ করিম উচ্চ বিদ্যালয়, এবতেদায়ী মাদ্রাসা, আলহাজ¦ এ করিম শিশু সদন, পূর্ব ভবদিয়া গোরস্থান ইত্যাদি।
পিতার ডাক্তারী ও জনসেবা এই দু’টি কাজ করা দেখে ডা. আবুল হোসেনের মনেও রেখাপাত করে ও মানব সেবায় অনুপ্রাণিত করে।
ডা. আবুল হোসেন ভবদিয়া সরকারী প্রাইমারী স্কুলে পড়ালেখা শেষ করে গোয়ালন্দ মডেল হাইস্কুল বর্তমানে রাজবাড়ী সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন করেন। ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ থেকে আইএসসি পাশ করেন। এরপর তিনি ঢাকায় চলে যান মিটফোর্ড মেডিকেল স্কুলে ভর্তি হয়ে ১৯৫৫ সালে ২য় হয়ে খগঋ পাশ করেন। খগঋ পাশের পর কিছুদিন সরকারী চাকুরী করেন। এ সময় তিনি ২ বছর রাজশাহী মেডিকেল স্কুলে উবসড়হংঃৎধঃড়ৎ ড়ভ চধঃযড়ষড়মু হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৮ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজে গইইঝ কোর্সে ভর্তি হন এবং গইইঝ ডিগ্রী অর্জন করেন। কিছুদিন চোখের ও দাঁতের চিকিৎসার উপর প্রশিক্ষণ নিয়ে ১৯৬২ সালে রাজবাড়ী শহরেই কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি মূলতঃ চোখ ও দাঁতের চিকিৎসা করতেন। কিন্তু জ্ঞানপিপাসু এই মানুষের নিজ জেলায় বেশীদিন থাকা হলো না।
১৯৬৫ সালের ২২ মে তিনি উচ্চ শিক্ষার জন্য ইংল্যান্ড চলে যান। ইংল্যান্ডে শুরু হয় তাঁর কঠিন, কঠোর কষ্টের ও পরিশ্রমের জীবন। তাঁর স্ত্রী মিসেস নূরজাহান বেগমও কয়েক মাস পর ২২ অক্টোবর উচ্চ শিক্ষার জন্য লন্ডন চলে আসেন। এ সময় ডা. আবুল হোসেন স্কটল্যান্ডে জুনিয়র হাউজ অফিসার পদে চাকুরী করতেন এবং তাঁর স্ত্রী এডিনবার্গের মেয়েদের হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করতেন। ইংল্যান্ডে থাকাবস্থায় ডা. আবুল হোসেন যে সকল ডিগ্রী বা ডিপ্লোমা কোর্স সম্পন্ন করেন তার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নি¤েœ প্রদান করা হলো ঃ
১. ডি.টি.এম এন্ড এইচ লিভারপুল ইউনিভার্সিটি ১৯৬৭
২. ডি.সি.এইচ গøাসগো ইউনিভার্সিটি ১৯৬৭
৩. ডিপ্লোমা ইন ভেনেরেবেøাগী, লিভারপুল ইউনিভার্সিটি ১৯৬৭
৪. এম.আর.সি.পি রয়েল কলেজ অব ফিজিশিয়ান, লন্ডন ১৯৭২
৫. এফ.আর.সি.পি এডিন ১৯৮৮
৬. এফ.আর.সি.পি লন্ডন ১৯৯২
৭. এফ.আর.সি.পি গøাসগো ১৯৯৩ ইত্যাদি।
ইংল্যান্ডে অবস্থাকালীন সময়ে তিনি কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন সফলতার জন্য কয়েকটি পুরস্কার ও সম্মাননায় সম্মানিত হন। যেমন ঃ-
১. “করোনারি রিহ্যাবিলিট্যাশন সার্ভিস” এ সফলতার জন্য “ট্রেষ্ট রিজিওয়াল হেল্থ অথরিটি সি ডিষ্টিংশন এ্যওয়ার্ড প্রদান করেন।
২. বার্নস্লে ডিষ্ট্রিক হসপিটাল ট্রাষ্ট “অনারারি এ্যামিরিটাস কনসালট্যান্ট স্ট্যাটাস ফর লাইফ” সম্মাননা দিয়ে তাঁকে সম্মানিত করেন।
ডা. আবুল হোসেন চাকুরী জীবন থেকে অবসর গ্রহণের পর দেশে ফিরে পাসেন। তিনি বই পড়া, বই লেখা ও পেইন্টিং শেখার কাজে মনোনিবেশ করেন। এ সময় তিনি চারটি গ্রন্থ রচনা করেন। এলাকার মানুষের বই পড়ার প্রতি অনাগ্রহ দেখে তিনি হতাশ হন। এ সময় তিনি তাঁর বাবার প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নয়নের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন এবং রাজবাড়ীতে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, খেলার মাঠ, গোরস্থান, মসজিদ, ক্লাব, একাডেমীসহ বিভিন্ন ধরণের জনসেবামূলক প্রায় অর্ধশতাধিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তিনি তাঁর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ট্রাস্টি বোর্ড-এ হস্তান্তর করেন। ডা. আবুল হোসেনের প্রতিষ্ঠিত উল্লেখযোগ্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নাম নি¤েœ উল্লেখ করা হলো ঃ
১. ডা. আবুল হাসেন বিশ^বিদ্যালয় কলেজ, রাজবাড়ী।
২. মিসেস নূরজাহান হোসেন সরকারী প্রাইমারী স্কুল, রাজবাড়ী।
৩. আলহাজ¦ এম.এ করিম কুরআনিয়া হাফিজিয়া মাদ্রাসা, লালগোলা, রাজবাড়ী।
৪. আলহাজ¦ এম.এ করিম মিউজিয়াম, ভবদিয়া, রাজবাড়ী।
৫. আলহাজ¦ এম.এ করিম ট্রাস্ট, রাজবাড়ী।
৬. আসিয়া করিম পাবলিক লাইব্রেরী, ভবদিয়া, রাজবাড়ী।
৭. ভবদিয়া কমিউনিটি হসপিটাল, ভবদিয়া, রাজবাড়ী।
৮. ভবদিয়া পোস্ট অফিস, ভবদিয়া, রাজবাড়ী ইত্যাদি।
দানবীর ও আর্তমানবতার সেবায় নিয়েজিত এই মহৎপ্রাণ ব্যক্তিত্ব নিজ এলাকা ও দেশের মানুষের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা সেবায় কাজ করে যাচ্ছেন।
ঊনবিংশ শতাব্দীর ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস বিখ্যাত দানবীর যিনি দানশীলতার জন্য “দানবীর খেতাব” প্রাপ্ত হয়েছিলেন সেই হাজী মুহাম্মদ মহসীনের মতই একজন জনহিতৈষী, উদার জ্ঞানী ব্যক্তিত্ব ডা. আবুল হোসেন জনসেবা ও দানশীলতার মহৎ গুণাবলী অর্জন করে মানুষের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেছেন।
বাংলাদেশের বিখ্যাত সমাজসেবক ও দানবীর রনদাপ্রসাদ সাহা। যিনি টাঙ্গাইলে কুমুদিনী মহাবিদ্যালয়, ভারতেশ^রী হোমস, তাঁর বাবার নামে মানিকগঞ্জে দেবেন্দ্র কলেজ সহ শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবায় বহু প্রতিষ্ঠান যিনি প্রতিষ্ঠা করে মানুষের মননে সমুজ্জ্বল হয়ে আছেন। বরিশালে শিক্ষানুরাগী দানবীর অমৃত লাল দে, নরসিংদীর দানবীর আব্দুল কাদির মোল্লা, চট্টগ্রামের মৃদুল কান্তি দে, সিলেটের ড. রাগিব আলী, চুয়াডাঙ্গার এম.এস জোহা সহ প্রমূখ ক্ষণজন্মা দানবীর যেমন স্ব স্ব মহিমায় সমুজ্জল হয়ে আছেন মানুষের হৃদয়ে তেমনি মানবতাবাদী, প্রগতিশীল, দানবীর ডা. আবুল হোসেন আলোকিত মানুষ হিসাবে মহৎ প্রাণের প্রতিকৃতি নিয়ে রাজবাড়ী সহ সারা দেশে পরম শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে আছেন আপামর মানুষের অন্তরে।
আজ ৯২তম জন্মদিনের শুভক্ষণে বিন¤্রচিত্তে তাঁকে স্মরণ করছি। মহান সৃষ্টিকর্তা তাঁকে দীর্ঘায়ু দান করুন।
কবির ভাষায়-
“তুমি এসেছো মহান দানবীর
ললাটে চন্দ্র প্রভা
দান কাননে বিকশিত ফুল
বৃদ্ধি করেছো শোভা।”
লেখক পরিচিতি ঃ
শাহ্ মুজতবা রশীদ আল কামাল
সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
ডা. আবুল হোসেন কলেজ, রাজবাড়ী।