অর্থকষ্টে জেলেরা, সাধারণ মানুষ বঞ্চিত মাছের স্বাদ থেকে
হারিয়ে যাচ্ছে দেশিয় প্রজাতির মাছ
- প্রকাশের সময় : ০৫:৩৩:৩৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৩ জানুয়ারী ২০২৫
- / 22
রাজবাড়ী সদর উপজেলার মিজানপুর ইউনিয়নের চর নারায়ণপুর গ্রামের বাসিন্দা নারায়ণ হালদার (৫৬) দীর্ঘ ৪০ বছর পদ্মা নদীতে মাছ ধরে জীবীকা নির্বাহ করেন। আগে জালের টানেই উঠে আসতো ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ। বাজারে বিক্রি করে খুশী মনে বাড়ি ফিরতেন। গত কয়েক বছর যাবৎ জালে তেমন মাছ উঠছে না। পরিবার পরিজন নিয়ে অর্থকষ্টে চলে তাদের জীবন।
দেশি প্রজাতির মাছ কমে যাওয়ায় নারায়ণ হালদারের মত অন্য জেলেদের দুর্দশা যেমন বেড়েছে তেমনি সাধারণ মানুষ মাছের স্বাদ থেকে বঞ্চিতই হচ্ছে এক প্রকার। ‘মাছে ভাতে বাঙালি’ এই প্রবাদ এখন আর সঙ্গতিপূর্ণ মনে হয়না। ইতিমধ্যে অন্ততঃ তিনটি প্রজাতির মাছ একেবারে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বিলুপ্তির পথে রয়েছে আরও পাঁচ প্রজাতির মাছ। মৎস্য কর্মকর্তারা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে মানুষকে সচেতন এবং মাছের অভয়াশ্রম গড়ে তোলার পরামর্শ দিলেন তারা।
রাজবাড়ী জেলা পদ্মা নদী বেষ্টিত। চন্দনা, গড়াই, হড়াই, চত্রা, কুমার নদী ছাড়াও অসংখ্য খাল, বিল রয়েছে। এসব নদী, খাল, বিলে পাওয়া যেত মাগুর, শিং, পাবদা, পুঁটি, মলা, ঢেলা, চেলা, শোল, বোয়াল, আইড়, ভ্যাদা, ফলি, কাগচি, চিংড়ি, গজার, চেং, টাকি, চিতল, পোয়া, বালিয়া, গুতম, পুতুল বা রানী, গজার, চ্যাপিলা, বৈচা, চাঁদা, আইড়, পাবদা, দেশি পুঁটি, সরপুঁটি, তিত পুঁটি, চিতল, ডানকিনা, খয়রা, রিটা, পিয়ালি, খৈলশা, ছোট টেংরা, বড় টেংরা, কালবাউশ, বাঘাইর, ভাঙ্গরা, বাতাশি, বড় বাইন, তারা বাইন, শালবাইন, বাইন, খরকুটি, পটকা, বেলেসহ নাম না জানা অনেক প্রজাতির দেশি মাছ। এসব মাছের স্বাদও ছিল অতুলনীয়। সময়ের আবর্তনে দেশি প্রজাতির এসব মাছ হারিয়ে যেতে বসেছে। এখন আর বাজারে গেলে মেলেনা মনের মত মাছ।
রাজবাড়ী সদর উপজেলার উড়াকান্দা এলাকার বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব জামাল সরদার ছোটখাটো ব্যবসা করেন। মাছ তার খুব প্রিয়। জানালেন, আগে বাজারে গিয়ে ব্যাগ ভরে মাছ কিনতেন। মাছ দিয়ে মনের মত করে ঝোল, তরকারি, পাতুরিসহ কত তরকারি খেয়েছেন। এখন আর বাজারে মনের মত মাছ পাওয়া যায়না। মাছ কিনতে বাজার ঘুরতে ঘুরতে জীবন শেষ। রুই, কাতলা, নৌসি, বাটা মাছ সচরাচর মেলে। অন্য মাছ মাঝে মধ্যে পাওয়া যায়। তবে, দাম খুব বেশি। স্বাদও তেমন নেই। টেংরা মাছ পাওয়া গেলেও আটশ টাকা কেজি। এত টাকা দামের মাছ খাওয়ার সাধ্য কয়জনের আছে।
রাজবাড়ী বাজারের মাছ বিক্রেতা নিরঞ্জন সরকার জানান, তিনি ৪৬ বছর ধরে মাছের ব্যবসা করেন। আগে প্রচুর মাছ কিনতেন। সহজে সেসব বিক্রিও হয়ে যেত। এখন মাছ পাওয়া কঠিন হয়ে গেছে। যা পান ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করা কঠিন। দাম বেশি দেখে অনেকেই চলে যান। আর অনেক প্রজাতির মাছ এখন আর দেখা যায়না। টেংরা, পুটি, বাইন, শিং, চিংড়ি ইত্যাদি মাছ পাওয়া যায়। তিনি জানালেন, নদীর পানি এখন কোল দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করেনা। যেকারণে খালে বিলে পানিও জমেনা। একারণে মাছ পাওয়া যায় কম।
সদর উপজেলার চরনারায়ণপুর গ্রামের বাসিন্দা কান্ত হালদার জানান, ২০ বছর বয়স থেকে তিনি নদীতে মাছ ধরেন। আগে মাছ ধরে আড়তে বিক্রি করতেন। যা পেতেন তা দিয়ে সংসার ভালোভাবে চলে যেত। এখন নদীতে জাল ফেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকেও মাছ পাননা। যেটুকু পান তা হাটে-বাজারে বসে বিক্রি করেন। মাছ বিক্রির টাকা দিয়ে সংসার আর চলেনা। বিভিন্ন সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে তাদের চলতে হয়।
রাজবাড়ী জেলা মৎস্য অফিসের তথ্য মতে, জেলায় নদী, বিল, প্লাবনভ‚মি, পুকুর, বারোপিট, বাওর রয়েছে মোট ৩৬ হাজার ৮৩৯ হেক্টর। এসব পানিতে ২৭ হাজার দুইশ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন হয় প্রতি বছর।
রাজবাড়ী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. নাজমুল হুদার তথ্য মতে, রাজবাড়ী জেলায় ৫৯ প্রজাতির মাছ ছিল। তিনটি প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সেগুলো হলো ভেদা, ভেলা ও কাউনে। এছাড়া গুলসা, পুতুল, মলাসহ পাঁচ প্রজাতির মাছ বিলুপ্তির পথে রয়েছে।
দেশিয় প্রজাতির মাছ হারিয়ে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তীব্র খড়া যেমন সমস্যা, অতি আহরণে জলাশয় শুকিয়ে যাচ্ছে। কৃষিতে উপর্যুপরি মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহার হচ্ছে। এর ফলে বায়োলজিক্যাল কিছু বিষয় বদলে যাচ্ছে। নদীগুলোও ধীরে ধীরে মরে যাচ্ছে। খাল, বিল, জলাশয় থাকছে না। নির্বিচারে পুকুর ভরাট হয়ে যাচ্ছে। নানা রকমের প্রেক্ষাপটের কারণেই এসব হচ্ছে।
এর থেকে পরিত্রাণ পেতে আমাদের অভয়াশ্রম তৈরি করতে হবে। যেখানে নদীর প্রাচুর্যতা বেশি। নদীর খারিতি কোল বা যে সমস্ত বিলের মধ্যে সুযোগ থাকলে অভয়াশ্রম করতে হবে। মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। ইতিমধ্যে জেলা মৎস্য অফিসের উদ্যোগে প্রত্যেকটা উজেলায় অভয়াশ্রম করা হচ্ছে। মানুষের মধ্যে প্রচার প্রচারণা চালানো হচ্ছে।