‘পাথরের গুণে জেল থেকে বেরিয়ে আসবে তোর ভাই’
সম্মোহিত করে সর্বস্ব লুটে নিচ্ছে প্রতারক চক্র
- প্রকাশের সময় : ০৮:৪৪:১৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৯ অক্টোবর ২০২২
- / ১২২৯ জন সংবাদটি পড়েছেন
\ পাথরের গুণে জেল থেকে বের হয়ে আসবে তোর ভাই।- এভাবে কথার জালে ভুলিয়ে সম্মোহিত করে নাসিমা বেগম এক নারীর কাছ থেকে স্বর্ণের কানের দুল নিয়ে গেছে একটি প্রতারক চক্র। মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকে রাজবাড়ী আদালত চত্ত¡রে এ ঘটনা ঘটে। ঘটনার আকস্মকিতায় তিনি হতভম্ব হরয়ে পড়েন। নাসিমা বেগম রাজবাড়ী সদর উপজেলার পাঁচুরিয়া ইউনিয়নের কোনাইল গ্রামের হানিফ মোল্লার স্ত্রী। মানুষকে সম্মোহিত করে গত কয়েকদিনে বেশ কয়েকজনের কাছ থেকে টাকা পয়সা, স্বর্ণালংকার, দামী মোবাইল সেট হাতিয়ে নিয়েছে প্রতারক চক্রটি। স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বলছেন, কোকোলামিন জাতীয় পদার্থ দিয়ে এসব করছে প্রতারক চক্র। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানিয়েছে, তারা প্রতারক চক্রকে ধরার চেষ্টা করছেন।
দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে রাজবাড়ী আদালত চত্ত¡রে গিয়ে দেখা যায়, নাসিমা বেগম নামের ওই নারী তার এক স্বজনের সাথে রয়েছেন। কান্নাকাটি করছেন। ঘটনাস্থলে ছিলেন রাজবাড়ী ডিবি ওসি প্রাণবন্ধু চন্দ্র বিশ^াস।
ঘটনার বিবরণ দিয়ে ভুক্তভোগী নাসিমা বেগম জানান, তার ছোট ভাই মো. বাবু একটি মামলায় দেড় মাস ধরে রাজবাড়ী কারাগারে বন্দি। বাবুর ছয় বছরের ছেলে নাইম তার কাছেই ছিল। সোমবার নাইমের মা আদালতের মাধ্যমে নাইমকে তার কাছ থেকে নিয়ে যায়। বিষয়টি নিয়ে মঙ্গলবার আদালতে শুনানী হওয়ার কথা ছিল। একারণে তিনি রাজবাড়ী কোর্টে আসেন। দুপুর ১২টার দিকে একজন মাঝ বয়সী ও একজন অল্প বয়সী লোক তার কাছে এসে জানতে চায় কোর্টে কেন এসেছি। তিনি সবকিছু খুলে বলেন। মাঝবয়সী লোকটি বলে আমি এমন একটি কাজ করে দেব তোর ভাই তিনদিনের মধ্যে বেরিয়ে আসবে। কারো কাছে কিছু বলা যাবে না। আমি একটা পাথর পড়া দেব। এই পাথরের গুণে তোর ভাই বেরিয়ে আসবে। ১০টা টাকা দে। তোকে পড়ে দেই। আমি ১০টাকা দেই। ওরা টাকায় ফু দিয়ে আমাকে বলে আঁচলে বেঁেধ রাখ। ওরা বলে, তোর কাছে আর কয় টাকা আছে। আমি বলি ৫০ টাকা আছে। বয়ষ্ক লোকটা বলে, তোর কাছে আর কী আছে। আমি বলি, কানের দুল আছে। এরপর লোক দুটো আমাকে আদালত চত্ত¡রের বাইরে নিয়ে যায়। অল্প বয়সী ছেলেটি আমার দিকে ফু দেয়। অন্যজন আমার কানের দুল খুলে নেয়। সেখানে আর কোনো লোক ছিল না। আমার তখন কিছু বলার মত শক্তি নেই। এরপর ওরা আমাকে বলে, সামনে চার খাম্বার মাঝখানে একটি পাথর আছে। ওই পাথরটা নিয়ে আয়। ওটাতেই তোর ভাইয়ের মুক্তি হবে। যাওয়ার সময় ডানে বায়ে তাকাবি না। তাদের কথামত ডানে বাঁয়ে না তাকিয়ে আমি চার খাম্বার (পৌর মার্কেটের সামনে) কাছে গিয়ে খোঁজাখুজি করে কিছু না পেয়ে ফিরে আসি। এসে দেখি লোক দুটি নেই। তখন আমি চিৎকার দেই। আমার বোধ শক্তি কাজ করে।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত রাজবাড়ীর ডিবি ওসি প্রাণবন্ধু চন্দ্র বিশ^াস বলেন, একটি চক্র শহরে বেশ কিছুদিন ধরে এভাবে মানুষের কাছ থোেক প্রতারণার মাধ্যমে সবকিছু কেড়ে নিচ্ছে। তারা বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছেন। প্রতারক চক্রকে ধরার চেষ্টা চলছে। তিনি মানুষকে সচেতন হওয়ার আহŸান জানান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজবাড়ীতে এ ধরণের বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। কিছুৃদিন আগে প্রিয়া নামে এক কলেজছাত্রীর কাছ থেকে একইভাবে স্বর্ণালংকার, মোবাইল ফোন ও নগদ টাকা ছিনিয়ে নেয় দুর্বৃত্তরা। শহরের বিন্দোপুরের বাসিন্দা প্রিয়া জানান, সপ্তাহ খানেক আগে বিকেল ৫টার দিকে রাজবাড়ী বাজারে বিকাশ থেকে টাকা তুলে হেঁটে বাসায় যাচ্ছিলেন। রেলগেট এলাকায় পৌঁছালে ২৫ বছর বয়সী এক যুবক তার মায়ের অসুস্থতার কথা বলে আর্থিক সাহায্য চায়। ওই সময় আরও এক যুবক সেখানে হাজির হয়ে তাকে সাহায্য করতে বলে। তিনি তাদের এড়িয়ে চলে যাওয়ার সময় একজন তার নাকে সামনে একটি রুমাল ধরে। এরপর তিনি বোধশক্তি হারিয়ে ফেলেন। যুবকরা তাদের সঙ্গে যেতে বলে। তাকে হাঁটিয়ে রেলগেট থেকে দুইশ মিটার দূরে রাজবাড়ী জেলা স্কুলের কাছে নিয়ে যায়। এরপর তার ব্যাগ খুলে নগদ টাকা, মোবাইল ফোন হাতে থাকা স্বর্ণের আংটি ও গলার চেইন খুলে নেয়। তিনি সবই দেখছেন। কিন্তু কথা বলার মত শক্তি ছিল না। যুবকরা সবকিছু নিয়ে নেওয়ার পর বলে, আপনি ফিরে সোজা হেঁটে চলে যান। তিনিও হাঁটতে হাঁটতে চলে আসেন। কিছুদূর আসার পর তার সম্বিৎ ফিরে আসে। তখন সবকিছু বুঝতে পারেন। কিন্তু ততক্ষণে প্রতারকরা পালিয়ে গেছে।
এ প্রসঙ্গে রাজবাড়ীর পুলিশ সুপার এমএম শাকিলুজ্জামান বলেন, এই চক্রটি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এর আগেও আমরা চক্রের কয়েকজনকে ধরেছিলাম। মানুষকে সচেতন হতে হবে। মামলা হয়েছে। আমরা বিষযটি দেখব। পার পাবে না। কিন্তু মুশকিলটা হচ্ছে আমরা ধরব। আইনানুযায়ী তারা চলে আসবে। বিচার হতে সময় লাগবে। সাধারণ মানুষকে সচেতন হতে হবে। অচেনা মানুষ দেখলেই তার কাছে যাওয়া যাবে না। ইতিপূর্বে এ ধরণের দুটি অভিযোগ হয়েছিল। মালামাল উদ্ধার হয়েছিল বলে জানান তিনি।
রাজবাড়ীর সিভিল সার্জন ডা. ইব্রাহীম টিটন জানান, ধারণা করা হচ্ছে কোকোলামিন নামে পদার্থ প্রতারক চক্র ব্যবহার করে এটা করছে। এই পদার্থ শ^াস প্রশ^াসের মাধ্যমে মানুষের ভেতরে পৌছে দিলে বোধ শক্তি কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে ফেলে। কিন্তু এটা বাইরে সচরাচর পাওয়া যায় না। প্রতারকদের হাত থেকে বাঁচতে মানুষকে সচেতন হতে হবে।