জলাবদ্ধতায় চূর্ণ কৃষকের স্বপ্ন
- প্রকাশের সময় : ০৮:৫৫:৫১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৪
- / ১০৪২ জন সংবাদটি পড়েছেন
কৃষকের দুঃখের আরেক নাম যেন বিস্তীর্ণ ফসলি ক্ষেতের জলাবদ্ধতা। বছরের বেশির ভাগ সময় এখানে জমে থাকে পানি। একটু বৃষ্টিতেই তলিয়ে যায় ক্ষেতের ফসল। শ্রম, ঘামে রোপণ করা ফসল যেমন নষ্ট হয় তেমনি স্বপ্ন চ‚র্ণ হয় কৃষকের। দীর্ঘ প্রায় ১০ বছর ধরে এ অবস্থা বিরাজ করছে রাজবাড়ী সদর উপজেলার মিজানপুর ইউনিয়নের গোপীনাথপুর গ্রামে। গোপীনাথপুর বাজারের পাশে প্রায় ৫০ একর জমিতে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। অপরিকল্পিতভাবে ঘর-বাড়ি নির্মাণের কারণেই এ জলাবদ্ধতা বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তারা। স্থায়ী সমাধানের জন্য তারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ^াসও দিয়েছেন তারা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রাজবাড়ী থেকে গোপীনাথপুর হয়ে সূর্যনগরের দিকে একটি রাস্তা চলে গেছে। রাস্তার সাথেই বেশ কিছু দোকানপাট। এটিকে বলে গোপীনাথপুর বাজার। এই বাজারের উত্তর দিক দিয়ে চলে গেছে আরেকটি রাস্তা। রাস্তার দুপাশে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে দুটি ফসলের ক্ষেত। এই দুটি ক্ষেতেই সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। এখনও সেখানে কোমর সমান পানি। বোঝার উপায় নেই এ দুটি ফসলের ক্ষেত। মনে হয় বড় কোনো বিল। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, রাস্তার দক্ষিণ দিকে খাল ছিল। পানি বের হওয়ার জন্য কালভার্টও ছিল। গত ১০ বছর ধরে খাল ভরাট করে বসত বাড়ি গড়ে ওঠা এবং কালভার্টের মুখ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এ জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। অনেকে দুইবার করে ধানের চারা রোপণ করেও কোনো সুফল পাননি। এভাবেই প্রতি বছর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষকরা।
সেখানেই কথা হয় গোপীনাথপুরের বাসিন্দা কুরমান মোল্লার সাথে। তিনি জানান, ২০ বছর আগে এখানে একটি কালভার্ট ছিল। তখন পানি বের হয়ে যেত। আস্তে আস্তে বাড়ি-ঘর দোকানপাট হয়েছে। কালভার্টের মুখ বন্ধ হয়ে গেছে। যেকারণে পানি বের হওয়ার জায়গা নেই। গত প্রায় ১০ বছর ধরে বিরাজ করছে এ অবস্থা। মাত্র এক ঘণ্টার বৃষ্টিতেই পানি জমে যায়। কোনো বছর আট মাসই পানি থাকে। চার মাস থাকে শুকনা। যখন শুকনা থাকে তখন আর ফসল ফলানোর মৌসুম থাকেনা। প্রতি বছরই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। কোনো কোনো বছর পানি জমে আবার শুকিয়ে যায়। কিন্তু এবার পানি শুকায়নি। এবছর তিনি ৩৩ শতাংশ জমিতে ধান আবাদ করেছিলেন। ধান গাছগুলো বড় হয়ে উঠেছিল। জলাবদ্ধতার কারণে তার সব ধান এখন পানির নীচে। আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি তার স্বপ্নও ভেঙে গেছে। জলাবদ্ধতার কারণে শুধু তিনি নন অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তার ভাই ফজলু পাঁচ পাকি জমির ধান নষ্ট হয়ে গেছে। জলাবদ্ধতার কারণে তারা এখন ফসল ফলাতে ভয় পাচ্ছেন।
একই গ্রামের বাসিন্দা হাসেম মন্ডলের স্ত্রী মাজেদা বেগম জানান, তার স্বামী একজন কৃষক। এখানে দুই পাকি জমি আছে তাদের। কিন্তু জমি থেকেও তাদের কোনো লাভ নেই। প্রতিবারই আশা নিয়ে ধান রোপণ করেন। আর পানিতে সে আশা ভেঙে যায়। এবারও ধান রোপণ করেছিলেন। পানিতে সব নষ্ট হয়ে গেছে। তার স্বামী এখন ভ্যান চালিয়ে জীবীকা নির্বাহ করেন।
জলাবদ্ধ ক্ষেতের পাশে গোপীনাথপুর বাজারে মুদি ব্যবসা করেন আব্দুল মাজেদ। বিষয়টি নিয়ে তিনি খুবই ত্যক্ত বিরক্ত। তার ১০ পাকি (২৫০ শতাংশ) জমি আছে এখানে। গত ১০ বছর ধরে তিনি স্বস্তিতে ফসল ফলাতে পারেন না। এবারও বেগুন, পটলসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি রোপণ করেছিলেন। সবই এখন পানির তলে। আব্দুল মাজেদ জানান, বিষয়টি নিয়ে অনেকের কাছে গিয়েছেন সমাধানের জন্য। কেউ এর সমাধান করেনি। একটি বা দুটি কালভার্ট করে পানি বের করে দেওয়ার ব্যবস্থা করলে আর জলাবদ্ধতা হয়না।
তারা সকলেই জলাবদ্ধতা নিরসনে একটি স্থায়ী সমাধানের দাবি জানিয়েছেন।
রাজবাড়ী সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জনি খান বলেন, পানি নিষ্কাশনের দায়িত্ব সাধারণত বিএডিসি, পানি উন্নয়ন বোর্ডের। সেখানে অপরিকল্পিতভাবে দোকানপাট ও বাড়িঘর করার কারণে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। তিনি সব দপ্তরের কর্মকর্তাদের নিয়ে সেখানে গিয়েছিলেন। আপাাতত উপজেলা প্রশাসন পানি বের করার একটা পদক্ষেপ নিয়েছে। স্থায়ী সমাধানের জন্য এলাকাটি সার্ভে করে ¯øুইসগেট অথবা কালভার্ট নির্মাণ করা হবে। বিষয়টি নিয়ে উপজেলা পরিষদের সমন্বয় সভায় আলোচনা হয়েছে। অধিক গুরুত্ব দিয়ে তারা বিষয়টি দেখছেন বলে জানান।
বিএডিসি রাজবাড়ী জোন এর সহকারী প্রকৌশলী (ক্ষুদ্রসেচ) মো. মিজানুর রহমান বলেন, বিষয়টি নিয়ে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আলোচনা হয়েছে। একটি টিম জায়গাটি পরিদর্শন করেছেন। সেখানে একটি স্থায়ী সমাধান দরকার। পানি নিষ্কাশনের জন্য যে খালগুলো ছিল তা বিভিন্নভাবে ভরাট হয়ে গেছে। অস্থায়ী সমাধানের জন্য সেখানে যে কালভার্ট ছিল সেটির মুখ খুলে দেওয়া হয়েছে। ত্রাণ ও দুর্যোগ দপ্তর থেকে দুটি ব্রিজ করে দেওয়ার কথা রয়েছে। বিএডিসির আপাতত কোনো প্রকল্প হাতে নেই। যদি সামনে কোনো প্রকল্প পাওয়া যায় তাহলে এটা অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
রাজবাড়ী সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রবিউল আলম বলেন, গোপীনাথপুর এলাকায় জলাবদ্ধতার বিষয়টি দেখতে তিনি পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। কৃষি কর্মকর্তা ও বিএডিসি কর্তৃপক্ষও বিষয়টি সম্পর্কে অবগত। অপরিকল্পিতভাবে বাড়ি ঘর ও দোকানপাট করায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। স্থায়ী সমাধানে পানি যাতে বের হয়ে যেতে পারে এজন্য দুটি কালভার্ট নির্মাণ করা দরকার। কোথায় কালভার্ট নির্মাণ করলে ভাল হয় এজন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। গত উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভায়ও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।