‘সংস্কৃতির রাজধানী’র ৫৫ বছরে পদার্পণ
- প্রকাশের সময় : ০৮:৪৫:৪২ অপরাহ্ন, রবিবার, ১২ জানুয়ারী ২০২৫
- / 25
১২ জানুয়ারি, যখন শীতের কুয়াশায় ক্যাম্পাসের গাছপালা এক নতুন রূপে সাজে, তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় উদযাপন করে তার প্রতিষ্ঠার ৫৫ বছর। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মেলবন্ধন, যেখানে সবার চোখে ধরা পড়ে এক ঐতিহাসিক যাত্রা, সেই যাত্রা আজকে আরো এক ধাপ এগিয়ে গেল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭০০ একর ক্যাম্পাস, যা আজও তার সবুজে ভরা শোভায় ভাসে, তাতে সমাহিত হয়েছে সেই স্নিগ্ধ আবহাওয়া, যা দেশ-বিদেশের শিক্ষার্থীদের হৃদয়ে এক অদ্ভুত প্রশান্তি নিয়ে আসে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং ঐতিহ্যের এক দুর্লভ মিলনস্থল। ক্যাম্পাসের প্রতিটি কোণে প্রতিধ্বনিত হয় কল্পনাময় সৌন্দর্যের গন্ধ—ছাতিম গাছের সুবাস, কৃষ্ণচূড়া ফুলের লাল রঙ, লোটাসের ঝিলের কোমলতা, আর পাখির কিচিরমিচির। এই সব কিছু মিলিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় তার শিক্ষার্থীদের এক শান্তিপূর্ণ পরিবেশ প্রদান করে, যেখানে তারা শুধুমাত্র পাঠের মাঝেই নিজেদের এক গভীর অন্তর্দৃষ্টি খুঁজে পায় না, বরং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যেও অজানা অনেক কিছু শিখে।
১৯৬৪ সালে পাকিস্তান সরকারের পরিকল্পনায় স্থাপিত হতে চলেছিল একটি পূর্ণ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়, যা রাজধানী ঢাকা থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে গাজীপুরের সালনা এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত, ১৯৬৭ সালে সাভারের পশ্চিমে, ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাশে নতুন জায়গায় এটি প্রতিষ্ঠা পায়। ১৯৭১ সালের ১২ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়টি উদ্বোধন করা হয় এবং প্রতিষ্ঠা লাভ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথমদিকে ছিল মাত্র ৪টি বিভাগ, ২১ জন শিক্ষক এবং ১৫০ জন ছাত্র। কিন্তু আজ এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৪টি বিভাগ, ৬টি অনুষদ এবং প্রায় ১৫,০০০ শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত। দিন দিন এর অবকাঠামো, শিক্ষার মান এবং সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হয়েছে, যা দেশ-বিদেশে প্রশংসিত।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৫ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আজ, ১২ জানুয়ারি, আয়োজিত ছিল নানা ধরনের উৎসবমুখর অনুষ্ঠান। সকাল ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর মো. কামরুল আহসান জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও বেলুন উড়িয়ে অনুষ্ঠানটির উদ্বোধন করেন। এর পর একটি শোভাযাত্রা বের হয়, যা ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ থেকে শুরু হয়ে মুক্তামঞ্চে শেষ হয়। দিনব্যাপী নানা ধরনের সাংস্কৃতিক, ক্রীড়া ও শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে, যার মধ্যে ছিল রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা ক্যাম্পেইন, প্রাক্তন এবং বর্তমান শিক্ষার্থীদের মধ্যে ফুটবল এবং হ্যান্ডবল ম্যাচ, চিত্রকলা প্রদর্শনী, পিঠা উৎসব এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
সাংস্কৃতিক রাজধানী খ্যাত এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সেলিম আল-দীন মুক্তামঞ্চ’ আজও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও নাটকের মাধ্যমে জীবন্ত থাকে। প্রকৃতিঘেরা এ ক্যাম্পাসে প্রতিটি দিন নতুন কিছু শিখতে ও অনুভব করতে শেখায়। ছাত্ররা একত্রিত হয় কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ, ক্যাফেটেরিয়া এবং অন্যান্য জায়গায়, যেখানে তারা সংস্কৃতি, রাজনীতি বিষয়ক বিভিন্ন আড্ডায় মাতোয়ারা থাকে হরহামেশাই।
এ প্রসঙ্গে, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী সামিরাহ জামান বলেন, “৭০০ একর হয়তো ছোট পরিসর নয়, কিন্তু এই সীমানার মধ্যে জাবি যেভাবে নিজস্ব একটি সংস্কৃতি ধরে রেখেছে, তা অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় জাবিকে মৌলিকতায় অনন্য করেছে।”
তিনি আরও বলেন, “জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় নারীর স্বাধীনতা ও ক্ষমতায়নের একটি সুস্থ চর্চার উদাহরণ। এখানে দৈনন্দিন চলাচল ও কাজের ক্ষেত্রে নারীরা পূর্ণ স্বাধীনতা উপভোগ করে।”
এত কিছুর পাশাপাশি, বিশ্ববিদ্যালয়টি তার গর্বের সাবেক শিক্ষার্থীদের জন্যও পরিচিত। সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, রাজনীতি, এবং ক্রীড়াক্ষেত্রে এর অনেক প্রাক্তন শিক্ষার্থী বাংলাদেশের প্রধান স্তম্ভ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। বিখ্যাত কবি সৈয়দ আলী আহসান, অধ্যাপক মুস্তাফা নুরুল ইসলাম, লেখক হুমায়ূন আজাদ, নাট্যকার সেলিম আল দীন, কবি মোহাম্মদ রফিক, অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমান, রসায়নবিদ অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবির, ইতিহাসবিদ একেএম শাহনেওয়াজ, ক্রিকেটার মুশফিকুর রহিম সহ খেলাধুলা, সংস্কৃতি এবং শিল্পক্ষেত্রে অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা লাভ করেছেন। তাদের সাফল্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যকে আরও ঊর্ধ্বে নিয়ে গেছে।
তবে ৫৫ বছরের পথচলা অবশ্যই নিখুঁত ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রগতির সাথে সাথে কিছু সমস্যা এবং সমালোচনাও রয়েছে। যেমন, পরিবেশগত সমস্যা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলগুলোর অবস্থা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান অভ্যন্তরীণ বেশ কিছু উন্নয়ন প্রকল্পে গাছপালা কেটে ফেলার কারণে ক্যাম্পাস পরিবেশগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে দাবি আছে পরিবেশকর্মীদের। ১ম বর্ষের শিক্ষার্থী রাচি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পর ক্যাম্পাসে নিরাপদ সড়ক ও ফুটপাতের এবং পর্যাপ্ত সড়ক নিরাপত্তার দাবি করছেন শিক্ষার্থীরা ।
প্রকৃতির সাথে মিতালীতে সংস্কৃতির রাজধানী খ্যাত এ বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে চলেছে তার নিজস্ব ধারায়। অর্জন আর চ্যালেঞ্জের সহযাত্রী হয়ে এই প্রতিষ্ঠান ছুটে চলবে নতুন ভোরের দিকে, যেখানে শিক্ষা, সংস্কৃতি, আর প্রকৃতি মিলে সৃষ্টি করবে আরও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ এমনটাই প্রত্যাশা শিক্ষার্থীদের।