ভাতের হোটেলে কাজ করতেন মেডিকেলে চান্স পাওয়া আল আমিন
- প্রকাশের সময় : ০৯:২৩:৩৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ২২ জানুয়ারী ২০২৫
- / 53
বাবার অভাব-অনটনের সংসারে বড় হয়েছেন মো. আল আমিন হাওলাদার। আর্থিক দৈন্যতায় থমকে গেলেও থেমে যাননি তিনি। অর্থাভাবে পড়াশোনার ফাঁকে কাজ করতে হয়েছে বাবার ভাতের হোটেলে। আর্থিক দৈন্যতা ও প্রাথমিকে বৃত্তি পরীক্ষায় সুযোগ না পাওয়া আর শহরে ছাত্রাবাসে থেকে উচ্চ মাধ্যমিকে নিয়মিত ক্লাস করতে না পেরে মাঝে মাঝে কিছুটা থমকে গেলেও থেমে যাননি আল আমিন।
স্বপ্ন দেখেছেন পড়াশোনা করে বড় হওয়ার। পেছন থেকে নাড়া দেয় তাকে প্রাথমিকের বৃত্তি পরীক্ষা না দিতে পারা আর উচ্চ মাধ্যমিকে এসে অর্থাভাবে শহরের কলেজে ভর্তি হয়েও ছাত্রাবাসে থেকে পড়াশোনা করতে না পড়ার মতো ঘটনা। দৃঢ় মনোবল আর বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখা পটুয়াখালীর বাউফলের সেই আল আমিন এবার মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। অদম্য এ মেধাবী আল আমিন এবার মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছেন। হাঁটছে স্বপ্নপূরণের পথে। ভর্তি পরীক্ষায় ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন।
পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার আদাবাড়িয়া ইউনিয়নের মাধবপুর গ্রামের বাসিন্দা নিজাম হাওলাদার ও নাজমা বেগম দম্পতির সন্তান আল আমিন। চার ভাইবোনের মধ্যে আলামিন মেজো। একটি মৎস্য প্রকল্পে মাস্টার রোলে কাজ করছেন বড় ভাই এনামুল হাওলাদার। ছোট ভাই নেছারুদ্দিন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। ছোট বোন জামিলা চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী।
আল আমিন বলেন, প্রাইমারি স্কুলে থাকাকালীন পঞ্চম শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার ইচ্ছে ছিল। তখন স্কুল থেকে ১৫ জন শিক্ষার্থীকে বৃত্তি পরীক্ষার জন্য চূড়ান্ত করায় রোল নম্বরে পিছিয়ে থাকার কারণে সুযোগ হয়নি আমার। প্রাইভেট পড়ার সুযোগ না থাকায় ১০৬ নম্বর মাধবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে রোল হয় ১৮। ইচ্ছা থাকলেও বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারিনি। তখন বিষয়টি ভীষণভাবে নাড়া দেয়। সুযোগ না পাওয়ায় জীবন সম্পর্কে তেমন কিছু বুঝে না উঠলেও সিদ্ধান্ত নেই ভালোভাবে লেখাপড়া করতে হবে। একদিন বড় হতে হবে।
তিনি আরও বলেন, এরপর নিজ গ্রামের মাধবপুর নিশিকান্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ২০২২ সালে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে উচ্চ মাধ্যমিকে ভাল ফলাফলের আশায় শহরে গিয়ে বরিশাল সরকারি কলেজে ভর্তি হই। তবে সহপাঠীদের সঙ্গে ছাত্রাবাসে উঠে লেখাপড়া করা হয়নি টাকার অভাবে। শহরে থাকার ব্যবস্থা করতে না পেরে নিয়মিত ক্লাস করতে পারিনি। এতে প্রাইমারির মতো আবারও কিছুটা থমকে গেলেও থেমে যাইনি। চিন্তা ছিল বড় হয়ে বাবা-মায়ের অর্থাভাব দূর করব। এসব ভেবে গ্রামে থেকেই বছর খানেক বাবার সঙ্গে নিয়মিত হোটেলে কাজ করেছি।
মেডিকেলে চান্স পাওয়া মেধাবী এ শিক্ষার্থী বলেন, পরিবারের পুরোনো ছোট্ট একটি টিনেরচালার বসতঘর ও ভিটের জমিটুকু ছাড়া অন্য কোনো জমি নেই। বাড়িতে থেকে বাবার কাজে সহযোগিতা আর মোবাইলফোনে অনলাইনে ক্লাস করেছি। ভর্তি পরীক্ষার জন্য অনলাইনে ক্লাস করেছি। বিভিন্ন ওয়েবসাইটে ঘুরে ঘুরে পড়াশুনা করেছি। জীবনে কোনো কিছুর বায়নাও নেই আমার। আল্লাহর নিকট শুকরিয়া জানাই। অভাব অনটনে বাবার সঙ্গে কাজ করেছি এতে লজ্জার কিছু নাই। ভবিষ্যতে মেডিসিন বিভাগে পড়াশোনা করে ডাক্তার হয়ে সমাজের অসহায় লোকজনের জন্য কিছু করতে চাই। আল্লাহ যেন সহায় হয়।
আল আমিনের বাবা নিজাম হাওলাদার বলেন, মাধ্যমিকের পরে বরিশাল সরকারি কলেজে ভর্তি করা হলেও অভাবের কারণে শহরের মেসে রেখে অন্যদের মতো আল-আমিনকে নিয়মিত পড়াশুনার সুযোগ করতে পারিনি। চায়ের দোকানের সঙ্গে দেওয়া ভাতের হোটেলে কাজ করেছে সে। সমানতালে আবার পড়াশুনাও চালিয়ে গেছে। রেজাল্ট বের হওয়া দিনও দোকানে পুরি, সিঙ্গারা ও সমুচা বানিয়েছে সে। কাস্টমারের কাছে করেছে ভাত বিক্রি।
তিনি আরও বলেন, ছেলেকে মানুষ করতে চায়ের দোকান করছি। রিকশা চালাইছি। রাতে শ্রমিকের কাজ করেছি। অন্যের জমি বর্গা চাষ করছি। এখন আমার ওসব মনে নাই। ছেলে আমার বড় ডাক্তার হোক এটাই চাই।
আল আমিনের মা গৃহিণী নাজমা বেগম বলেন, আল্লাহর কাছে দোয়া করি, আল আমিন বাবায় বড় ডাক্তার হউক।
মাধবপুর নিশিকান্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জয়দেব চন্দ্র বলেন, আল-আমিন অত্যন্ত শান্ত প্রকৃতির। সে ক্লাসে পাঠদানের সময় মনোযোগী ছিল। অভাব অনটনের সংসারে জন্ম নেওয়া আল-আমিনের মধ্যে ভিন্ন একটা আকাঙ্ক্ষা লুকায়িত ছিল। যা সে এবার মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রকাশ করল। সে অনেক ভালো চিকিৎসক হয়ে চিকিৎসা সেবায় অবদান রাখবে।’
আল আমিন সম্পর্কে স্থানীয় আদাবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনজুর আলম হাওলাদার বলেন, নিজাম তার সন্তানের জন্য অনেক কষ্ট করছে। আল-আমিনও ভালো ফলাফল করে যথাস্থানে ভর্তির সুযোগ করে নিয়েছে। সে মেধাবী ও অত্যন্ত বিনয়ী স্বভাবের।