Dhaka ১১:০২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারী ২০২৫, ১ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
► নামজারি ও খাজনা পরিশোধ করা যাচ্ছে না ► হারিয়েছে পুরনো আইডি, তথ্য বিপাকে ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান

দেড় মাস ধরে বন্ধ ভূমিসেবা, চরম ভোগান্তিতে মানুষ

ডেস্ক নিউজ
  • প্রকাশের সময় : ১১:২২:২৯ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারী ২০২৫
  • / 21

সফটওয়্যার আপগ্রেডেশনের মাধ্যমে পাঁচটি ভূমিসেবাকে একত্র করেছে সরকার। নতুন প্রক্রিয়ায় গ্রাহকদের ভোগান্তি কমবে বলে দাবি করেছিল ভূমি মন্ত্রণালয়। কিন্তু প্রায় দেড় মাস ধরে কার্যত বন্ধ রয়েছে ভূমিসেবা কার্যক্রম। নতুন সফটওয়্যারের ধীরগতি ও গ্রাহকসেবার বিভিন্ন সুবিধা যুক্ত না থাকায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও নামজারি ও খাজনা দিতে পারছেন না ভূমি মালিকরা।

এদিকে লগইন আইডি না পাওয়ায় ভূমি ও ফ্ল্যাট ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোও নামজারি ও খাজনা দিতে পারছে না। কার্যত নতুন সফটওয়্যারের কারণে ভূমি ও ফ্ল্যাট ব্যবসায় ধস নেমেছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রকল্প পরিচালকের অদক্ষতায় পাইলট প্রজেক্ট ছাড়াই ভূমিসেবা সফটওয়্যার আপগ্রেডেশন হওয়ায় ভোগান্তি শুরু হয়েছে। এতে সরকার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে।

জানা গেছে, গত ২৬ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টা থেকে ১ ডিসেম্বর সকাল ৯টা পর্যন্ত ই-মিউটেশন সিস্টেম, ই-পরচা সিস্টেম এবং ভূমি উন্নয়ন কর সিস্টেম বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয় ভূমি মন্ত্রণালয়। ১ ডিসেম্বর থেকে এই সেবা পুনরায় চালু করা হবে বলে জানানো হয়। তবে পাঁচ দিন সেবাগুলো বন্ধ থাকার কথা বলা হলেও দেড় মাসেও পূর্ণাঙ্গ সচল হয়নি ভূমিসেবা।

এ নিয়ে অনুসন্ধানে নতুন সফটওয়্যারের নানা জটিলতার তথ্য উঠে এসেছে। জানা যায়, নতুন সফটওয়্যারে নামজারির ক্ষেত্রে ‘এসি ল্যান্ড’ নামের অপশনে চাপ দিলে এসি ল্যান্ড অফিসের আগের কর্মকর্তার আইডি প্রদর্শন করছে। অফিসগুলোর কানুনগো পদে নিয়োজিত কর্মকর্তারাও সংশ্লিষ্ট তথ্য যাচাই করতে চাইলে তা সম্ভব হচ্ছে না।

নামজারির অনলাইনভিত্তিক যেসব নতুন আবেদন করা হয়েছে, তা-ও এসব কর্মকর্তার আইডিতে ঢুকে দেখা যাচ্ছে না। ফলে আবেদনকারীর কোনো তথ্য অসম্পূর্ণ থাকলে তা পুনরায় তাঁর কাছে পাঠিয়ে দেওয়ার যে অপশন ছিল, সেটিও প্রদর্শন করছে না সার্ভারে।

ভোটার আইডি ছাড়াও অনেক সময় জন্ম নিবন্ধন দিয়ে নামজারি করা হতো ভূমি অফিসগুলোতে। কিন্তু সার্ভার জটিলতার কারণে তা এখন সম্ভব হচ্ছে না। পাশাপাশি পাসপোর্ট দিয়ে নামজারির আবেদন করা যাচ্ছে না। নতুন সফটওয়্যারের কাজের জন্য কর্মকর্তাদের ট্রেনিংয়ে ডাকা হলেও সার্ভার জটিলতার কারণে যথাযথ প্রয়োগ করা যাচ্ছে না। এমনকি ট্রেনিং কার্যক্রমের সময় প্রাকটিক্যালি দেখানোর সুযোগ হচ্ছে না কর্মকর্তাদের। সার্ভার নির্মাণের সময় আগে চালু থাকা বেশ কিছু অপশন রাখা হয়নি।

ভূমি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, নতুন সফটওয়্যারের কারণে ভিপি সম্পত্তি, কোর্ট অব ওয়ার্ডস সম্পত্তি ও খাসজমি বেহাত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাঁদের দাবি, আগে গ্রাহক নামজারির আবেদন করলে সহকারী ভূমি কর্মকর্তা সেই আবেদন নায়েবের কাছে পাঠাতেন। নায়েব সেই আবেদনের তথ্য যাচাইয়ের জন্য অফিস সহকারীকে দিতেন। অফিস সহকারী ভলিউম যাচাই করে সত্যতা পেলে তা সফটওয়্যারের মাধ্যমে সার্ভেয়ারের কাছে হস্তান্তর করতেন। সার্ভেয়ার জমিটির মালিকানা দাবির ভিপি, কোর্ট অব ওয়ার্ডস সম্পত্তি ও খাসজমি কি না তা যাচাই করে কানুনগোর কাছে হস্তান্তর করতেন। ওই নামজারি আবেদনে সরকারি স্বার্থ ব্যাহত না হলে এসি ল্যান্ড তা অনুমোদন করতেন। নতুন সফটওয়্যারের নামজারির আবেদন হলে তা নায়েবের কাছ থেকে সরাসরি এসি ল্যান্ডের হাতে চলে যাবে। ফলে সরকারি স্বার্থ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে গুলশান রাজস্ব সার্কেলের এক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, ভূমিতে সরকারি স্বার্থ দেখার দায়িত্ব সার্ভেয়ারের। কোনো ভূমিমালিক নামজারির সময় অর্পিত সম্পত্তি, কোর্ট অব ওয়ার্ডস সম্পত্তি ও খাসজমিতে অংশীদারির জন্য আবেদন করলে তা সরেজমিন তদন্ত করে বাতিল করে দেন সার্ভেয়ার। নতুন সফটওয়্যারে সার্ভেয়ারের মতামতের কোনো অপশন রাখা হয়নি। ফলে এসব সম্পত্তি বেহাত হতে পারে। একই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন মিরপুর, মুন্সীগঞ্জ, ডেমরা, কেরানীগঞ্জ ও বরিশালের কয়েকজন কর্মকর্তা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে মোহাম্মদপুর রাজস্ব সার্কেলের এক কর্মকর্তা বলেন, ভূমি সহকারী কর্মকর্তারা যে প্রস্তাবনা দেন, তা সার্ভেয়ার অথবা কানুনগোর আইডিতে প্রদর্শন করছে না। এ ধরনের অপশন না রাখার কারণে আবেদনকারীর আবেদন যাচাই করা সম্ভব হচ্ছে না। নামজারির আবেদনকারী হয়তো জরুরি প্রয়োজনে জমি বিক্রির জন্য আবেদন করেন, কোনো কাগজ বাদ পড়লে তা পুনরায় সংশোধনের পদ্ধতিও রাখা হয়নি। ফলে তিনি জমি বিক্রি করতে পারছেন না। আবেদনকারীর আবেদন সার্ভার থেকে কানুনগোর কাছে প্রেরণের যে অপশন আগে সার্ভারে ছিল, তা-ও এখন রাখা হয়নি। ফলে আবেদন যাচাই কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। সরকারি ভূমি কর্মকর্তা প্রস্তাবনা দেওয়ার পর সরকারের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো যেভাবে খতিয়ে দেখা হতো, এখন তা দেখা সম্ভব হচ্ছে না।

সার্ভার জটিলতাজনিত এসব কারণে সরকারি খাসজমি বেহাত হওয়ার আশঙ্কা করেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে ওই কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, আগে ভূমি সহকারী কর্মকর্তা প্রস্তাব দিলে সেই প্রস্তাব সার্ভেয়ার ও কানুনগো যাচাই করতেন। নতুন সফটওয়্যারে সার্ভেয়ার ও কানুনগোর যাচাইয়ের অপশন রাখা হয়নি। সে ক্ষেত্রে এসি ল্যান্ডের একার পক্ষে প্রতিটি বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাই সম্ভব হবে না। তাই সরকারি সম্পত্তি বেহাত হওয়ার ঝুঁকি থেকেই যায়।

বিষয়টি নিয়ে রাজধানীর তেজগাঁও রাজস্ব সার্কেলে একটি আবাসন কম্পানির কর্মকর্তা আমিরুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ভূমিসেবা সফটওয়্যার আপগ্রেডেশনের পর প্রায় দেড় মাস অতিক্রান্ত হলেও আমরা এখনো লগইন আইডি পাইনি। ফলে নামজারি ও খাজনা দিতে পারছি না। কম্পানির ব্যাবসায়িক কার্যক্রম থমকে পড়েছে।’

তিনি বলেন, পুরনো সফটওয়্যারে থাকা আইডি পাসওয়ার্ডও কোনো কাজে আসছে না। পুরনো আইডিতে থাকা কয়েক শ গ্রাহকের সম্পূর্ণ তথ্য মুছে গেছে। যাদের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে সেখানে নামজারির তথ্যে প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে প্রতিনিধির নাম দেখাচ্ছে। সহকারী ভূমি কর্মকর্তারাও কোনো সমাধান দিতে পারছেন না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই এসি ল্যান্ড অফিসের এক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, নতুন সফটওয়্যারের কারণে ভূমি অফিসগুলোতে একটা ‘হ য ব র ল’ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ঢাকায় তালিকাভুক্ত ও অতালিকাভুক্ত অসংখ্য আবাসন কম্পানি রয়েছে। পাশাপাশি পুরো বাংলাদেশে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা নামজারি ও খাজনা দিতে না পারার কারণে নতুন ফ্ল্যাট বিক্রি করতে পারছে না। পাশাপাশি ব্যাংক ঋণও পাচ্ছে না কেউ কেউ।

তিনি বলেন, নতুন সফটওয়্যার চালুর আগে কোনো পাইলট প্রজেক্ট নেওয়া হয়নি। পাশাপাশি ভূমি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি। এর মধ্যে সফটওয়্যার জটিলতা ও ধীরগতির কারণে কাজ করা যাচ্ছে না। ভুক্তভোগী হচ্ছেন গ্রাহকরা। অসম্পূর্ণ সফটওয়্যার চালুর মাধ্যমে নতুন সরকারের সুনাম নষ্টের অপপ্রচেষ্টা হচ্ছে কি না তা যাচাই করে দেখা উচিত।

রাজধানীর মিরপুরের সহকারী ভূমি রাজস্ব কর্মকর্তার কার্যালয়ে গিয়েও একই চিত্র দেখা যায়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই অফিসের এক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, সার্ভারে ঢুকতে চাইলে লোডিং অপশন ওপেন হয়ে থাকে। কোনো কোনো কাজে শুধু সার্ভার ওপেন হতেই ঘণ্টাখানেক সময় লাগছে।

দেখা যায়, মিরপুর ভূমি অফিসে নিয়োজিত এক কর্মকর্তা তাঁর নিজ আইডিতে ঢুকতে চাইলে তিনি ঢুকতে ব্যর্থ হন। সারা দিনে পাঁচ থেকে সাতটি খাজনা নেওয়া যাচ্ছে। কোনো কোনো ভূমি অফিসে খাজনা দেওয়া গেলেও সার্ভার জটিলতার কারণে খাজনা নিতে পারছে না।

ভোগান্তির কারণ জানতে চাইলে ভূমি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ও ভূমি ব্যবস্থাপনা অটোমেশন প্রকল্পের পরিচালক মো. ইফতেখার হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এই ভোগান্তি অনেকটাই নিরসন হয়েছে। ভূমি মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব কোনো সার্ভার নেই, এই সার্ভার নেওয়া হয় আইসিটি মন্ত্রণালয় থেকে। আইসিটি ডিভিশনের সার্ভারের স্পিড কম হলে সেটি তারা দেখবে। আমরা তাদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ করছি, তারা যা বলছে এর বাইরে আমাদের কোনো বক্তব্য নেই। এই সার্ভার পরিচালনায় ধীরগতি কেন তা বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (বিসিসি) বলতে পারবে।’

ভূমি মন্ত্রণালয়ের অনুমোদিত তিন হাজার ৪৬৮টি অফিস আছে। এর বাইরে কিছু টেম্পোরারি ক্যাম্প ছিল, সেখানে কিছু ডেটা এন্ট্রি রেগুলারাইজ করা হয়নি। এ কারণে কিছু সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এসব অফিসে নিয়োজিতদের স্থায়ীভাবে পদায়ন করা হলে সমস্যার অনেকটা সমাধান হবে।

তিনি বলেন, ‘ভূমি মন্ত্রণালয় যদি এগুলো নিয়মিত করে দেয়, তাহলে সমস্যা অনেকটাই সমাধান হয়ে যায়। এসব পদ সৃষ্টি করার কোনো ক্ষমতা প্রজেক্ট অফিসের নেই। এটি সম্পূর্ণরূপে ভূমি মন্ত্রণালয় দেখে। আমরা যত দূর জেনেছি ভূমি মন্ত্রণালয় এ বিষয়গুলো নিয়ে মিটিং করেছে, ভোগান্তি নিরসনে জেলা প্রশাসকসহ চেষ্টা করছে। এর বাইরে অন্য কোনো চেষ্টা করার সুযোগ আমাদের হাতে নেই।’

ভূমিসেবা সফটওয়্যারের জটিলতাসংক্রান্ত বিষয়ে জানতে ঢাকার জেলা প্রশাসক তানভীর আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কোনো সাড়া মেলেনি।

সূত্র: কালের কণ্ঠ।

Tag :

সংবাদটি আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন-

► নামজারি ও খাজনা পরিশোধ করা যাচ্ছে না ► হারিয়েছে পুরনো আইডি, তথ্য বিপাকে ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান

দেড় মাস ধরে বন্ধ ভূমিসেবা, চরম ভোগান্তিতে মানুষ

প্রকাশের সময় : ১১:২২:২৯ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারী ২০২৫

সফটওয়্যার আপগ্রেডেশনের মাধ্যমে পাঁচটি ভূমিসেবাকে একত্র করেছে সরকার। নতুন প্রক্রিয়ায় গ্রাহকদের ভোগান্তি কমবে বলে দাবি করেছিল ভূমি মন্ত্রণালয়। কিন্তু প্রায় দেড় মাস ধরে কার্যত বন্ধ রয়েছে ভূমিসেবা কার্যক্রম। নতুন সফটওয়্যারের ধীরগতি ও গ্রাহকসেবার বিভিন্ন সুবিধা যুক্ত না থাকায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও নামজারি ও খাজনা দিতে পারছেন না ভূমি মালিকরা।

এদিকে লগইন আইডি না পাওয়ায় ভূমি ও ফ্ল্যাট ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোও নামজারি ও খাজনা দিতে পারছে না। কার্যত নতুন সফটওয়্যারের কারণে ভূমি ও ফ্ল্যাট ব্যবসায় ধস নেমেছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রকল্প পরিচালকের অদক্ষতায় পাইলট প্রজেক্ট ছাড়াই ভূমিসেবা সফটওয়্যার আপগ্রেডেশন হওয়ায় ভোগান্তি শুরু হয়েছে। এতে সরকার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে।

জানা গেছে, গত ২৬ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টা থেকে ১ ডিসেম্বর সকাল ৯টা পর্যন্ত ই-মিউটেশন সিস্টেম, ই-পরচা সিস্টেম এবং ভূমি উন্নয়ন কর সিস্টেম বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয় ভূমি মন্ত্রণালয়। ১ ডিসেম্বর থেকে এই সেবা পুনরায় চালু করা হবে বলে জানানো হয়। তবে পাঁচ দিন সেবাগুলো বন্ধ থাকার কথা বলা হলেও দেড় মাসেও পূর্ণাঙ্গ সচল হয়নি ভূমিসেবা।

এ নিয়ে অনুসন্ধানে নতুন সফটওয়্যারের নানা জটিলতার তথ্য উঠে এসেছে। জানা যায়, নতুন সফটওয়্যারে নামজারির ক্ষেত্রে ‘এসি ল্যান্ড’ নামের অপশনে চাপ দিলে এসি ল্যান্ড অফিসের আগের কর্মকর্তার আইডি প্রদর্শন করছে। অফিসগুলোর কানুনগো পদে নিয়োজিত কর্মকর্তারাও সংশ্লিষ্ট তথ্য যাচাই করতে চাইলে তা সম্ভব হচ্ছে না।

নামজারির অনলাইনভিত্তিক যেসব নতুন আবেদন করা হয়েছে, তা-ও এসব কর্মকর্তার আইডিতে ঢুকে দেখা যাচ্ছে না। ফলে আবেদনকারীর কোনো তথ্য অসম্পূর্ণ থাকলে তা পুনরায় তাঁর কাছে পাঠিয়ে দেওয়ার যে অপশন ছিল, সেটিও প্রদর্শন করছে না সার্ভারে।

ভোটার আইডি ছাড়াও অনেক সময় জন্ম নিবন্ধন দিয়ে নামজারি করা হতো ভূমি অফিসগুলোতে। কিন্তু সার্ভার জটিলতার কারণে তা এখন সম্ভব হচ্ছে না। পাশাপাশি পাসপোর্ট দিয়ে নামজারির আবেদন করা যাচ্ছে না। নতুন সফটওয়্যারের কাজের জন্য কর্মকর্তাদের ট্রেনিংয়ে ডাকা হলেও সার্ভার জটিলতার কারণে যথাযথ প্রয়োগ করা যাচ্ছে না। এমনকি ট্রেনিং কার্যক্রমের সময় প্রাকটিক্যালি দেখানোর সুযোগ হচ্ছে না কর্মকর্তাদের। সার্ভার নির্মাণের সময় আগে চালু থাকা বেশ কিছু অপশন রাখা হয়নি।

ভূমি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, নতুন সফটওয়্যারের কারণে ভিপি সম্পত্তি, কোর্ট অব ওয়ার্ডস সম্পত্তি ও খাসজমি বেহাত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাঁদের দাবি, আগে গ্রাহক নামজারির আবেদন করলে সহকারী ভূমি কর্মকর্তা সেই আবেদন নায়েবের কাছে পাঠাতেন। নায়েব সেই আবেদনের তথ্য যাচাইয়ের জন্য অফিস সহকারীকে দিতেন। অফিস সহকারী ভলিউম যাচাই করে সত্যতা পেলে তা সফটওয়্যারের মাধ্যমে সার্ভেয়ারের কাছে হস্তান্তর করতেন। সার্ভেয়ার জমিটির মালিকানা দাবির ভিপি, কোর্ট অব ওয়ার্ডস সম্পত্তি ও খাসজমি কি না তা যাচাই করে কানুনগোর কাছে হস্তান্তর করতেন। ওই নামজারি আবেদনে সরকারি স্বার্থ ব্যাহত না হলে এসি ল্যান্ড তা অনুমোদন করতেন। নতুন সফটওয়্যারের নামজারির আবেদন হলে তা নায়েবের কাছ থেকে সরাসরি এসি ল্যান্ডের হাতে চলে যাবে। ফলে সরকারি স্বার্থ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে গুলশান রাজস্ব সার্কেলের এক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, ভূমিতে সরকারি স্বার্থ দেখার দায়িত্ব সার্ভেয়ারের। কোনো ভূমিমালিক নামজারির সময় অর্পিত সম্পত্তি, কোর্ট অব ওয়ার্ডস সম্পত্তি ও খাসজমিতে অংশীদারির জন্য আবেদন করলে তা সরেজমিন তদন্ত করে বাতিল করে দেন সার্ভেয়ার। নতুন সফটওয়্যারে সার্ভেয়ারের মতামতের কোনো অপশন রাখা হয়নি। ফলে এসব সম্পত্তি বেহাত হতে পারে। একই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন মিরপুর, মুন্সীগঞ্জ, ডেমরা, কেরানীগঞ্জ ও বরিশালের কয়েকজন কর্মকর্তা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে মোহাম্মদপুর রাজস্ব সার্কেলের এক কর্মকর্তা বলেন, ভূমি সহকারী কর্মকর্তারা যে প্রস্তাবনা দেন, তা সার্ভেয়ার অথবা কানুনগোর আইডিতে প্রদর্শন করছে না। এ ধরনের অপশন না রাখার কারণে আবেদনকারীর আবেদন যাচাই করা সম্ভব হচ্ছে না। নামজারির আবেদনকারী হয়তো জরুরি প্রয়োজনে জমি বিক্রির জন্য আবেদন করেন, কোনো কাগজ বাদ পড়লে তা পুনরায় সংশোধনের পদ্ধতিও রাখা হয়নি। ফলে তিনি জমি বিক্রি করতে পারছেন না। আবেদনকারীর আবেদন সার্ভার থেকে কানুনগোর কাছে প্রেরণের যে অপশন আগে সার্ভারে ছিল, তা-ও এখন রাখা হয়নি। ফলে আবেদন যাচাই কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। সরকারি ভূমি কর্মকর্তা প্রস্তাবনা দেওয়ার পর সরকারের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো যেভাবে খতিয়ে দেখা হতো, এখন তা দেখা সম্ভব হচ্ছে না।

সার্ভার জটিলতাজনিত এসব কারণে সরকারি খাসজমি বেহাত হওয়ার আশঙ্কা করেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে ওই কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, আগে ভূমি সহকারী কর্মকর্তা প্রস্তাব দিলে সেই প্রস্তাব সার্ভেয়ার ও কানুনগো যাচাই করতেন। নতুন সফটওয়্যারে সার্ভেয়ার ও কানুনগোর যাচাইয়ের অপশন রাখা হয়নি। সে ক্ষেত্রে এসি ল্যান্ডের একার পক্ষে প্রতিটি বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাই সম্ভব হবে না। তাই সরকারি সম্পত্তি বেহাত হওয়ার ঝুঁকি থেকেই যায়।

বিষয়টি নিয়ে রাজধানীর তেজগাঁও রাজস্ব সার্কেলে একটি আবাসন কম্পানির কর্মকর্তা আমিরুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ভূমিসেবা সফটওয়্যার আপগ্রেডেশনের পর প্রায় দেড় মাস অতিক্রান্ত হলেও আমরা এখনো লগইন আইডি পাইনি। ফলে নামজারি ও খাজনা দিতে পারছি না। কম্পানির ব্যাবসায়িক কার্যক্রম থমকে পড়েছে।’

তিনি বলেন, পুরনো সফটওয়্যারে থাকা আইডি পাসওয়ার্ডও কোনো কাজে আসছে না। পুরনো আইডিতে থাকা কয়েক শ গ্রাহকের সম্পূর্ণ তথ্য মুছে গেছে। যাদের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে সেখানে নামজারির তথ্যে প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে প্রতিনিধির নাম দেখাচ্ছে। সহকারী ভূমি কর্মকর্তারাও কোনো সমাধান দিতে পারছেন না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই এসি ল্যান্ড অফিসের এক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, নতুন সফটওয়্যারের কারণে ভূমি অফিসগুলোতে একটা ‘হ য ব র ল’ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ঢাকায় তালিকাভুক্ত ও অতালিকাভুক্ত অসংখ্য আবাসন কম্পানি রয়েছে। পাশাপাশি পুরো বাংলাদেশে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা নামজারি ও খাজনা দিতে না পারার কারণে নতুন ফ্ল্যাট বিক্রি করতে পারছে না। পাশাপাশি ব্যাংক ঋণও পাচ্ছে না কেউ কেউ।

তিনি বলেন, নতুন সফটওয়্যার চালুর আগে কোনো পাইলট প্রজেক্ট নেওয়া হয়নি। পাশাপাশি ভূমি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি। এর মধ্যে সফটওয়্যার জটিলতা ও ধীরগতির কারণে কাজ করা যাচ্ছে না। ভুক্তভোগী হচ্ছেন গ্রাহকরা। অসম্পূর্ণ সফটওয়্যার চালুর মাধ্যমে নতুন সরকারের সুনাম নষ্টের অপপ্রচেষ্টা হচ্ছে কি না তা যাচাই করে দেখা উচিত।

রাজধানীর মিরপুরের সহকারী ভূমি রাজস্ব কর্মকর্তার কার্যালয়ে গিয়েও একই চিত্র দেখা যায়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই অফিসের এক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, সার্ভারে ঢুকতে চাইলে লোডিং অপশন ওপেন হয়ে থাকে। কোনো কোনো কাজে শুধু সার্ভার ওপেন হতেই ঘণ্টাখানেক সময় লাগছে।

দেখা যায়, মিরপুর ভূমি অফিসে নিয়োজিত এক কর্মকর্তা তাঁর নিজ আইডিতে ঢুকতে চাইলে তিনি ঢুকতে ব্যর্থ হন। সারা দিনে পাঁচ থেকে সাতটি খাজনা নেওয়া যাচ্ছে। কোনো কোনো ভূমি অফিসে খাজনা দেওয়া গেলেও সার্ভার জটিলতার কারণে খাজনা নিতে পারছে না।

ভোগান্তির কারণ জানতে চাইলে ভূমি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ও ভূমি ব্যবস্থাপনা অটোমেশন প্রকল্পের পরিচালক মো. ইফতেখার হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এই ভোগান্তি অনেকটাই নিরসন হয়েছে। ভূমি মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব কোনো সার্ভার নেই, এই সার্ভার নেওয়া হয় আইসিটি মন্ত্রণালয় থেকে। আইসিটি ডিভিশনের সার্ভারের স্পিড কম হলে সেটি তারা দেখবে। আমরা তাদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ করছি, তারা যা বলছে এর বাইরে আমাদের কোনো বক্তব্য নেই। এই সার্ভার পরিচালনায় ধীরগতি কেন তা বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (বিসিসি) বলতে পারবে।’

ভূমি মন্ত্রণালয়ের অনুমোদিত তিন হাজার ৪৬৮টি অফিস আছে। এর বাইরে কিছু টেম্পোরারি ক্যাম্প ছিল, সেখানে কিছু ডেটা এন্ট্রি রেগুলারাইজ করা হয়নি। এ কারণে কিছু সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এসব অফিসে নিয়োজিতদের স্থায়ীভাবে পদায়ন করা হলে সমস্যার অনেকটা সমাধান হবে।

তিনি বলেন, ‘ভূমি মন্ত্রণালয় যদি এগুলো নিয়মিত করে দেয়, তাহলে সমস্যা অনেকটাই সমাধান হয়ে যায়। এসব পদ সৃষ্টি করার কোনো ক্ষমতা প্রজেক্ট অফিসের নেই। এটি সম্পূর্ণরূপে ভূমি মন্ত্রণালয় দেখে। আমরা যত দূর জেনেছি ভূমি মন্ত্রণালয় এ বিষয়গুলো নিয়ে মিটিং করেছে, ভোগান্তি নিরসনে জেলা প্রশাসকসহ চেষ্টা করছে। এর বাইরে অন্য কোনো চেষ্টা করার সুযোগ আমাদের হাতে নেই।’

ভূমিসেবা সফটওয়্যারের জটিলতাসংক্রান্ত বিষয়ে জানতে ঢাকার জেলা প্রশাসক তানভীর আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কোনো সাড়া মেলেনি।

সূত্র: কালের কণ্ঠ।