যৌনপল্লীর সহস্রাধিক শিশুর গন্তব্য কোথায়?
- প্রকাশের সময় : ০৭:২৩:১০ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০২২
- / 240
জনতার আদালত অনলাইন ॥ গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়ায় দেশের বৃহত্তম যৌনপল্লী। এখানে বিভিন্ন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী যৌনকর্মীর সংখ্যা হাজার দেড়েক হলেও বাস্তবে এর কয়েক গুণ বেশী। এসব যৌনকর্মীদের বিভিন্ন বয়সের শিশু সন্তান রয়েছে সহ¯্রাধিক। এ সকল শিশুরা পিতৃপরিচয় দিতে না পারায় এদের হচ্ছে না জন্মনিবন্ধন, পাচ্ছে না জাতীয় পরিচয় পত্র। এতেকরে স্বল্পসংখ্যক শিশু লেখা-পড়া শিখেও সমাজে পদে পদে বিরম্বনার শিকার হয়ে সমাজের মূল ¯্রােতে আসতে পারছে না।
জানা যায়, দৌলতদিয়া যৌনপল্লীর সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের শিক্ষিত করতে এখানে অনেক বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা কাজ করছে। তার পরও বেশীর ভাগ মেয়ে শিশুই মায়েদের পেশা গ্রহন করতে বাধ্য হচ্ছে, অপরদিকে ছেলে শিশুরা বিভিন্ন অপরাধ মূলক কাজে জড়িয়ে পড়ছে। আর যে গুটিকয়ে শিশু শিক্ষিত হচ্ছে তাদেরই বা গন্তব্য কোথায় তা কেউ জানে না।
দেশ তথ্য প্রযুক্তিতে পিছিয়ে থাকায় অতীতে দৌলতদিয়া যৌনপল্লীর শিশুরা পিতার নামের ক্ষেত্রে যে কোন একটা নাম ব্যবহার করে মোটামুটি চালিয়ে নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে তাদের তেমন বড় ধরনের কোন সমস্যাও হয়নি। কিন্তু বর্তমানে দেশ তথ্য-প্রযুক্তিতে বেশ এগিয়ে গেছে। জাতীয় পরিচয় পত্রে একজন ব্যাক্তির সঠিক তথ্য সংরক্ষনের পাশাপাশি প্রতিটি মানুষের সঠিক জন্মনিবন্ধন অনলাইনে সংরক্ষন করা হচ্ছে। এতেকরে চরম বিপাকে পড়েছে দৌলতদিয়া যৌনপল্লীর সহ¯্রাধিক শিশু ও তাদের মায়েরা।
দেশের বর্তমান আইন অনুযায়ী স্কুলে ভর্তি থেকে শুরু করে সকল ক্ষেত্রে অনলাইন জন্মনিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এছাড়া কর্মজীবনে প্রবেশের ক্ষেত্রেও জন্মনিবন্ধনসহ জাতীয় পরিচয়পত্র বাধ্যতামূলক। কিন্তু জন্মনিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয় পত্রে ডাটাবেজে পিতার পরিচয় ছাড়া কোন ভাবেই সম্ভব না। এক্ষেত্রে যৌনকর্মীদের সন্তানদের নির্দিষ্ট কোন পিতৃপরিচয় নেই। মায়েদের ইচ্ছামত তাদের পিতার নাম দেয়া হয়। তাদের নেই কোন ঠিকানা। আর ওই সব পিতা তাদেরকে সন্তান হিসেবে স্বীকৃতিও দেয় না।
দৌলতদিয়া যৌনপল্লীতে জন্ম নেয়া আলো (ছদ্ম নাম) জানান, জন্মের পর থেকে অন্য দশজনের মত আমরা বেড়ে ওঠার জন্য স্বাভাবিক পরিবেশ পাইনি। অনেক চড়াই উৎরাই উপেক্ষা করে একটু বড় হয়ে সুযোগ হয়েছিল বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা কর্মজীবী কল্যাণ সংস্থা (কেকেএস) পরিচালিত সেভ হোমে থেকে লেখা-পড়া করার। সুযোগ কাজে লাগিয়ে লেখা-পড়া করে আমি বর্তমানে একটি চাকরি করছি। কারণ তখন চেয়ারম্যান কর্তৃক নাগরিক সনদ দিলেই চাকরিতে প্রবেশ করা যেত। কিন্তু বর্তমানে চাকরি জীবনে আমি চরম সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। জাতীয় পরিচয়পত্র ও জন্মসনদের জন্য আমার পদোন্নতি আটকে আছে। এ কারণে অবিষ্যতে আমার চাকরি থাকবে কিনা তা নিয়ে সংকায় দিন কাটাচ্ছি।
আরেক কিশোরী জ্যোতি (ছদ্ম নাম) জানায়, সে ওই সোভ হোমে থেকে বর্তমানে একটি কলেছে পড়াশুনা করছে। কিন্তু সে অনেক চেষ্টা করেও তার অনলাইন জন্মনিবন্ধন সম্পন্ন করতে পারেনি। এতদিন তেমন কোন সমস্যা না হলেও বর্তমানে জন্মনিবন্ধন ছাড়া কোন কিছুই করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রতিটি ক্ষেত্রে জন্মনিবন্ধন প্রয়োজন হচ্ছে। বিদ্যমান আইনে যদি তার জন্ম নিবন্ধন না হয়, তবে তার ভবিষ্যত কি? কান্নাজড়িত কণ্ঠে সে বলে, ‘এসব ভেবে কখনো কখনো মনে হয় আমার মত মেয়েদের স্বপ্ন দেখাটাই পাপ হয়েছে। লেখা-পড়া না করে মায়ের পেশায় থাকলে হয়ত কোন কিছুরই প্রয়োজন হতো না!’
বেসরকারী উন্নয়ন স্থাংস্থা ‘কেকেএস’ পরিচালিত যৌনকর্মীদের সন্তানদের লালন-পালনে প্রতিষ্ঠিত সেভ হোমের কর্মকর্তা ফকীর আমজাদ হোসেন বলেন, ‘যৌনপল্লিতে জম্ম নেওয়া শিশুদের পিতৃ পরিচয় নামমাত্র থাকে বা মায়ের ইচ্ছে মত যে কোন একটি নাম দেয়া হয়। বর্তমানে ভোটার হতে হলে বাবা মায়ের ভোটার আইডি কার্ড ও জন্ম নিবন্ধনের ফটোকপি লাগে। কিন্তু যৌনপল্লীর শিশুরা যারা নামমাত্র বাবার নাম বসিয়ে অতীতে এ্যানালগ (ইউনিয়ন পরিষদ থেকে হাতে লেখা) জন্ম নিবন্ধন করিয়েছিল। ভোটার হওয়া বা জাতীয় পরিচয় পত্রেরর জন্য পিতার জন্ম নিবন্ধন দিতে ব্যর্থ হয়, আইন মেনে বাবার দায়িত্বও কেউ নিতে চায় না, আবার পিতা হিসেবে যে নামটি দেয়া আছে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে তার কোন হদিসই থাকে না। বর্তমানে যৌনকর্মীদের যেসব সন্তানেরা সমাজের মূল স্রোতধারায় সম্পৃক্ত হতে পেরেছে, তারা জাতীয় পরিচয়পত্র না পেরে কর্মক্ষেত্রে এবং সামাজিকভাবে বিভিন্ন সমস্যায় পড়ে চরম মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করছে। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজনে আইন সংশোধন করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য অনুরোধ করছি। তা না হলে যৌনপল্লীতে জন্ম নেয়া শত শত শিশু লেখাপড়া করেও সমাজের মূল ¯্রােতে যুক্ত হতে পারবে না।’ তিনি আরো জানান, তাদের হোমে আবাসিক থেকে যৌনকমীদের অনেক কন্যা শিশু লেখা পড়া করেছে। অনেকেই উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার শেষ পর্যায়ে। এ সমস্যা সমাধান না হলে তারা আগামীতে চরম সংকটের মধ্যে পড়বে।
গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাচন অফিসার মো. নিজাম উদ্দিন আহমেদ জানান, বর্তমান আইন অনুযায়ী কোন ব্যাক্তিকে তার পিতার জাতীয় পরিচয়পত্র ও অনলাইন জন্মনিবন্ধন ছাড়া ভোটার করা বা জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়া সম্ভব না। বিষয়টি অনুধাবন করতে পারলেও নিয়মের বাইরে আমাদের কিছুই করা থাকে না। পিতার না যথাযথ ভাবে না দিলে ইসি’র নির্দিষ্ট সপ্টওয়ারে সেটা গ্রহন করে না। এছাড়া রোহিঙ্গা সংকটের কারণে বর্তমানে জাতীয় পরিচয়পত্র একটি স্পর্শকাতর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক্ষেত্রে বিকল্প কোন পথ বের করা ছাড়া এ সমস্যা থেকে উত্তোরণের আপাতত কোন সুযোগ নেই।
গোয়ালন্দ উপজেলা সহকারী প্রোগ্রাম অফিসার (তথ্য-প্রযুক্তি) মো. নিজাম উদ্দিন জানান, বেশ কিছুদিন এই সমস্যার কারণে যৌনপল্লী এলাকার শিশুদের অনলাইন জন্মনিবন্ধন সম্পন্ন করা যায়নি। শুধু পিতাই না, অনেক ক্ষেত্রে শিশুর মা নানা কারণে নিজের সন্তানকে স্বীকৃতি দেয় না। তবে বর্তমানে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের পরামর্শে নিখোঁজ দেখিয়ে জন্মনিবন্ধন সম্পন্ন করা হচ্ছে।
গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আজিজুল হক খান মামুন এ প্রসঙ্গে বলেন, যৌনপল্লীর শিশুদের জন্মনিবন্ধনের সমস্যার মোটামুটি এক সমাধানের পথ খুঁজে বের করা হয়েছে। কিন্তু জাতীয় পরিচয়পত্রের বিষয়টি নির্বাচন কমিশনের। যৌনকর্মী মায়ের সন্তান হওয়ায় বাংলাদেশে জন্মের কারণে যদি ওই শিশু প্রাপ্তবয়ষ্ক হওয়ার পর জাতীয় পরিচয় পত্র না পায় তবে সে রাষ্ট্রিয় কোন সুযোগ-সুবিধ পাবে না। এ কারণে ওই মানুষটি সমাজের মূল ¯্রােতে যুক্ত হতেও পারবে না। বিষয়টি খুবই অমানবিক! তবে আমি বিষয় উপলগ্ধি করে যাতে তারা জাতীয় পরিচয়পত্র পায় সে লক্ষ্যে কাজ করছি। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিয়ে একটি পথ বের করার অনুরোধ জানাবে। প্রয়োজনে নির্বাচন কমিশনের সাথে কথা বলে সমস্যা সমাধান করা হবে।