৬ বছর খাচাবন্দী শিশু শিখার প্রতি কে বাড়াবে মানবতার হাত
- প্রকাশের সময় : ০৭:৩৪:৩২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৫ নভেম্বর ২০২১
- / ১৩৬০ জন সংবাদটি পড়েছেন
জনতার আদালত অনলাইন ॥ শিশুটির বয়স মাত্র ১০ বছর। এই বয়সে বই খাতা নিয়ে স্কুলে যাওয়া, খেলার সাথীদের সাথে হৈ হুল্লোড়ে মেতে ওঠার কথা। পুতুল খেলা নিয়ে করবে ঝগড়াঝাটি। অথচ গত ছয় বছর ধরে সে খাচায় বন্দী জীবনযাপন করছে। শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী শিখাকে বাড়িতেই একটি খাচা বানিয়ে বন্দী করে রাখা হয়েছে। রাজবাড়ীর কালুখালী উপজেলার মাজবাড়ি ইউনিয়নের পূর্বফুল কাউন্নাইর গ্রামের হতদরিদ্র মদন কুমার ও চন্দনা রানীর মেয়ে শিখা। বাবা মদন কুমার পেশায় একজন সেলুন কর্মী। মা চন্দনা রানী গৃহিনী। শিখা মানুষকে কামড়াতে আসার কারণেই তাকে খাচা বানিয়ে বন্দী করে রাখা হয়েছে বলে জানায় তার পরিবার। অর্থাভাবে এখন ঠিকমতো তার চিকিৎসাও করাতে পারছে না। সন্তানের এমন দুঃসহ জীবন দেখাই যেন তাদের নিয়তি।
পারিবারিক সূত্র জানায়, মদন কুমার ও চন্দনা রানীর দুই ছেলে এক মেয়ে। বড় ছেলে সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। তারপর শিখা। সবার ছোট ছেলেটির বয়স দুই বছর। ছোটকাল থেকেই শিখা মারমুখি আচরণ করতো। মানুষ দেখলে কামড়াতে ও খামচি দিতে আসতো। একারণে প্রতিবেশি ও পরিবারের লোকজনের নিরাপত্তার কথা ভেবে তাকে চার বছর বয়স থেকে বারান্দায় একটি খাচা বানিয়ে বন্দী করে রাখা হয়। রোদ বৃষ্টি ঝড়ে ওখানেই কেটে যায় দিন রাত।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, শিখার বাবা জীবীকার তাগিদে কাজে বেরিয়ে গেছেন। বাড়িতে শিখার মা চন্দনা রানী ছিলেন। তিনি তার সাংসারিক কাজে ব্যস্ত। শিখাদের বসতঘরটি টিনের। মেঝে মাটির। বসতঘরটির বারান্দায় লাল রংয়ের প্লাস্টিকের জাল দিয়ে বানানো খাচায় বন্দী শিখা। সেখানে বসে উঁকি ঝুকি মারছে সে। কখনও কখনও খাচা থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছে।
শিখার মা শিখার মা চন্দনা রানী জানান, একটু একটু করে শিখা বড় হতে থাকে। তার শারীরিক ও মানসিক সমস্যা বাড়তে থাকে। প্রথমে কবিরাজ ও স্থানীয় ডাক্তার দেখিয়ে চিকিৎসা করিয়েছিলেন। কোনো লাভ হয়নি। মানুষ দেখলেই সে কামড়াতে ও আঁচড় দিতে আসতো। যেকারণে বারান্দায় প্লাস্টিকের বেড়া দিয়ে খাচা বানিয়ে ওকে আটকে রাখা হয়েছে। এছাড়া কীই বা করার আছে। এটা যে কত বড় যন্ত্রণা তা বোঝানোর নয়। তিনি আরও জানান, স্থানীয় ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা করানোর পর সুস্থ না হওয়ায় জমিজমা বিক্রি করে ভারতে নিয়ে গিয়েছিলেন চিকিৎসা করাতে। কিন্তু টাকার অভাবে আর চিকিৎসা করানো সম্ভব হয়নি। অবস্থারও উন্নতি হয়নি। এখন বাড়িতে রেখেই চিকিৎসা চলছে। প্রতিদিন দেড় থেকে দুশ টাকার ওষুধ কিনতে হয়। মাসে সাড়ে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা লাগে। তার স্বামী একটি সেলুনে কাজ করে সংসার চালায়। যা আয় হয় তা দিযে সংসার চালানোই দায়। বড় ছেলের পড়াশোনার খরচও আছে। মেয়ের চিকিৎসা নিয়ে তারা খুবই চিন্তিত। মেয়েটির চিকিৎসার জন্য কেউ সাহায্যের হাত বাড়ালে তার কাছে চির কৃতজ্ঞ থাকতাম।
মাঝবাড়ি ইউপি চেয়ারম্যান কাজী শরীফুল ইসলাম জানান, শিশুটির পরিবার আর্থিকভাবে অসচ্ছল। তাকে একটি ভাতার কার্ড করে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া যখন যে সহায়তা করা সম্ভব, তা তিনি করেন।
কালুখালী উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা জিল্লুর রহমান জানান, বিষয়টি সম্পর্কে তারা অবগত। মেয়েটা চলাফেরা করতে পারেনা। আমরা ভাতার একটি কার্ড করে দিয়েছি। ওকে স্বাভাবিকভাবে রাখা খুব দুষ্কর। আমরা চেয়ারম্যান, মেম্বারদের বলেছি তাদেরকে সাধ্যমতো সাহায্য সহযোগিতা করতে। যে কোনো হাসপাতালে নিয়ে গেলে আমরা সহযোগিতা করতে পারি। পরিবারটি খুবই গরীব। পারিবারিক সমস্যাও রয়েছে। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে কেউ এগিয়ে এলে পরিবারটি উপকৃত হতো।
কালুখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ইসমাইল হোসেন বলেন, শিশুটির জন্য ভাতার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আরও কোনো সাহায্য সহযোগিতা করা যায় কীনা সেটাও দেখছেন। চিকিৎসার জন্য সহযোগিতা করার সুযোগ আছে কীনা এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, চিকিৎসার সুযোগ ওভাবে আমাদের নেই। সমাজ কল্যাণ পরিষদে কিছু অনুদান আছে। সেটা অনুমোদন করানো গেলে একটা ব্যবস্থা করা যাবে।
রাজবাড়ীর সিভিল সার্জন ডা. ইব্রাহীম হোসেন টিটন বলেন, শিশুটির ব্রেইন ডেভেলপমেন্ট সেভাবে হয়নি। মানসিক সমস্যার কারণে সে মানুষকে কামড়াতে যায়। এটা পুরোপুরি ভালো হবেনা। তবে ওষুধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। রাজবাড়ীতে এ ধরনের চিকিৎসা নেই। নিউরো মেডিসিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। সেক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয় কলেজে নিয়ে চিকিৎসা করানো যেতে পারে। পরিবার থেকে উদ্যোগ নেওয়া হলে আমরা সহযোগিতা করতে পারি।