গাছপ্রেমি ওয়াহেদ সরদার ॥ প্রচন্ড শীতে সাইকেল চালিয়ে ঘুরছেন এক জেলা থেকে আরেক জেলা ॥ গাছ থেকে তুলছেন পেরেক, লোহা
- প্রকাশের সময় : ০৭:৩২:৪০ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২০
- / ১৬১৫ জন সংবাদটি পড়েছেন
জনতার আদালত অনলাইন ॥ দুই হাতে তার ফোস্কা পড়েছে। পায়ে আঘাতের চিহ্ন। তবুও ক্লান্তি নেই তার। প্রচন্ড শীতে বাইসাইকেল নিয়ে চষে বেড়াচ্ছেন দেশের বিভিন্ন জেলায়। হাটে মাঠে বাজারে যেখানে সেখানে রাত কাটাচ্ছেন বৃক্ষপ্রেমি আব্দুল ওয়াহিদ সরদার। গাছেরও প্রাণ আছে। গাছও ব্যথা পায়- এ উপলদ্ধি থেকে তিনি গাছের শরীর থেকে পেরেক, কাঁটা তার তুলে ফেলছেন। ৬০ বছর বয়সী ওয়াহিদ সরদার যশোর সদর উপজেলার চাঁচড়া ইউনিয়নের রুদ্রপুর গ্রামের মৃত গোলাম ইয়াহিয়ার ছেলে। পেশায় তিনি ছিলেন রাজমিস্ত্রী। গত দু বছর ধরে রাজমিস্ত্রীর পেশা ছেড়ে গাছের প্রাণ রক্ষাকেই নিয়েছেন ধ্যান জ্ঞান হিসেবে। এ পর্যন্ত দেশের সাতটি জেলায় ১৩শ কিলোমিটার এলাকার ২৪ হাজার গাছ থেকে ১০ মণ ৩২ কেজি পেরেক, লোহা, কাঁটা তার অপসারণ করেছেন। নিজ উদ্যোগে বৃক্ষরোপণ করে পেয়েছেন বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরষ্কারও।
সোমবার বিকেলে রাজবাড়ী শহরের শহীদ খুশী রেলওয়ে ময়দানের কাছে বিভিন্ন গাছে লোহা, পেরেক দিয়ে আটকানো ব্যানার খুলে ফেলছিলেন ওয়াহিদ সরদার। সেখানেই দাঁড় করানো ছিল একটি বাই সাইকেল। বাইসাইকেলের সামনে একটি সাইনবোর্ড। যেটিতে তার ঠিকানার সাথে ‘গাছ বাঁচলে আমরা সবাই বাঁচবো’ স্লোগানে লেখা রয়েছে গাছের শরীরে তারকাঁটা, নাইলন দড়ি, তার চরম ক্ষতিকারক। গাছ প্রকৃতির বন্ধু। গাছে তারকাঁটা মারা আইনত অপরাধ। গাছ বাঁচাতে পেরেক, তারকাঁটা অপসারণে বৃক্ষপ্রেমিক আ. ওয়াহিদ মাঠে নেমেছেন।
সাইকেলের পেছনের ক্যারিয়ার সীটে রয়েছে তার বেডিংপত্র। রডের সাথে রয়েছে শাবল, মোটা পাইপ। যেগুলি দিয়ে তিনি পেরেক তোলেন। রয়েছে একটি হেলমেটও।
এসময় কথা হয় আব্দুল ওয়াহিদ সরদারের সঙ্গে। জানালেন, ছোটবেলা থেকেই তিনি গাছ ও প্রাণীদের ভালোবাসেন। ২০০৬ সাল থেকে রাস্তার পাশে অথবা ফাঁকা জায়গায় তিনি নিজ উদ্যোগে ফলজ গাছের চারা রোপণ শুরু করেন। সেইসব গাছ অনেক বড় হয়েছে। বৃক্ষরোপণের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০১৭ সালে তিনি বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরষ্কার পেয়েছেন। ২০১৮ সালের ২৩ মে তারিখ রাতে বাড়ির কাছে একটি গাছের নিচে বসেছিলেন। তখন মশা কামড়ানোয় তিনি গাছের সাথে পিঠ চুলকান। গাছের সাথে লেগে থাকা পেরেকে তার পিঠ কেটে যায়। তখনই তিনি গাছ থেকে পেরেকটি তুলে ফেলেন। দেখেন, পেরেকের ভেতরের অংশটুকু কালো হয়ে গেছে। মরিচা ধরেছে। বিষয়টি কাউকে না বলে তিনি যশোরের তৎকালীন জেলা প্রশাসকের সঙ্গে দেখা করেন। গাছের সাথে পেরেক লাগানো গাছের জন্য ক্ষতিকর এবিষয়ে বিষদ বলার পর জেলা প্রশাসক একটি তালিকা তৈরি করতে বলেন। বনবিভাগকে সাথে নিয়ে গাছ থেকে পেরেক অপসারণের আশ^াস দেন তিনি। এরপর ১৮ কিলোমিটার এলাকার একটি তালিকা তৈরি করে জেলা প্রশাসকের কাছে জমা দেন। কিন্তু তারপর আর কিছু হয়নি। পরে বনবিভাগ, পরিবেশ বিভাগ ও জেলা পরিষদে ধর্ণা দিয়েও কোনো সাড়া না পেয়ে নিজেই গাছ থেকে পেরেক তোলার কাজে নেমে পড়েন। প্রথম দিন একটি শাবল নিয়ে যশোর ডিসি অফিসের গাছ থেকে যান পেরেক তুলতে। অনেকগুলোই তোলেন। কিন্তু বড় একটি পেরেক আর তুলতে পারেননি। ওইদিন তিনি স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তার কাছ থেকে এক হাজার টাকা নিয়ে চার ফুট লম্বা একটি জাহাজের হপস, পাইপ, শাবল কেনেন। অনেক সময় গাছের অনেক দূরেও পেরেক থাকে। যেগুলো ছোট শাবল দিয়ে তোলা যায়না। এজন্য একটি শাবলের সাথে পাইপ জুড়ে দিয়ে লম্বা করেন।
এসব নিয়ে যশোরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ঝিনাইদহ প্রবেশ করেন। সেখানেও অনেক গাছ থেকে পেরেক তোলেন। এরপর কয়েক দফায় সাতক্ষীরা, খুলনা, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া ঘুরে রাজবাড়ী জেলায় আসেন গত বৃহস্পতিবার। এসেই একটি গাছ থেকে ২২৬টি লোহা তুলেছেন। রাতে তিনি রাজবাড়ী জেলা পরিষদের সামনে একটি চায়ের দোকানে দুটি ব্রেঞ্চ জুড়ে দিয়ে ঘুমিয়ে যান। নিজের সঞ্চিত অর্থ দিয়েই সারেন পেটের আহার।
অনেক গাছেই ব্যানার, ফেস্টুন লাগানো থাকে। সেগুলো তুলতে গিয়ে কোনো সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়নি? একথার জবাবে বলেন, গাছে পেরেক, লোহা, তারকাঁটা লাগানো সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। আমি যে জেলায় যাই সে জেলার ডিসির কাছে অনুমতি নেই। তবে কুষ্টিয়ায় গিয়ে আমাকে বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়েছিল। রাজবাড়ীতেও খুব একটা সহযোগিতা পাইনি। আর সাধারণ মানুষ বাধা দিতে এলে সেটা আমি নিজেই কন্ট্রোল করতে পারি। কেউ আমাকে সহযোগিতা করুক বা না করুক আমি আমার কাজ চালিয়ে যাবো।
তিনি বলেন, বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র আবিষ্কার করেছেন গাছের প্রাণ আছে। যার প্রাণ আছে তার অনুভূতি শক্তিও আছে। গাছের শরীরে পেরেক মারলে গাছ ব্যথা পায়- এটা আমি উপলদ্ধি করি। মানুষের বৈরি আচরণের কারণে শত শত গাছ মারা যাচ্ছে। সবাই যদি এটা উপলদ্ধি করতে পারতো তাহলে বোবা প্রাণীটা কষ্ট পেতনা। গাছের পেরেক তুলতে গিয়ে অনেক সময় আহত হতে হয় তাকে। জানালেন, পেরেক ছুটে মাথায় পড়ে। একারণে হেলমেট পড়ি। ব্যানার ছুটে পায়ে পড়ে পা কেটে গিয়েছিল কয়েকবার। এতে তার মোটেই দুঃখ নেই।
তিনি বলেন, গাছের পেরেক তুলতে গিয়ে আমার তিনটি কাজ হচ্ছে। এক. শরীরের ব্যায়াম হচ্ছে। দুই. দেশ ভ্রমণ হচ্ছে। তিন. গাছগুলো রক্ষা পাচ্ছে।
দুই ছেলে এক মেয়ের বাবা আব্দুল ওয়াহেদ। সংসার নিয়ে তার কোনো চিন্তা নেই। অর্থাভাবে নিজে পড়াশোনা করতে না পারলেও ছেলে মেয়েদের শিক্ষিত করেছেন। বড় ছেলে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে ইলেক্ট্রনিক্স পেশায় নিয়োজিত। তার আয়েই চলে সংসার। ছোট ছেলে যশোর এমএম কলেজে বিএ (সম্মান) শ্রেণির ছাত্র। আর উচ্চ মাধ্যমিক পাশের পর বিয়ে দিয়েছেন মেয়েকে। জানালেন, একাজে বাড়ি থেকে কেউ বাধা দেয়না। ছেলেরা জানে বাধা দিলে আমি অসুস্থ হয়ে পড়বো। চলতি ডিসেম্বর মাসের ৪ তারিখে বাড়ি থেকে বের হয়েছি। এখনও পথে পথে ঘুরছি। কবে বাড়ি ফিরবো জানিনা। ছেলেরা মোবাইল ফোনে তার খোঁজ নেয়।
আব্দুল ওয়াহেদ সরদার বলেন, রাজবাড়ী থেকে আমি ঢাকা গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চাই। তাকে আমার কাজের কথা জানাতে চাই। সারা বাংলাদেশে আমি সৈনিক তৈরি করবো। যতদিন বেঁচে আছি গাছ রক্ষায় আমার কাজ আমি চালিয়ে যাবো।