Dhaka ০১:০৫ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ০৮ জানুয়ারী ২০২৫, ২৪ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ফারুক আহম্মেদ জীবন-এর গল্প ‘মুক্তিযুদ্ধ’

জনতার আদালত অনলাইন
  • প্রকাশের সময় : ০২:২৪:০৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ৬ জানুয়ারী ২০২৫
  • / 16

ছবি : সংগৃহীত

সময়টা-১৯৭১ সাল…
গভীর নিস্তব্ধ ঘুটঘুটে এক ভুতুড়ে রাত। পূর্ব বাংলার বিভিন্ন জায়গায় তুমুল মুক্তিযুদ্ধ চলছে বাঙালীদের সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের খান সৈনা
-দের। চারিদিকে শুধু মুহুর্মুহু গোলাবারুদের শব্দ। গ্রামের পর গ্রাম ঐসব খান সৈন্যরা পূর্ব বাংলার বাঙালীদের বসত-ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে। দাউ –দাউ করে শুধু আগুন জ্বলছে চতুর্দিক। যেখানে সেখানে পঁচা-গলা লাশের স্তুপ। নদী, সাগর, খাল-বিলের জলে ভাসছে কতো-যে বাঙালীদের লাশ তার কোনো ইয়াত্ত্বা নেই। চারিদিকে নারী শিশুদের চিৎকার আর আহাজারির শব্দ। পাকিস্থানিদের
এমন বর্বতা দেখে আঠারো বছর বয়সের তাগড়া জোয়ান কিরণ। সে তার মা জ্যোতি কে-এসে বললো মা-গো….ঐসব পাকিস্তানি খানেদের এমন
পৈশাচিকতা আর মেনে নেওয়া যায় না..।
এবার আমি যুদ্ধে যাবো মাগো
স্বাধীন করব এদেশ,
এদেশের যতো মা শত্রু আছে
করব তাদের শেষ।
আমার জন্মভূমিকে মুক্ত করতে
প্রাণটা গেলে যাক,
ডেকো না আর তুমি পিছু মাগো
ঐ এসেছে যুদ্ধের ডাক।
দু,নয়নের জল মুছিয়া মাগো
দাও এবার বিদায়,
যুদ্ধের সাজে এবার আমায় মা
দাও তুমি সাজায়।
এই জন্মভূমিকে স্বাধীন করেই
ফিরবো তম কোলে,
মরিলে ভেবো তুমি দেশের জন্য
শহীদ হয়েছে ছেলে।
বলবে যেদিন মাগো প্রতি-জনে
তুমি বীরের মাতা,
বীর সন্তানের কথা শুনে সেদিন
ভুলো মনের সব ব্যথা।
বেঁচে থাকলে তোমার ছেলে যে
আনবে ছিনিয়ে বিজয়,
মনটাকে তাই তুমি শক্ত করে মা
দূর করো মনের ভয়।
ছেলের মুখে এসব কথা শুনে। মা- জ্যোতি কাঁদতে কাঁদতে সে তার আশীর্বাদের হাত ছেলে কিরণের মাথায় রেখে যুদ্ধের জন্য বিদায় দিলো। কিরণ তখন গিয়ে মুক্তি বাহিনীতে নাম লিখালো।তারপর গেরিলা ট্রেনিং নিয়ে এসে খান সৈন্যদের সাথে যুদ্ধ করতে লাগলো। এমনি এক ভয়াবহ যুদ্ধের
রাতে অন্য একটি ছেলে। পনেরো বছরের কিশোর দুর্জয়। একটা অপারেশন শেষে কিছুক্ষণ আগে তার এক বন্ধুর ভাঙ্গাচুরা ঘরে এসে ক্লান্ত শরীরে আশ্রয় নিয়েছে। সে কাঁধ থেকে তার হাতের অস্ত্রটা রেখে কেবল দু,চোখ এক করার একটু চেষ্টা করছিল। তার বন্ধুর ঘরটি একেবারে গাঁয়ের বাড় কোণে। চারিদিকে বাঁশঝাড় গাছ-গাছালি আর লতা পাতায় ভরা। কেবল একটু তন্দ্রা ভাব এসেছে দুর্জয়ের। হঠাৎ জানালার ওপাশ থেকে কে যেনো ফিসফিস করে ডাকছে দুর্জয়কে। এই দুর্জয়…দুর্জয়…এই দুর্জয়? দুর্জয়ের কানে সে শব্দ আসতেই হতচকিয়ে শোয়া থেকে ওঠে পড়লো। দ্রুত সে পাশে রাখা মেশিনগান হাতে তুলে নিলো। আবারো সেই ডাক। দুর্জয় কান দুটি খাড়া করে কন্ঠটা বুঝার চেষ্টা করলো। সে ফিসফিস করে ডাকছে…দুর্জয় এই…এই দুজয়… তাড়াতাড়ি
ওঠ, মিলিটারি ঢুকেছে এই গ্রামে। দুর্জয় বুঝতে পারলো এ কন্ঠ তার সহযোদ্ধা বিনয়ের। দুর্জয় দ্রুত দরজা খুলে মেশিনগান হাতে বাইরে চলে এলো। বিনয় এখনো হাঁপাচ্ছে। দুর্জয়কে বেরিয়ে
আসতে দেখেই বিনয় হাঁফাতে হাঁফাতে বললো..
দুর্জয় দ্রুত আমাদের এখান থেকে সরে যেতে হবে
কুইক ফাস্ট। হঠাৎ অনতিদূরে একটা গুলির শব্দ! দুর্জয় বুঝতে পারলো শব্দটা গাঁয়ের পশ্চিম দিকে হয়েছে। ওরা দুই বন্ধু গাঁয়ের দক্ষিণ দিকে
দ্রুত রওয়ানা হলো। রাতের আঁধার ভেদ করে একটা অসহায় মায়ের কান্নার কন্ঠ ওদের কানে
ভেসে এলো। বলছে….আমার একটা ছেলেকে তো তোমরা মেরেছ। আমার স্বামীটাকেও তোমরা মেরে ফেলেছ। দোহাই লাগে তোমাদের। আমার মেয়েটাকে তোমরা ছেড়ে দাও। খান সৈন্যদের মধ্যে একটা খান… অট্টহাসি দিয়ে বলছে…ছেড়ে দেবো…হুম? তারপর…হু…হু…হু…হা…হা…হা..করে হাসতে লাগলো। তারপর বললো ছালি ছেলেকে মুক্তিফৌজে নাম লিখাইছো.? আমাগো ছাত যুদ্ধ
করবে…? আমাগো কতল করবে? দেচ স্বাধীন করবে হুম..বলেই বুটের লাথি মারলো সেই মাকে।
তারপর আবারো একটা গুলির শব্দ। ঐ মহিলার চৌদ্দ পনেরো বছরের কিশোরী মেয়ে পূর্ণীমা। মা বলে চিৎকার করে উঠলো। দুর্জয় বুঝতে পারলো ঐ পাষণ্ডরা মেয়েটির মাকেও মেরে ফেলেছে।রক্ত
টগবগ করে ফুটছে দুর্জয়ের দেহে।রাগে দুটি চোখ
দিয়ে যেনো আগুন চটকাচ্ছে দুর্জয়ের। ক্রোধে
দুর্জয়ের সারাটা গায়ে যেনো একটা ঝাঁকি দিয়ে
উঠলো।মেয়েটিকে ধরে টানাহেঁচড়া করতে করতে ওরা ওদের ক্যাম্পের দিকে নিয়ে যেতে লাগলো। দ্রুত পজিশন নেওয়ার চেষ্টা করলো দুর্জয়। বিনয় কাঁধে হাত দিয়ে বাঁধা দিলো।
তারপর আস্তে আস্তে বললো..এখনি না দুর্জয়।
ওরা সংখ্যায় অনেক।তাছাড়া ওদের কাছে অনেক
অস্ত্র গোলা-বারুদ রয়েছে। আমরা মাত্র দুইজন।
ওদের সাথে পেরে উঠবো না। দুর্জয় এ কথা শুনে
একটু রেগে মেশিনগানটা নিচু করলো। তারপর বললো..এখন বেশি কালক্ষেপণ করলে মেয়েটির
সর্বনাশ হয়ে যাবে। বিনয় বললো…ওরা ক্যাম্পে পৌঁছানো মাত্রই আমরা অপারেশন-টা চালাবো।সে সময় দশ-বারো বছর মতো বয়স হবে নাম
রবি। সে দৌড়াতে.. দৌড়াতে এসে বললো…বিনয় দাদা..ও দুর্জয়..দাদা…কিরণ ভাইয়ের বোন পূর্ণীমা
আপুকে মিলিটারিরা তুলে নিয়ে গেছে ওদের ক্যাম্পে। আর কিরণ ভাইয়ের ছোট ভাই গগন আর ওর মা- বাবাকে মেরে ফেলেছে মিলিটারিরা।
ছোট্ট রবি মুক্তিযোদ্ধাদের হয়ে দেশের জন্য কাজ করে। বিনয়, দুর্জয় রবিকে বললো.রবি তাড়াতাড়ি
যাও আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সংবাদ দাও।রবি ও, ওর জীবন বাজি রেখে সংবাদ পৌঁছে দিলো মুক্তিফৌজ এর কমান্ডারের মনসুরের কাছে। সেখানে কিরণও ছিলো। ওর মা-বাবা ভাইকে মেরে ফেলেছে সব শুনে কিরণ কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।কমান্ডার কিরণের কাঁধে হাত রেখে বললো..কিরণ শান্ত হও। জানি তোমাকে শান্তনা দেওয়ার ভাষা আমার নেই। এই দেশ, এই মা-মাটির জন্য তুমি পরিবার পরিজন মা-বাবা, ভাই সবকিছু হারায়েছ। তবু, তোমাকে মনে রাখতে হবে তুমি একজন মুক্তিযোদ্ধা।তোমাকে আরো শক্ত হতে হবে কিরণ। চোখের জল মুছে ফেলো কিরণ।অস্ত্র হাতে তুলে নাও।তোমার বোনকে ঐসব নর-খাদক হায়েনা-
দের হাত থেকে যে বাঁচাতে হবে।কমান্ডার মনসুর অন্য অন্য সকল মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ্য করে বললো…।যার- যার নিজের অস্ত্র হাতে তুলে নাও। এখনি একটা অপারেশনে যেতে হবে। সকলে দ্রুত অস্ত্র নিয়ে কমান্ডারকে ফলো করলো। রাত তখন তিনটা বাজে। কমান্ডার সঙ্গীদের নিয়ে দুর্জয় আর বিনয়ের কাছে পৌঁছালো।তারপর কমান্ডার দুর্জয় আর বিনয়কে বললো. চলো আর দেরি করা যাবে না। তারপর একসঙ্গে সকলে গিয়ে ক্যাম্পের চারদিক থেকে পজিশন নিলো। ছোট্ট রবিও সেই যুদ্ধে অংশ নিলো। ক্যাম্পের মধ্যে পূর্ণীমা মেয়েটিকে নিয়ে ধস্তাধস্তি করছে ওরা। পূর্ণীমা বলছে ছাড়.. ছাড়..ছেড়ে দে-আমাকে শয়তানেরা।
এ জুলুম আল্লাহ সইবে না।আল্লাহ তোদের কঠিন
শাস্তি দিবে। ওরা বিভৎস ভাবে অট্টহাসি হাসছে।
কমান্ডারের ইশারায় প্রথমে মুক্তিযোদ্ধা দুর্জয় গুলি চালালো। দুর্জয়ের নিশানা মাটি হয়নি। ওর প্রথম ছোঁড়া গুলিতেই একটা খানসেনা লুটিয়ে পড়লো। শব্দ শুনে খান সৈন্যরাও সব নিজেদের ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে যে যার মতো পজিশন নিয়ে পাল্টা গুলি ছুঁড়তে লাগলো। এভাবে পাল্টাপাল্টি গুলি চলতে থাকে প্রায় দুই আড়াই ঘন্টা ধরে। কিছুক্ষণ সব নিরব। ছোট্ট রবি, কমান্ডার কে বলে গোলাগুলির মধ্যদিয়ে মেয়েটিকে উদ্ধার করতে এগিয়ে গেলো।রবি মেয়েটি-কে নিয়ে ফেরার সময় হঠাৎ! পিছন থেকে এসে একটা গুলি লাগল রবির কোমরের নিচে। মাগো বলে চিৎকার করে উঠলো ছোট্ট রবি। দুর্জয় আর কিরণ রবির চিৎকার শুনে দ্রুত ছুটে গেলো। ওরা রবিকে কাঁধে
তুলে নিয়ে। গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে পূর্ণীমাকে সাথে নিয়ে পিছুতে লাগলো। রবি কাতরাচ্ছে বুলেটের যন্ত্রণায়। কমান্ডারের কথা মতো দু,জন যোদ্ধা মেয়েটিকে আর গুলিবিদ্ধ রবিকে নিয়ে রণাঙ্গন থেকে চলে এলো দূরে। তখনো মুহুর্মুহু যুদ্ধ চলছে। ফজরের আজানের পর পুবে ফর্সা হতে লাগলো। একসময় প্রতিপক্ষ খান সৈন্যদের ওপাশ থেকে আর কোনো গুলির শব্দ আসছে না। ভোর হলে দেখা গেলো। প্রায় বারো-তেরো জন খান সৈন্যের লাশ মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে আছে। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে শহীদ হয়েছে বিনয়। আর ওরা যখন ফিরে এলো। ততক্ষণে ওদের মধ্য থেকে। এ দেশটির জন্য জীবন দিয়ে চিরতরে হারিয়ে গেছে দশ বছর বয়সের সাহসী কিশোর ছোট্ট রবি। বিনয় আর রবির লাশ ওদের সামনে। সকলের চোখে জল। একসময় সকাল হলে ১৬ই ডিসেম্বরে বিজয় এলো। স্বাধীন হলো এদেশ। লাল সবুজের স্বাধীন পতাকা উড়তে লাগলো চারদিক। তখন রবির আলোতে যেনো ঝলমল করে উঠলো পূর্ব বাংলার সারাটা গগন।

 

সংবাদটি আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন-

ফারুক আহম্মেদ জীবন-এর গল্প ‘মুক্তিযুদ্ধ’

প্রকাশের সময় : ০২:২৪:০৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ৬ জানুয়ারী ২০২৫

সময়টা-১৯৭১ সাল…
গভীর নিস্তব্ধ ঘুটঘুটে এক ভুতুড়ে রাত। পূর্ব বাংলার বিভিন্ন জায়গায় তুমুল মুক্তিযুদ্ধ চলছে বাঙালীদের সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের খান সৈনা
-দের। চারিদিকে শুধু মুহুর্মুহু গোলাবারুদের শব্দ। গ্রামের পর গ্রাম ঐসব খান সৈন্যরা পূর্ব বাংলার বাঙালীদের বসত-ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে। দাউ –দাউ করে শুধু আগুন জ্বলছে চতুর্দিক। যেখানে সেখানে পঁচা-গলা লাশের স্তুপ। নদী, সাগর, খাল-বিলের জলে ভাসছে কতো-যে বাঙালীদের লাশ তার কোনো ইয়াত্ত্বা নেই। চারিদিকে নারী শিশুদের চিৎকার আর আহাজারির শব্দ। পাকিস্থানিদের
এমন বর্বতা দেখে আঠারো বছর বয়সের তাগড়া জোয়ান কিরণ। সে তার মা জ্যোতি কে-এসে বললো মা-গো….ঐসব পাকিস্তানি খানেদের এমন
পৈশাচিকতা আর মেনে নেওয়া যায় না..।
এবার আমি যুদ্ধে যাবো মাগো
স্বাধীন করব এদেশ,
এদেশের যতো মা শত্রু আছে
করব তাদের শেষ।
আমার জন্মভূমিকে মুক্ত করতে
প্রাণটা গেলে যাক,
ডেকো না আর তুমি পিছু মাগো
ঐ এসেছে যুদ্ধের ডাক।
দু,নয়নের জল মুছিয়া মাগো
দাও এবার বিদায়,
যুদ্ধের সাজে এবার আমায় মা
দাও তুমি সাজায়।
এই জন্মভূমিকে স্বাধীন করেই
ফিরবো তম কোলে,
মরিলে ভেবো তুমি দেশের জন্য
শহীদ হয়েছে ছেলে।
বলবে যেদিন মাগো প্রতি-জনে
তুমি বীরের মাতা,
বীর সন্তানের কথা শুনে সেদিন
ভুলো মনের সব ব্যথা।
বেঁচে থাকলে তোমার ছেলে যে
আনবে ছিনিয়ে বিজয়,
মনটাকে তাই তুমি শক্ত করে মা
দূর করো মনের ভয়।
ছেলের মুখে এসব কথা শুনে। মা- জ্যোতি কাঁদতে কাঁদতে সে তার আশীর্বাদের হাত ছেলে কিরণের মাথায় রেখে যুদ্ধের জন্য বিদায় দিলো। কিরণ তখন গিয়ে মুক্তি বাহিনীতে নাম লিখালো।তারপর গেরিলা ট্রেনিং নিয়ে এসে খান সৈন্যদের সাথে যুদ্ধ করতে লাগলো। এমনি এক ভয়াবহ যুদ্ধের
রাতে অন্য একটি ছেলে। পনেরো বছরের কিশোর দুর্জয়। একটা অপারেশন শেষে কিছুক্ষণ আগে তার এক বন্ধুর ভাঙ্গাচুরা ঘরে এসে ক্লান্ত শরীরে আশ্রয় নিয়েছে। সে কাঁধ থেকে তার হাতের অস্ত্রটা রেখে কেবল দু,চোখ এক করার একটু চেষ্টা করছিল। তার বন্ধুর ঘরটি একেবারে গাঁয়ের বাড় কোণে। চারিদিকে বাঁশঝাড় গাছ-গাছালি আর লতা পাতায় ভরা। কেবল একটু তন্দ্রা ভাব এসেছে দুর্জয়ের। হঠাৎ জানালার ওপাশ থেকে কে যেনো ফিসফিস করে ডাকছে দুর্জয়কে। এই দুর্জয়…দুর্জয়…এই দুর্জয়? দুর্জয়ের কানে সে শব্দ আসতেই হতচকিয়ে শোয়া থেকে ওঠে পড়লো। দ্রুত সে পাশে রাখা মেশিনগান হাতে তুলে নিলো। আবারো সেই ডাক। দুর্জয় কান দুটি খাড়া করে কন্ঠটা বুঝার চেষ্টা করলো। সে ফিসফিস করে ডাকছে…দুর্জয় এই…এই দুজয়… তাড়াতাড়ি
ওঠ, মিলিটারি ঢুকেছে এই গ্রামে। দুর্জয় বুঝতে পারলো এ কন্ঠ তার সহযোদ্ধা বিনয়ের। দুর্জয় দ্রুত দরজা খুলে মেশিনগান হাতে বাইরে চলে এলো। বিনয় এখনো হাঁপাচ্ছে। দুর্জয়কে বেরিয়ে
আসতে দেখেই বিনয় হাঁফাতে হাঁফাতে বললো..
দুর্জয় দ্রুত আমাদের এখান থেকে সরে যেতে হবে
কুইক ফাস্ট। হঠাৎ অনতিদূরে একটা গুলির শব্দ! দুর্জয় বুঝতে পারলো শব্দটা গাঁয়ের পশ্চিম দিকে হয়েছে। ওরা দুই বন্ধু গাঁয়ের দক্ষিণ দিকে
দ্রুত রওয়ানা হলো। রাতের আঁধার ভেদ করে একটা অসহায় মায়ের কান্নার কন্ঠ ওদের কানে
ভেসে এলো। বলছে….আমার একটা ছেলেকে তো তোমরা মেরেছ। আমার স্বামীটাকেও তোমরা মেরে ফেলেছ। দোহাই লাগে তোমাদের। আমার মেয়েটাকে তোমরা ছেড়ে দাও। খান সৈন্যদের মধ্যে একটা খান… অট্টহাসি দিয়ে বলছে…ছেড়ে দেবো…হুম? তারপর…হু…হু…হু…হা…হা…হা..করে হাসতে লাগলো। তারপর বললো ছালি ছেলেকে মুক্তিফৌজে নাম লিখাইছো.? আমাগো ছাত যুদ্ধ
করবে…? আমাগো কতল করবে? দেচ স্বাধীন করবে হুম..বলেই বুটের লাথি মারলো সেই মাকে।
তারপর আবারো একটা গুলির শব্দ। ঐ মহিলার চৌদ্দ পনেরো বছরের কিশোরী মেয়ে পূর্ণীমা। মা বলে চিৎকার করে উঠলো। দুর্জয় বুঝতে পারলো ঐ পাষণ্ডরা মেয়েটির মাকেও মেরে ফেলেছে।রক্ত
টগবগ করে ফুটছে দুর্জয়ের দেহে।রাগে দুটি চোখ
দিয়ে যেনো আগুন চটকাচ্ছে দুর্জয়ের। ক্রোধে
দুর্জয়ের সারাটা গায়ে যেনো একটা ঝাঁকি দিয়ে
উঠলো।মেয়েটিকে ধরে টানাহেঁচড়া করতে করতে ওরা ওদের ক্যাম্পের দিকে নিয়ে যেতে লাগলো। দ্রুত পজিশন নেওয়ার চেষ্টা করলো দুর্জয়। বিনয় কাঁধে হাত দিয়ে বাঁধা দিলো।
তারপর আস্তে আস্তে বললো..এখনি না দুর্জয়।
ওরা সংখ্যায় অনেক।তাছাড়া ওদের কাছে অনেক
অস্ত্র গোলা-বারুদ রয়েছে। আমরা মাত্র দুইজন।
ওদের সাথে পেরে উঠবো না। দুর্জয় এ কথা শুনে
একটু রেগে মেশিনগানটা নিচু করলো। তারপর বললো..এখন বেশি কালক্ষেপণ করলে মেয়েটির
সর্বনাশ হয়ে যাবে। বিনয় বললো…ওরা ক্যাম্পে পৌঁছানো মাত্রই আমরা অপারেশন-টা চালাবো।সে সময় দশ-বারো বছর মতো বয়স হবে নাম
রবি। সে দৌড়াতে.. দৌড়াতে এসে বললো…বিনয় দাদা..ও দুর্জয়..দাদা…কিরণ ভাইয়ের বোন পূর্ণীমা
আপুকে মিলিটারিরা তুলে নিয়ে গেছে ওদের ক্যাম্পে। আর কিরণ ভাইয়ের ছোট ভাই গগন আর ওর মা- বাবাকে মেরে ফেলেছে মিলিটারিরা।
ছোট্ট রবি মুক্তিযোদ্ধাদের হয়ে দেশের জন্য কাজ করে। বিনয়, দুর্জয় রবিকে বললো.রবি তাড়াতাড়ি
যাও আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সংবাদ দাও।রবি ও, ওর জীবন বাজি রেখে সংবাদ পৌঁছে দিলো মুক্তিফৌজ এর কমান্ডারের মনসুরের কাছে। সেখানে কিরণও ছিলো। ওর মা-বাবা ভাইকে মেরে ফেলেছে সব শুনে কিরণ কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।কমান্ডার কিরণের কাঁধে হাত রেখে বললো..কিরণ শান্ত হও। জানি তোমাকে শান্তনা দেওয়ার ভাষা আমার নেই। এই দেশ, এই মা-মাটির জন্য তুমি পরিবার পরিজন মা-বাবা, ভাই সবকিছু হারায়েছ। তবু, তোমাকে মনে রাখতে হবে তুমি একজন মুক্তিযোদ্ধা।তোমাকে আরো শক্ত হতে হবে কিরণ। চোখের জল মুছে ফেলো কিরণ।অস্ত্র হাতে তুলে নাও।তোমার বোনকে ঐসব নর-খাদক হায়েনা-
দের হাত থেকে যে বাঁচাতে হবে।কমান্ডার মনসুর অন্য অন্য সকল মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ্য করে বললো…।যার- যার নিজের অস্ত্র হাতে তুলে নাও। এখনি একটা অপারেশনে যেতে হবে। সকলে দ্রুত অস্ত্র নিয়ে কমান্ডারকে ফলো করলো। রাত তখন তিনটা বাজে। কমান্ডার সঙ্গীদের নিয়ে দুর্জয় আর বিনয়ের কাছে পৌঁছালো।তারপর কমান্ডার দুর্জয় আর বিনয়কে বললো. চলো আর দেরি করা যাবে না। তারপর একসঙ্গে সকলে গিয়ে ক্যাম্পের চারদিক থেকে পজিশন নিলো। ছোট্ট রবিও সেই যুদ্ধে অংশ নিলো। ক্যাম্পের মধ্যে পূর্ণীমা মেয়েটিকে নিয়ে ধস্তাধস্তি করছে ওরা। পূর্ণীমা বলছে ছাড়.. ছাড়..ছেড়ে দে-আমাকে শয়তানেরা।
এ জুলুম আল্লাহ সইবে না।আল্লাহ তোদের কঠিন
শাস্তি দিবে। ওরা বিভৎস ভাবে অট্টহাসি হাসছে।
কমান্ডারের ইশারায় প্রথমে মুক্তিযোদ্ধা দুর্জয় গুলি চালালো। দুর্জয়ের নিশানা মাটি হয়নি। ওর প্রথম ছোঁড়া গুলিতেই একটা খানসেনা লুটিয়ে পড়লো। শব্দ শুনে খান সৈন্যরাও সব নিজেদের ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে যে যার মতো পজিশন নিয়ে পাল্টা গুলি ছুঁড়তে লাগলো। এভাবে পাল্টাপাল্টি গুলি চলতে থাকে প্রায় দুই আড়াই ঘন্টা ধরে। কিছুক্ষণ সব নিরব। ছোট্ট রবি, কমান্ডার কে বলে গোলাগুলির মধ্যদিয়ে মেয়েটিকে উদ্ধার করতে এগিয়ে গেলো।রবি মেয়েটি-কে নিয়ে ফেরার সময় হঠাৎ! পিছন থেকে এসে একটা গুলি লাগল রবির কোমরের নিচে। মাগো বলে চিৎকার করে উঠলো ছোট্ট রবি। দুর্জয় আর কিরণ রবির চিৎকার শুনে দ্রুত ছুটে গেলো। ওরা রবিকে কাঁধে
তুলে নিয়ে। গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে পূর্ণীমাকে সাথে নিয়ে পিছুতে লাগলো। রবি কাতরাচ্ছে বুলেটের যন্ত্রণায়। কমান্ডারের কথা মতো দু,জন যোদ্ধা মেয়েটিকে আর গুলিবিদ্ধ রবিকে নিয়ে রণাঙ্গন থেকে চলে এলো দূরে। তখনো মুহুর্মুহু যুদ্ধ চলছে। ফজরের আজানের পর পুবে ফর্সা হতে লাগলো। একসময় প্রতিপক্ষ খান সৈন্যদের ওপাশ থেকে আর কোনো গুলির শব্দ আসছে না। ভোর হলে দেখা গেলো। প্রায় বারো-তেরো জন খান সৈন্যের লাশ মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে আছে। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে শহীদ হয়েছে বিনয়। আর ওরা যখন ফিরে এলো। ততক্ষণে ওদের মধ্য থেকে। এ দেশটির জন্য জীবন দিয়ে চিরতরে হারিয়ে গেছে দশ বছর বয়সের সাহসী কিশোর ছোট্ট রবি। বিনয় আর রবির লাশ ওদের সামনে। সকলের চোখে জল। একসময় সকাল হলে ১৬ই ডিসেম্বরে বিজয় এলো। স্বাধীন হলো এদেশ। লাল সবুজের স্বাধীন পতাকা উড়তে লাগলো চারদিক। তখন রবির আলোতে যেনো ঝলমল করে উঠলো পূর্ব বাংলার সারাটা গগন।