পাঠ প্রতিক্রিয়া: বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী
- প্রকাশের সময় : ০৭:২৭:৫৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৫ জুন ২০২১
- / ১৭৫৫ জন সংবাদটি পড়েছেন
সৌমিত্র শীল চন্দন : মাঝে মাঝে নিজের অজান্তেই চোখ ভিজেছে জলে। কখনও হেসেছি। কখনও শিহরিত হয়ে উঠেছি। একজন মানুষ সাধারণ ছাত্র থেকে কীভাবে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছিলেন। কীভাবে একটা অজ পাড়া গাঁ থেকে রাজনীতি শুরু করে তিল তিল করে আওয়ামী লীগের মত একটি বিশাল রাজনৈতিক দল গড়ে তুলেছিলেন। তার সততা, নিষ্ঠা, মহানুভবতা, সাহস, দেশপ্রেম, রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় যে কেউ মুগ্ধ হবেনই। জেলখানা ছিল যেন তার নিজের দ্বিতীয় বাড়ি। তিনি জানতেন গ্রেপ্তার হবেন তবুও পালিয়ে যাননি। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইটি পড়ার আগে ফ্ল্যাপের লেখা পড়েই চোখে জল এসেছিল। ‘জেল থেকে বের হয়ে এবার বাড়িতে। বাবাকে দেখে খুশীতে আত্মহারা হাচু। নির্বাক তাকিয়ে শেখ কামাল। নিজের বাবাকে না দেখতে দেখতে ভুলে গেছেন যে তিনি তার বাবা। কামাল হাচিনাকে বলছেন ‘‘হাচু আপা, তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি।’
এমন অজ¯্র ঘটনা যে বইটিতে আরও আছে তা জানা ছিল না। তার স্ত্রী, পুত্র কন্যাদের প্রতি তার ভালোবসা ছিল অপরীসিম। তার বাবাকেও ভালোবাসতেন। দিনের পর দিন ভালোবাসার মানুষদের ছেড়ে থেকেছেন জেলে। ব্যক্তি মুজিবকে এতোটাই ভয় পেত শাসকগোষ্ঠি যে, অন্যায়ভাবে তাকে কারাবন্দী করে রাখা হয়েছে মাসের পর মাস। বছরের পর বছর। তবুও মাথা নোয়ান নি তিনি। তার স্ত্রী সর্বদাই তাকে সাহস জুগিয়েছেন। তার বাবাও তাকে উৎসাহ দিয়েছেন। পরিবারের প্রচ্ছন্ন সমর্থন পেয়ে তিনি আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়েছেন।
খন্ড জীবন, খন্ড রাজনীতি, খন্ড দেশ ও খন্ড আত্মজীবনী। ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতির রূপায়নের অখন্ড দলিল এ অসমাপ্ত আত্মজীবনী। একজন মানুষের রাজনৈতিক জীবনের স্রোতের গভীরে যে একটি ভূখন্ডের রাজনীতির মূল সন্ধান আমরা পেতে পারি তার এক অনন্য দৃষ্টান্ত ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’।
বইটিতে জাতির পিতার শৈশব, কৈশর, শিক্ষাজীবন, নিজ গ্রাম আর দেশবাসীকে ভালবাসার বর্ণনা রয়েছে। দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, দেশভাগ, পূর্ব বাংলার রাজনীতি, ভাষা আন্দোলন মূল উপজীব্য। শেষের দিকে রয়েছে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন ও রাজনীতি।
তার শৈশবকাল পর্যালোচনা করে পাওয়া যায়; স্কুলে ক্লাস ক্যাপ্টেন ছিলেন তিনি। ভালো ফুটবল খেলতেন। তার বাবা শেখ লুৎফর রহমানও ভালো খেলোয়াড় ছিলেন। তিনি অফিসার্স ক্লাবের সেক্রেটারী ছিলেন। তিনি ছিলেন মিশন স্কুলের ক্যাপ্টেন। দুজনের টিমের খেলা হলে মানুষ প্রাণভরে উপভোগ করতো।
১৯৪৩ সালে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময় তিনি ছাত্র। ব্যবসায়ীরা দশ টাকা মণের চাল চল্লিশ পঞ্চাশ টাকায় বিক্রি করেছে। দুর্ভিক্ষ এমন পর্যায়ে পৌছেছে পেটের দায়ে নিজের ছেলেমেয়েদের বিক্রি করতে চাইছে মানুষ। কেনার কেউ নেই। মানুষ ও কুকুর একসাথে ডাস্টবিন থেকে খাবার কাড়াকাড়ি করছে। তিনি দুর্ভিক্ষপীড়িতদের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়েন। সারাদিন কাজ করে রাতে কোনোদিন বেকার হোস্টেলে ফিরে যেতেন ক্লান্ত শরীরে। আবার কোনোদিন টেবিলে শুয়ে রাত পার করেছেন।
তার রাজনীতির শুরুর দিকের কথা। ওই সময় এমএলএ রা টাকার কাছে বিক্রি হয়ে যেতেন। বঙ্গবন্ধুসহ কয়েকজনের উপর দায়িত্ব পড়লো একজন এমএলএকে আটকানোর। তিনি যথারীতি দায়িত্ব পালন করছেন। একজন এমএলকে মুসলিম লীগ অফিসে আটকানো হলো। তিনি বারবার বাইরে যেতে চেষ্টা করেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর জন্য পারছে না। কিছু সময় পরে বললেন, আমাকে বাইরে যেতে দিন। কোনো ভয় নাই। বিরোধী দল টাকা দিতেছে, যদি কিছু টাকা নিয়ে আসতে পারি তাহলে ক্ষতি কী? ভোট আমি মুসলিম লীগের পক্ষেই দেব। বঙ্গবন্ধু আশ্চর্য হয়ে চেয়ে রইলেন তার দিকে। বৃদ্ধ লোক। সুন্দর চেহারা। লেখাপড়া কিছু জানেন। কেমন করে এই কথা বলতে পারলেন আমাদের কাছে। টাকা নেবেন একদল থেকে অন্য দলের সভ্য হতে, আবার টাকা নিয়ে ভোটও দেবেন না। কতটা অধঃপতন হতে পারে আমাদের সমাজের।
ছাত্রদের মধ্যে তিনি অসম্ভব জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। কিছুদিনের জন্য তিনি ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। যখন সংগঠনটি দুটি ভাগে বিভক্ত। দুই পক্ষের সম্মতিতেই তিনি সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
ওই সময়ে দৈনিক আজাদীই ছিল একমাত্র কাগজ। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বা তাদের দলের কোনো খবর ছাপত না। তখন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দিকে রাজী করিয়ে মিল্লাত নামে একটি খবরের কাগজ বের করেন। যার সম্পাদক ছিলেন হাশিম সাহেব। বঙ্গবন্ধু ওই কাগজ ঘুরে ঘুরে বিক্রি করতেন। অল্পদিনেই কাগজটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
বাবার প্রতি তার ভালোবাসা ছিল অবিচল। বঙ্গবন্ধু তখন বরিশালের এক সভায় শহীদ সাহেবের পাশে বসেছিলেন। বক্তৃতা করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এসময় তাঁর হাতে আসে একটি চিঠি। তাতে বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি লিখেছেন; মিয়া ভাই, আব্বার অবস্থা (বঙ্গবন্ধুর বাবা) খুবই খারাপ। দেখতে চাইলে রাতেই রওনা হতে হবে। শহীদ সাহেবের কাছে অনুমতি নিয়ে বঙ্গবন্ধু তখনই ছুটলেন। স্টিমারে যেতে যেতে বঙ্গবন্ধু ভাবছিলেন (বইয়ের ভাষায়); সকলের পিতাই সকল ছেলেকে ভালোবাসে এবং ছেলেরাও পিতাকে ভালোবাসে ভক্তি করে। কিন্তু আমার পিতার যে ¯েœহ পেয়েছি, আর আমি কত যে তাকে ভালোবাসি সে কথা প্রকাশ করতে পারব না। স্টিমার থেকে নেমে রাস্তা দিয়ে না যেয়ে সোজাসুজি চষাজমি দিয়ে হেঁটে বাড়ি পৌছালেন। দেখলেন, তার বাবার অবস্থা ভালো না। ডাক্তার আশা ছেড়ে দিয়ে বসে আছে। আমি পৌছেই ‘আব্বা’ ডাক দিতেই চোখ খুললেন। আমি বাবার বুকের উপর মাথা রেখে কেঁদে ফেললাম। বাবার যেন হঠাৎ পরিবর্তন হল। ডাক্তার বললেন, নাড়ির অবস্থা আগের চেয়ে ভালো। এরপর বাবা সুস্থ হয়ে ওঠেন।
ওই সময়ে গোপালগঞ্জ থেকে ফরিদপুর যেতে পুরো দেড় দিন লাগত। গোপালগঞ্জ থেকে জাহাজে মাদারীপুরের সিদ্ধিয়াঘাটে গিয়ে পৌছাতে রাতে। সেখানে রাতে থেকে সকালে ট্যাক্সিতে ফরিদপুর পৌছাতে হতো।
রহিম নামে গোপালগঞ্জে এক কুখ্যাত চোর ছিল। জেলে গিয়ে রহিমের সাথে দেখা হয় বঙ্গবন্ধুর। রহিম বঙ্গবন্ধুকে বলেছিল; জানেন, জীবনে ডাকাতি বা চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ি নাই। কিন্তু আপনাদের বাড়ি আমাদের পূণ্যস্থান ছিল, সেখানে হাত দিয়ে হাত জ¦লে গেছে। আপনার মায়ের কাছে ক্ষমা চাইতে পারলে বোধহয় পাপমোচন হতো।
বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীতে আছে গোয়ালন্দের কথাও। জেলে থাকাবস্থায় বঙ্গবন্ধুর শারীরিক অবস্থার অবনতি হলো। জেল কর্তৃপক্ষ গোপালগঞ্জ থেকে ঢাকা জেলে পাঠানোর ব্যবস্থা করলো। ফরিদপুর থেকে ট্রেনে গোয়ালন্দ। গোয়ালন্দ থেকে জাহাজে নারায়ণগঞ্জ। নারায়ণগঞ্জ থেকে ট্যাক্সিতে ঢাকা জেল।
অনেকদিন ধরে জেলে আছেন বঙ্গবন্ধু। তার প্রিয়তমা স্ত্রী তাকে দেখার জন্য জাহাজে করে যাচ্ছিলেন ঢাকা। ওই তিনই বঙ্গবন্ধু আসছিলেন গোপালগঞ্জে। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন; নদীতে দুটি জাহাজের দেখা হলো। কিন্তু আমাদের দেখা হলো না।
জেলের আরেকটি ঘটনা। তার জেলেমেটদের মধ্যে প্রচুর হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠতেন। একজনের বুকে বড় বড় পশম ছিল। সেই লোকটি ঘুমালেই বুকের উপর ছাড়পোকা ছেড়ে দিতেন। সবাই মিলে হেসে গড়াগড়ি যেত।
তিনি প্রথম করাচি গেছেন। করাচি দেখে বললেন; বাঙালিরা কয়জন তাদের রাজধানী দেখার সুযোগ পাবে? আমরা জন্মগ্রহণ করেছি সবুজের দেশে। যেদিকে তাকানো যায় সবুজের মেলা। মরুভূমির এই পাষাণ বালু আমাদের পছন্দ হবে কেন? প্রকৃতির সাথে মানুষের মনেরও একটা সম্বন্ধ আছে। বালুর দেশের মানুষের মন বালুর মত উড়ে বেড়ায়। আর পলিমাটির বাংলার মানুষের মন ঐ রকম নরম।
বঙ্গবন্ধুকে মানুষ কতটা ভালোবাসত আর বঙ্গবন্ধু কতটা মহানুভব ছিলেন তার একটা উদাহরণ; একজন গরীব বৃদ্ধা কয়েক ঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছেন রাস্তায় বঙ্গবন্ধু ঐ রাস্তা দিয়ে যাবেন বলে। বঙ্গবন্ধুকে দেখে তার হাত ধরে বললেন; বাবা আমার কুড়েঘরে তোমায় একটু বসতে হবে। বঙ্গবন্ধু তার হাত ধরে বৃদ্ধার বাড়ি যান। বঙ্গবন্ধুর সাথে অনেক মানুষ। বৃদ্ধা একটি পাটি বিছিয়ে বঙ্গবন্ধুকে বসিয়ে এক বাটি দুধ. একটা পান আর চার আনা পয়সা এনে বললেন, খাও আর পয়সা কটা তুমি নাও, আমার তো আর কিছুই নেই। বঙ্গবন্ধু কেঁদে ফেললেন। বঙ্গবন্ধু দুধ খেলেন। সেই পয়সার সাথে আরও কিছু টাকা বৃদ্ধার হাতে দিয়ে বললেন; তোমার দোয়াই আমার জন্য যথেষ্ঠ। বৃদ্ধা টাকা ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, গরিবের দোয়া তোমার জন্য আছে বাবা।
যুক্তফ্রন্ট প্রসঙ্গ: যুক্তফ্রন্টকে নিয়ে শুরু হলো নির্বাচনী প্রচারনা। টাকাকড়ি নেই। তবে জনমত আছে মুজিবের পক্ষে। জনগণ নিজের জমানো টাকা বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দিতে শুরু করলো। ফলাফল যুক্তফ্রন্টের নিরঙ্কুশ বিজয়। এবার মন্ত্রীত্ব নিয়ে দানা বাঁধতে শুরু করেছে যুক্তফ্রন্টের নেতা হক সাহেব ও শহীদ সাহেবের নেতা কর্মীদের মাঝে। সুযোগ খুঁজতে থাকলো মুসলিম লীগাররা। বঙ্গবন্ধু পেলেন কো- অপারেটিভ ও এগ্রিকালচার ডেভেলপমেন্ট দফতর। মুজিব একদিকে শপথ নিলেন তো অন্যদিকে আদমজী জুট মিলে বাঙালী অবাঙালীদের মধ্যে চক্রান্তের দাঙ্গা শুরু হলো। মুজিব সরাসরি সেখানে উপস্থিত হলেন, বক্তৃতা করে পরিস্থিতি শান্ত করলেন। মূলত নতুন সরকারের অক্ষমতা প্রদর্শনই ছিলো চক্রান্তকারীদের উদ্দেশ্য।
** ১৯৫৫ সালের ঘটনা পর্যন্ত বইটিতে উল্লেখ আছে। এরপরের ঘটনাগুলো আমরা অনুধাবন করতে পারি। কতটা কঠিন সময় পার করেছেন তিনি। ৬৬র ছয় দফা, ৬৯ এর গণ অভূত্থান, ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ, দেশ গঠন। বোধ হয় লেখার ফুরসত আর তিনি পাননি। তবে ভূমিকা পড়ে সত্যিই চমকিত হয়েছি। বাবার প্রতি কতটা ভালোবাসা থাকলে একজন অস্পষ্ট হয়ে যাওয়া লেখাগুলো পাঠোদ্ধার করে বইয়ে পরিণত করতে পারেন।
জয়তু জাতিক জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক জনতার আদালত. জেলা প্রতিনিধি: দৈনিক সমকাল
সাধারণ সম্পাদক : রাজবাড়ী জেলা প্রেসক্লাব