মালয়েশিয়ার পরিবর্তে টেকনাফের বন্দীশালায়, পালিয়ে এসে দিলেন রোমহর্ষক বর্ণনা
- প্রকাশের সময় : ১২:৪৯:১১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৫
- / 45
কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্তের মানব পাচারকারী চক্র বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। চক্রটি কয়েক বছর আগের সেই ভয়াল রূপে ফিরে এসেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের কচ্ছপিয়া, বড়ডেইল ও বাঘঘোনা এলাকায় এসব পাচারকারীর বন্দিশালায় আটকা রয়েছেন অর্ধশতাধিক মানুষ। সশস্ত্র পাচারকারী চক্রের কারণে দেশের সীমান্ত এলাকা টেকনাফ হয়ে উঠেছে এখন আতংকের জনপদ।
উন্নত জীবনের লোভ দেখিয়ে অবৈধ পথে মালয়েশিয়া নেওয়ার কথা বলে টেকনাফের বন্দিশালায় আটকে মুক্তিপণ আদায় করছে চক্রটি। তাদের খপ্পরে পড়ে ঘর থেকে বের হয়েছিলেন কক্সবাজারের রামু উপজেলার দক্ষিণ মিঠাছড়ি ইউনিয়নের চরপাড়া গ্রামের ১১ যুবক। এদের মধ্যে নির্যাতনের শিকার হয়ে মঙ্গলবার রহমত উল্লাহ নামের একজন প্রাণ হারান। গতকাল বুধবার নিহত রহমত উল্লাহর দাফনকাজ শেষ হয়। অপর একজন এখনো নিখোঁজ রয়েছেন।
প্রাণ নিয়ে ফিরে আসতে পারা ৯ জন জানিয়েছেন, তাদের অপহরণ করে নির্যাতন করে মুক্তিপণ আদায়ের তথ্য। তারা জানান, যে বন্দিশালায় তাদের আটক রাখা হয়েছিল, সেখানে আরো অর্ধশতাধিক লোক বন্দী রয়েছেন।
এদিকে মঙ্গলবার টেকনাফ সীমান্তের মানবপাচারকারী চক্রের একজন উচ্চ পর্যায়ের সদস্যকে আটক করেছে ঢাকা জেলার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে পুলিশ।
বিষয়টি নিশ্চিত করে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জসিম উদ্দীন চৌধুরী জানান, মানবপাচারের ৩টি মামলার ওয়ারেন্টভুক্ত আসামী কেফায়েতুল্লাহ (৪১) কেরানীগঞ্জে আত্মগোপনে ছিলেন। তাকে আটকের পরে কক্সবাজারে নিয়ে আসা হয়েছে।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জানান, সাম্প্রতিক সময়ে টেকনাফে মানব পাচারের ঘটনা বেড়ে গেছে। শীত মৌসুমে সাগর শান্ত থাকায় পাচারকারীরা এ সময়কে পাচারের জন্য বেছে নেয়। মানবপাচারের আড়ালে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনার কথাও তিনি স্বীকার করেন।
এসব বিষয় নিয়ে পুলিশ বড়সড় অভিযান পরিচালনা করারও পরিকল্পনা নিয়েছে বলেও জানান তিনি।
পাচারকারীদের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়ে ফিরে আসা ভুক্তভোগীরা জানান, দালাল চক্রের অন্যতম সদস্য রামুর দক্ষিণ মিঠাছড়ি ইউনিয়নের চরপাড়ার বাসিন্দা জাহাঙ্গীর তাদের ১১ জনের দলকে নিয়ে যায় টেকনাফে। পথিমধ্যে ১১ জনকে এক দফায় উখিয়া উপজেলার মরিচ্যা পালং এলাকার দালাল সাগরের কাছে বিক্রি করে দেয়। দ্বিতীয় দফায় হাফেজ সাইদুর রহমান নামের অপর এক দালালের কাছেও বিক্রি করা হয় তাদের। এরপর টেকনাফের বন্দিশালায় তাদের স্থান হয়। সেখানে একটি ঘরে তাদের আটকে রেখে করা হয় নির্যাতন।
ভুক্তভোগীরা বলেন, তাদের সাথে মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার কথা বলে প্রতারণা করা হচ্ছে এটা বুঝতে পেরে সেই বন্দিশালার জানালার গ্রিল ভেঙে পালিয়ে আসেন তারা। পালাতে গিয়ে দালাল চক্রের কাছে ধরা পড়েন রহমতুল্লাহ ও নবী আলম। দালাল চক্রের পিটুনিতে গুরুতর আহত রহমতুল্লাহ মঙ্গলবার সকালে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে মারা যান। আর নবী আলম এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। তাকে ফিরিয়ে দিতে দেড় লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেছে পাচারকারীরা। এই চক্রের সদস্যদের কাছে অস্ত্র রয়েছে বলে জানান তারা।
বন্দিশালা থেকে পালিয়ে আসা ৯ জনের মধ্যে মনিরুল ইসলাম ও তারেক অভিযোগ করেন, বন্দিশালা থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে টেকনাফের মেরিন ড্রাইভ সংলগ্ন নোয়াখালী পাড়ায় আশ্রয় নেন। সেখানে এক ব্যক্তি তাদের আটকে রেখে ২ লক্ষ টাকা মুক্তিপণ আদায় করেন। গোপন সেই বন্দিশালা ও দালাল চক্রের মুক্তিপণের টাকা আদায়ের একটি ভিডিওতে দেখা যায়, দালাল জাহাঙ্গীরসহ অন্যান্যরা টাকা গুনে নিচ্ছেন। এদিকে দালাল চক্রের সদস্য জাহাঙ্গীরের সাথে গতকাল গোপনে যোগাযোগ করলে তিনি মানবপাচারকারী চক্রের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেন।
রামু উপজেলার দক্ষিণ মিঠাছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি মেম্বার আবুল কালাম বলেন, পাচারকারীদের হাতে নিহত রহমত উল্লাহসহ ওরা ১১ জনই তার গ্রামের বাসিন্দা। জনপ্রতি সাড়ে তিন লাখ টাকা করে দরদাম করে মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার কথা বলে তাদের টেকনাফ নিয়ে যাওয়া হয়। পরে তাদের বন্দিশালায় আটকিয়ে মুক্তিপণ আদায়ের জন্য নির্যাতন করতে থাকে পাচারকারীরা। অথচ মালয়েশিয়া পৌঁছার পর তাদের সাড়ে তিন লাখ টাকা করে পরিশোধের কথা ছিল।
সূত্র : কালের কণ্ঠ