জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাড়ছে শেয়ালের আক্রমণ
- প্রকাশের সময় : ১১:৩৫:২৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪
- / ১০২৬ জন সংবাদটি পড়েছেন
সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শেয়ালের আক্রমণের বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। সন্ধ্যা-রাত, এমনকি দিনের বেলাতেও বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি পয়েন্টে জনম্মুখে শেয়াল আক্রমণ করছে, তেড়ে আসছে।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ১১ ডিসেম্বর থেকে ১৭ ডিসেম্বরের মধ্যে শেয়ালের আক্রমণের অন্তত ৫টি ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় প্রায় সাতজনের আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রে নির্দিষ্টভাবে শেয়ালে কামড়ানো রোগীর তথ্য রাখা হয় না। তবে কর্মরতরা বলছেন, এত কম সময়ের মধ্যে এতগুলো শেয়ালে কামড়ানো রোগী এর আগে কখনো পাওয়া যায়নি।
গেল কয়েকবছরে এ রকম হামলার সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসা কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত প্রধান রিজওয়ানুর রহমান। ২০০৪ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত এ চিকিৎসকের মতে, আগে কখনো এত শেয়ালের আক্রমণে আহত রোগী তিনি পাননি।
এ ধরনের ঘটনা এ মাসে সবচেয়ে বেশি। আগেও ঘটেছে, তবে খুবই কম। দুয়েক বছরে ঘটনাগুলো বাড়ছে। গত ১১ ডিসেম্বর আমবাগান পকেট গেট এলাকায় একজনকে কামড়ে ধরে রাখে শেয়াল।
এরপর ১২ ডিসেম্বর বিশমাইল এলাকায় বহিরাগত এক নারীকে কামড়ানোর ঘটনা ঘটে। গত ১৩ ডিসেম্বর রাতে টারজান পয়েন্ট এলাকায় ফার্মেসি বিভাগের ৫২তম ব্যাচের অসিন ইসলাম রিয়াকে কামড়ায় একটি শেয়াল।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে রিয়ার সহপাঠী তাসনোভা আহমেদ পুস্পিতা বলেন, ‘রাত ৮টায় টারজানে আমরা দুজন খাবার আনার জন্য কথা বলতে বলতে যাচ্ছিলাম। ঠিক সেই মুহূর্তে হঠাৎ করে পেছন থেকে একটি শেয়াল সামনে আসে। আমি দেখে চিৎকার দিয়ে মাটিতে পড়ে যাই।
শিয়ালটি রিয়ার পায়ে কামড় দিয়ে ধরে রাখে। ততক্ষণে আশপাশের মানুষ জড়ো হয়ে যায় এবং রিয়া হাত দিয়ে শেয়ালটি সরানোর চেষ্টা করে। এরপর শেয়ালটি পালিয়ে যায়। তখন আমি উঠে গিয়ে দেখি রিয়ার পা দিয়ে অনবরত রক্তক্ষরণ হতে থাকে।’
এরপর ১৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় তিনজনকে শেয়ালে কামড়ানোর ঘটনা ঘটে। এতে ভুক্তভোগীরা হলেন টারজান এলাকার দোকানি আব্দুল জব্বার, আনসার সদস্য অজয় হাওলাদার ও ভূতাত্ত্বিক বিজ্ঞান বিভাগের ৫২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার।
যে শেয়াল আক্রমণ করছে তার বিবরণ দেখে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি গোল্ডেন জ্যাকাল। এরা সাধারণত শান্ত প্রকৃতির। মানুষের কাছে খুব একটা ঘেঁষে না। তবে র্যাবিস ভাইরাসে আক্রান্ত হলে এরা আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। কুকুরের মধ্যে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এই ভাইরাস। যদি আক্রান্ত প্রাণী মানুষের রক্ত শোষণ করে, তাহলে এটি মানবদেহে ছড়িয়ে যায়।
র্যাবিস আক্রান্ত শেয়াল বেশি দিন বাঁচে না। প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান বলছেন, এ রোগে আক্রান্ত শেয়াল তিন থেকে চার দিন বাঁচে।
তবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এ মাসে প্রথম শেয়ালের আক্রমণ হয়েছে ১১ ডিসেম্বর। এরপর ১৭ ডিসেম্বরেও আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। আবার কেউ কেউ বলছেন, কাছাকাছি সময়ে একাধিক স্থানে আক্রমণ হয়েছে। সুতরাং, এখানে নিশ্চিত হওয়া যায়নি, একটি নাকি একাধিক শেয়াল আক্রমণ করছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাধারণত লাজুক প্রাণী হিসেবে পরিচিত শেয়াল। তবে দিনে দিনে এদের আবাস্থল সংকুচিত হচ্ছে এবং এরা লোকালয়ে চলে আসছে। আর কখনো কখনো মানুষদের কামড়াচ্ছে।
২০২২ সালে র্যাবিস আক্রান্ত একটি শেয়াল উদ্ধার করেছিল ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক কনজারভেশন ফাউন্ডেশন নামে একটি পরিবেশবাদী সংগঠন। এবারও তারা আক্রমণাত্মক শেয়ালটি ধরার চেষ্টা করেছে। তবে শেয়ালটিকে পরে আর পাওয়া যায়নি।
সংগঠনটির জাবি শাখার সাধারণ সম্পাদক সৈয়দা অনন্যা ফারিয়া বলেন, দুটি কারণে শেয়াল বা এ ধরনের প্রাণী আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। এক, জলাতঙ্ক আক্রান্ত হলে এবং দুই, প্রাণীটি চিন্তিত হলে। চিন্তিত থাকলে সুস্থ প্রাণীও কামড় দেওয়ার জন্য তেড়ে যায়।
তিনি বলেন, ‘যেমন প্রাণীরা বাচ্চা তোলার পর তাদের কাছাকাছি গেলে কামড়ে দেয়।’
অনন্যা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে কুকুরের মতো কমিউনিটি অ্যানিমেল বেড়েছে। ‘অপরিকল্পিত’ উন্নয়নের কারণে বনভূমি কমে গেছে। অনেক প্রাণী বাসস্থান হারিয়েছে। তাদের খাবারের অভাব দেখা দিয়েছে। যে কারণে প্রাণীদের মধ্যে আচরণে পরিবর্তন আসতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি পাখি কমে যাওয়ার প্রসঙ্গও টানেন তিনি।
অনন্যা বলেন, ‘তবে শেয়ালের আক্রমণ কেন হচ্ছে সেটি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। যেহেতু সেটি ধরা যায়নি।’
‘পরিকল্পনা ছাড়া’ একের পর এক ভবন নির্মাণের ফলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সবুজ এলাকা কমছে। গত ৯ বছরে প্রায় ৮৫ একর জায়গাজুড়ে অবকাঠামো গড়ে উঠেছে। এসব অবকাঠামো নির্মাণ করতে গিয়ে স্বাভাবিকবাবেই গাছ কাটতে হয়েছে।
২০১৫ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত স্যাটেলাইট ইমেজ ডিজিটাইজ করে দেখা গেছে, ৬৯৭.৫৬ একর জায়গার এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজায়ন ৩% ও জলাশয় ২% কমেছে। একই সময়ে অবকাঠামো বেড়েছে ৫%। ২০১৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজায়ন ছিল ৫৬%, যা ২০২৩ সালে হয়েছে ৫৩%। অর্থাৎ, ২০ একর জমির সবুজায়ন কমেছে। এছাড়া ২০১৫ সালে অবকাঠামো ছিল ৬% জায়গায়; বর্তমানে ১১% স্থানে অবকাঠামো হয়েছে। অর্থাৎ, নতুন করে ৩৪.৮৫ একর জমিতে অবকাঠামো নির্মাণ হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৮ সালে অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ১,৪৪৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকা ব্যয়ে ২৪টি স্থাপনার নির্মাণকাজ শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ পূর্ণাঙ্গ মাস্টারপ্ল্যান স্থপতি মাজহারুল ইসলামের প্রণয়ন করা। তবে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সেই মাস্টারপ্ল্যান মানা হয়নি বলে অভিযোগ আছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. জামালউদ্দিন রুনু বলেন, ‘ভবন নির্মাণ করতে গিয়ে গাছ কাটতে হয়েছে। এর ফলে ওই এলাকায় সবুজায়ন নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি সেখানকার প্রাণিকূলও ধ্বংস হয়েছে।’
এদিকে, অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় সম্প্রতি সমাজবিজ্ঞান অনুষদের পেছনের বনভূমিতে এক্সটেনশন ভবন, মীর মশাররফ হোসেন হলের সামনের বনভূমিতে স্পোর্টস কমপ্লেক্স ভবন, লাইব্রেরি সংলগ্ন জঙ্গলে নতুন লাইব্রেরি ও লেকচার থিয়েটার ভবন, স্কুল অ্যান্ড কলেজ সংলগ্ন টিচার্স কোয়ার্টার এবং টিচার্স ক্লাব সংলগ্ন জঙ্গলে গেস্ট হাউস ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। এসব স্থান মিলিয়ে আনুমানিক ৫০ একরের বেশি জায়গার গাছ-গাছালি কাটা হয়েছে।
গেল ৯ বছরে সবমিলিয়ে প্রায় ৮৫ একর এলাকার গাছ-গাছালি কেটে অবকাঠামো তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে। অন্যদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের জলাশয়ের পরিমাণ ৩৮% থেকে কমে হয়েছে ৩৬%।
প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান অবশ্য বলছেন, ‘বনভূমি কমে যাওয়ার সঙ্গে শেয়ালের আক্রমণের সরাসরি সম্পর্ক নেই। র্যাবিস আক্রান্ত হলেই কেবল শেয়াল আক্রমণ করে।’
তবে বনভূমি কমে যাওয়ায় প্রাণীকূলের ওপর বিরূপ প্রভাবের কথা বলছেন তিনি।
বন্যপ্রাণী নিয়ে ছবি তোলাসহ উদ্ধারে কাজ করেন অরিত্র সাত্তার। নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের এই শিক্ষার্থী বলেন, ‘শেয়াল আসলে এই ধরনের আক্রমণাত্মক না। টারজান এলাকায় পাঁচটি শেয়ালের দল বেশ সক্রিয়। কেন-না তাদের আবাসস্থল ধ্বংসের ফলে তারা খুব ছোট জায়গায় থাকতে বাধ্য হচ্ছে। এরমধ্যে দোকানগুলোর পেছনের একটি দল আক্রমণ করছে।’
তিনি বলেন, ‘আক্রমণের স্থান পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে হঠাৎ করে একটি অন্ধকার স্থান পার করে মানুষের কোলাহলযুক্ত স্থানে যাওয়ার ক্ষেত্রে অন্য সব শেয়াল সতর্ক থাকলেও কমবয়সী শেয়ালরা বুঝতে পারে না। তারা সীমানা তৈরির ক্ষেত্রে এবং খাদ্য আহরণে কম অভিজ্ঞ হওয়ায় জনসম্মুখে ঢুকে পড়ে। পরবর্তীতে মানুষের চোখে বেশি পড়ে এবং আস্তে আস্তে আক্রমণাত্মক হয়। অন্য শেয়ালরা তো আক্রমণাত্মক না। শেয়ালগুলো রোগাক্রান্ত কি না, সেটি প্রমাণ সাপেক্ষ। কিন্তু কোলাহলযুক্ত জায়গায় শেয়ালরা যখন থাকতে বাধ্য হবে, বিশেষ করে অল্প বয়সী শেয়ালরা, অভিজ্ঞতার অভাবে হঠাৎ করে ঢুকে পড়ে আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠাটা বাস্তবিক।’
পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জামাল উদ্দিন রুনু বলেন, শেয়ালগুলো যে রুটে বা করিডরে চলে সেখানে রাস্তা রয়েছে। সেখানে মানুষ ও গাড়ি চলাচল করে। তাদের খাদ্য সংকট হতে পারে।
তিনি আরো বলেন, ‘কয়েক বছর ধরে যে উন্নয়নকাজ চলছে মাস্টারপ্ল্যানের আওতায় না হওয়ায় এটি অপরিকল্পিত। এই উন্নয়নের অদৃশ্য অনেক ক্ষতিও রয়েছে। অনেক প্রাণী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সংকট হচ্ছে প্রাণীদের, এটি সত্য। পরিকল্পিত উন্নয়ন না হওয়ায় এ সংকট। প্রথম থেকে দাবি জানালেও প্রশাসন তোয়াক্কা করেনি। যে কারণে জীববৈচিত্র্যে নানাবিধ সমস্যা তৈরি হচ্ছে। শেয়ালের ক্ষেত্রে হতে পারে, বাকিটা গবেষণার বিষয় ‘