বিলীন ফসলসহ কয়েকশ বিঘা জমি
রাজবাড়ীতে ২ কিলোমিটার জুড়ে চলছে পদ্মার ভাঙন
- প্রকাশের সময় : ০৬:৩৫:৪৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩
- / ১১৫৫ জন সংবাদটি পড়েছেন
৮০ বছর বয়সী অশীতিপর বৃদ্ধ জসিম উদ্দিন মোল্লা নদীর পাড় ভাঙা দেখে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন। তড়িঘরি করে নিজের জমিতে রোপণ করা ধানগাছ কাটতে শুরু করেন। তার সাথে যোগ দেন মান্নান মোল্লাও। কিছু না হলেও ধানগাছ ঘাস হিসেবে অন্ততঃ গরুকে খাওয়াতে পারবেন। সোমবার এমন দৃশ্য দেখা যায় রাজবাড়ী সদর উপজেলার মিজানপুর ইউনিয়নের চরনারায়ণপুর গ্রামে। আবারও নদী ভাঙন আতঙ্ক ঘিরে ধরেছে তাদের। তাদের চোখে মুখে হতাশা, কষ্ট, দুঃখ, উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা। গত ১৫ দিন ধরে এ ইউনিয়নের দুই কিলোমিটার জুড়ে লম্বালম্বি ভাঙন চলছে পদ্মা নদীতে।
ক্রন্দনরত কণ্ঠে জসিম উদ্দিন মোল্লা বলেন, ‘গাঙে সবকিছু ভাইঙে নিয়ে গেল। কত আশা করে ধান বুনেছিলেন। লাঙল দিয়েছি। নিরানি দিয়েছি। কত পরিশ্রম করেছি। অঘ্রাণ মাসে ধান পাকলে কাটবেন। সেই আশা শেষ হয়ে গেল। তিনি জানান, গত কয়েক বছরে নদীতে তার সব জমি ভেঙে নিয়ে গেছে। এই টুকু অবশিষ্ট ছিল। চাষবাস করে সংসার চালাতেন। এখন তাও ভেঙে যাচ্ছে নদীতে। চোখে মুখে এখন অন্ধকার দেখছেন। এই বৃদ্ধ বয়সে কোথায় যাবেন তিনি।
রাজবাড়ী সদর উপজেলার বরাট ইউনিয়নের উড়াকান্দা থেকে বড়চর বেনিনগর পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার পর্যন্ত পদ্মা নদীর ডান তীর বাঁধানো হয়েছে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, পদ্মা বড়চর বেনিনগর গ্রামের শেষ প্রান্তে যেখানে বাঁধানো শেষ হয়েছে সেখান থেকে প্রায় আড়াইশ মিটার পর্যন্ত ২০ থেকে ২৫মিটার ফাঁক রেখে চার ভাগে বালু ভর্তি জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছে। বালু ভর্তি ব্যাগ যেখানে ফেলা শেষ হয়েছে সেখান থেকে দুই কিলোমিটার জুড়ে ভাঙন চলছে। নদীতে তীব্র ¯্রােত লক্ষ্য করা গেছে। মাঝে মধ্যে বড় বড় চাপ ভেঙে পড়ছে নদীতে। বড়চর বেনিনগর ও চর নারায়ণপুর গ্রামের বাসিন্দারা আছে উদ্বেগ উৎকণ্ঠার মধ্যে।
এসময় রমজান আলী নামে এক ব্যক্তি জানান, পদ্মা নদীর পাড়ে তার পাঁচ বিঘা জমি ছিল। ওই জমি তিনি বর্গা দিয়েছিলেন। গত কয়েক দিনের ভাঙনে তার জমি বিলীন হয়ে গেছে। যেকারণে বর্গার টাকা ফেরত দিতে হয়েছে।
হালিমন বেগম জানান, তার স্বামী নেই। নদীর পাড়ে একটু খানি ছাপড়া ঘর আছে তার। যেখানে রাত কাটান পরিবারের সাথে। নদীতে ভেঙে গেলে থাকতে হবে খোলা আকাশের নীচে।
গুলজার মন্ডল জানান, এবার তিন বিঘা জমি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এখন তিনি সম্বলহীন। কিছুদই নেই তার। চাষবাস করে খেতেন। জমি না থাকায় বেকার বসে আছেন। পরিবার নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
মিজানপুর ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ড মেম্বার কোরবান আলী জানান, মিজানপুর ইউনিয়নের বড়চর বেনিনগর, মহাদেবপুর, চরনারায়ণপুর, মেছেঘাট, তালতলা, কালিতলাসহ কয়েকটি গ্রামে একযোগে ভাঙন শুরু হয়েছে। ভাঙন আশঙ্কায় রয়েছে একটি বিদ্যালয়, একটি মসজিদ, একটি ঈদগাহসহ চার শতাধিক বসত ঘর। ভাঙনরোধে এখনই ব্যবস্থা না নিলে সমূহ ক্ষতি হবে মানুষের। তিনি আরও জানান, এখন যেখানে মাঝ নদী ওইখানে বাড়ি ছিল তার। তিন তিন বার নদী ভাঙনে তাদের ৫০ বিঘা জমি বিলীন হয়েছে। এখন আর সম্বল বলতে কিছুই নেই। তিনি নদী ভাঙনে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জোর দাবি জানান।
ফজলু মন্ডল জানান, পদ্মা নদী থেকে অবাধে বালু উত্তোলনের কারণে এই ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে। তিনি চিরতরে বালু উত্তোলন বন্ধের দাবি জানান।
ঝর্ণা বেগম নামে এক গৃহবধূ জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকেরা ঠিকভাবে কাজ করেনা। ঠিকভাবে কাজ করলে নদী এভাবে ভাঙতো না।
রাজবাড়ী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল আমিন জানান, নদী ভাঙনরোধে তারা দ্রæত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। রাজবাড়ী পদ্মা নদীর ডান তীর ৫৬ কিলোমিটার। এর মধ্যে ৫০ কিলোমিটারই ভাঙন প্রবণ এলাকা। যখনই ভাঙন দেখা দেয় আর খবর পাই তখনই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে পরামর্শ করে কাজ করা হয়। বিষয়টি জানার পর আমরা ভাঙনরোধে ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এদিকে ভাঙনরোধে তরিৎ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিতে মিজানপুর ইউনিয়নের ১ নং ও ৬ নং ওয়ার্ড এলাকাবাসীর উদ্যোগে সোমবার পদ্মা নদীর পাড়ে মানববন্ধন ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসময় বক্তৃতা করেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা নজের মওলা, জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম, ইউপি মেম্বার কোরবান আলী প্রমুখ। পরে তারা জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দেন।