Dhaka ০৭:২৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

করোনাকালের অন্তহীন ভাবনা

সংবাদদাতা-
  • প্রকাশের সময় : ০৬:৫৭:১৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৫ মে ২০২০
  • / ২১১০ জন সংবাদটি পড়েছেন

॥ সৌমিত্র শীল চন্দন ॥

ব্যতিক্রমটা এবারই হলো।

বরাবরই আমি ঘুম কাতুরে। সকাল ৯টার আগে ঘুম থেকে ওঠা যেন আমার জন্য মহাযন্ত্রণা। তবে বছরে দুটি ঈদে আমি ঘুম থেকে উঠে রেলওয়ে ঈদগাহে চলে যাই ক্যামেরা নিয়ে। যদিও গতবছর ঝড় বৃষ্টিতে ঈদের জামাত ঈদগাহে হয়নি। এবছর করোনার কারণে সব মসজিদে হয়েছে ঈদের নামাজ। একরকম স্থবির অবস্থার মধ্যে পালিত হচ্ছে ঈদ। এটাই আমাদের জীবন। যতদিন বেঁচে থাকব; নতুন নতুন বিষয়ের সাথে পরিচিত হবো।

সংকট, অবরুদ্ধ, লকডাউন এসবের সাথে আমরা পরিচিত ছিলাম না। করোনা আমাদের সে শিক্ষা দিয়ে গেল। উনিশ শতকে যাদের জন্ম তারা দেখেছেন দুটি বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা। দেখেছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকহানাদার বাহিনী আর তাদের দোসরদের নির্মম বর্বরতা। নয়টি মাস বাংলাদেশের মানুষ কী অসহনীয় সময় কাটিয়েছে। চারিদিকে গুলির শব্দ। লাশ আর রক্ত। জীবন বাঁচাতে পালিয়ে বাড়িছাড়া কতশত মানুষ। মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। তবে তার ভয়াবহতা আমরা উপলদ্ধি করতে পারি। প্রথমও দ্বিতীয়ু বিশ্বযুদ্ধ আর মুক্তিযুদ্ধ ছাড়াও ছাড়াও তারা দেখেছে কলেরা, প্লেগ এর মহামারী।

করোনাকালে দীর্ঘ দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে মানুষ পার করছে এক কঠিন সময়। গত মার্চ মাসের ৮ তারিখে বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। তখন কেউ  কী ধারণা করতে পেরেছিল কোথায় গিয়ে থামবে? ১৭  মার্চের পরে ক্রমশঃ সংক্রমণ বাড়তে থাকায় ২৬ মার্চ থেকে লকডাউন। গাড়ি-ঘোড়া, অফিস-কাচারী, স্কুল-কলেজ, মানুষের কাজ-কর্ম সব বন্ধ। লকডাউন শুরু হওয়ার পর সন্ধ্যার পরেই নিস্তব্ধ হয়ে যায় রাজবাড়ী শহর। চিরচেনা  সেই শহর আর নেই। একদম জনমানবশূন্য। মাঝে মধ্যে দুএকজনকে দেখা যায়। রেলগেটে যাত্রীর অপেক্ষায় দু একজন রিক্সাচালক। এমন দৃশ্যের সাথে আমরা কখনই পরিচিত ছিলাম না। পরিবর্তন এলো আমার প্রতিদিনকার রুটিনেও।

অনেকেই ভেবেছিলো হয়তো বা ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যেই স্বাভাবিক হয়ে যাবে সবকিছু। দিন যায়। অসহায় মানুষের হাহাকার বাড়তে থাকে। আশার কথা এই যে, বিপর্র্যস্তদের সহায়তায় সরকারি নানা কার্যক্রম এখনও অব্যাহত রয়েছে। সরকার বিভিন্নভাবে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, বিপন্নরা যাতে দুর্যোগ কাটিয়ে ফিরে আসতে পারে স্বাভাবিক জীবনে। সামাজিক, ব্যবসায়িক, সাংস্কৃতিক বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরাও নিজ নিজ অবস্থান থেকে প্রসারিত করেছেন সহায়তার হাত। ব্যক্তি পর্যায়েও চলছে মানবিক কার্যক্রম। মানুষই মানুষের সাহায্যে এগিয়ে এসেছে যে যার মত করে।

কোথাও কাজ নেই। থেমে গেছে মানুষের জীবনজীবকা। সম্ভবতঃ এপ্রিলের মাঝামাঝি একদিন অফিসে বসে আছি। একটি মধ্যবয়সী লোক এসে বললো; আমি ‘চন্দন স্যার’ এর সাথে দেখা করবো। বললাম, আমার নাম চন্দন। কিন্তু আমি স্যার নই। লোকটি বললো; কোথাও কাজকর্ম খুঁজে পাচ্ছিনা। বাড়িতে সবাই না খেয়ে আছে। আমাকে কিছু সাহায্য করেন। কী বলবো, বুঝতে পারছিলাম না। বললাম, আপনি জনপ্রতিনিধিদের কাছে যান। উত্তর; গিয়েছিলাম। দুর্ব্যবহার করে। তাড়িয়ে দেয়। লোকটি কেঁদে ফেলল। বললাম, ঠিক আছে। সাহায্য পেলে আমি আপনাকে জানাবো। আমি ক্ষুদ্র মানুষ। লকডাউন শুরুর প্রথম দিকে কয়েকজনকে যৎসামান্য সাহায্য দিয়েছিলাম। বৃহৎ সাহায্য করার সামর্থ্য আমার কই? কিন্তু লোকটিকে সাহায্য করাই দরকার। কীভাবে করবো? অনুজ কল্লোল তার সংগঠন থেকে কিছু মানুষকে সাহায্য করছে জানতে পারে কল্লোলকে বললাম, লোকটির জন্য একটা ব্যবস্থা করতে। কল্লোল তা করে দিল। লোকটিকে খবর পাঠালাম। নির্দিষ্ট দিন অফিসে চলে এলো। ব্যাগে চাল, ডাল, তেল, লবণ দেখে কেঁদে ফেলল। বললো, আপনাকে প্রাণভরে দোয়া করি। লোকটির চোখে আনন্দাশ্রু দেখে মনটা ভরে গেল। জানিনা এমন আরও কতজন কর্মহীন হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে।

‘করোনা ফ্রন্ট লাইনার্স’ বলে একটা শব্দ আবিষ্কার হয়েছে। রাজবাড়ীতে ফ্রন্ট লাইনার্স কারা? করোনা শুরুর প্রাক্কালে দেখেছি মহিলা পরিষদের সভাপতি লাইলী নাহার বৃদ্ধ বয়সেও রাত জেগে মাস্ক তৈরি করছেন। তার কন্যা শায়লা তাবাসসুম নেওয়াজ, জামাতা  কলেজ শিক্ষক নাসিম হায়দার কল্লোলও তার সাথে যোগ দিয়েছেন। দেখেছি অগ্রজ নেহাল ভাই হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি করার জন্য কীভাবে আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। তার সাথে যোগ দিয়েছেন সঞ্জয় ভৌমিক ও স্মৃতি ইসলাম। এই পাঁচজন শুরু থেকে এখন পর্যন্ত মানুষের সাহায্যে  কাজ করে চলেছেন। করোনাযুদ্ধে অসামান্য অবদান রেখে চলেছে রাজবাড়ীর পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান পিপিএম। বাড়ি বাড়ি বাড়ি গিয়ে মাস্ক স্যানিটাইজার বিতরণ করেছেন। শুরুতেই বিদেশ ফেরত মানুষের তালিকা তৈরি করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদেরকে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকতে বলেছেন। তিনি নিজে উদ্যোগি হয়ে মানুষকে খাদ্যসামগ্রী দিয়েছেন। রমজান শুরু হওয়ার পর নামমাত্র মূল্যে পাঁচ টাকার ইফতার সামগ্রী সরবরাহে সহযোগিতা করেছেন। দিয়েছেন হতদরিদ্রদের ঈদ পোশাক। নিঃসন্দেহে রাজবাড়ীর পুলিশ বাহিনী ধন্যবাদ পাওয়ার দাবিদার।

দেখতে দেখতে দুই মাস পেরিয়ে গেল। এসে গেল  মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর। এবার এক মর্মন্তুদ প্রেক্ষাপটে ঈদুল ফিতর পালিত হলো। করোনাভাইরাসের সংক্রমণে প্রায় গোটা বিশ্বে মর্মন্তুদ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। আমরাও এর বাইরে নই। এক ভিন্ন বাস্তবতার মধ্য দিয়ে পালিত হলো এবারের ঈদ। ঈদগাহে নামাজ নেই। নামাজ শেষে কোলাকুলি নেই। একে অপরের বাড়িতে যাওয়া নেই। বাজারে কেনাকেটা নেই। কোথাও কোলাহল নেই। মোড়ে মোড়ে বিশালকায় সাউন্ড সিস্টেম বাজানো নেই। সবাই যেন এটা মেনেই নিয়েছে।

যে কোনো উৎসবের অন্যতম দিক হচ্ছে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি-মৈত্রীর সেতুবন্ধ আরও পোক্ত করা। উৎসব আমাদের সেই পথই সৃষ্টি করে দেয়। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে সম্প্রীতির বন্ধন নিয়ে আমরা গর্ব করি। নিশ্চয়ই এই গর্ব অমূলক নয়। আমাদের এই গর্বের প্রেক্ষাপটও অনেক বিস্তৃৃত। আমাদের সমাজে ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’- এই বক্তব্যের তাৎপর্য রয়েছে। উৎসব মানবিক আবেগের আনন্দঘন এক সর্বজনীন বহিঃপ্রকাশ। মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে উৎসব সম্পর্কিত। আমরা যদি একে অন্যের পাশে বিশেষ করে যারা অসহায় তাদের পাশে আরও উদাত্তভাবে দাঁড়াই, তাহলে উৎসব যে মানুষের মহামিলনকে মূর্ত করে দেয় মানবিকতার ছোঁয়ায় তার প্রকাশ হবে আরও ব্যাপক।

পৃথিবীতে দুর্যোগ আসে তা আবার চলেও যায়। এই করোনা দুর্যোগও একসময় শেষ হয়ে যাবে। মাঝখানে ঝরে যাবে কিছু প্রাণ। এটাই সত্য, কেউ থাকবো কেউ থাকবোনা। তবুও আমরা আশা নিয়ে বাঁচি। সেই আশা থেকেই বলি; দুর্যোগের মেঘ কেটে চারদিকে আলোর বিচ্ছুরণ ছড়িয়ে পড়ুক। জয় হোক মানবতার। সব অশুভের অবসান ঘটুক।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক জনতার আদালত

জেলা প্রতিনিধি: দৈনিক সমকাল ও দেশটিভি

Tag :

সংবাদটি আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন-

করোনাকালের অন্তহীন ভাবনা

প্রকাশের সময় : ০৬:৫৭:১৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৫ মে ২০২০

॥ সৌমিত্র শীল চন্দন ॥

ব্যতিক্রমটা এবারই হলো।

বরাবরই আমি ঘুম কাতুরে। সকাল ৯টার আগে ঘুম থেকে ওঠা যেন আমার জন্য মহাযন্ত্রণা। তবে বছরে দুটি ঈদে আমি ঘুম থেকে উঠে রেলওয়ে ঈদগাহে চলে যাই ক্যামেরা নিয়ে। যদিও গতবছর ঝড় বৃষ্টিতে ঈদের জামাত ঈদগাহে হয়নি। এবছর করোনার কারণে সব মসজিদে হয়েছে ঈদের নামাজ। একরকম স্থবির অবস্থার মধ্যে পালিত হচ্ছে ঈদ। এটাই আমাদের জীবন। যতদিন বেঁচে থাকব; নতুন নতুন বিষয়ের সাথে পরিচিত হবো।

সংকট, অবরুদ্ধ, লকডাউন এসবের সাথে আমরা পরিচিত ছিলাম না। করোনা আমাদের সে শিক্ষা দিয়ে গেল। উনিশ শতকে যাদের জন্ম তারা দেখেছেন দুটি বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা। দেখেছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকহানাদার বাহিনী আর তাদের দোসরদের নির্মম বর্বরতা। নয়টি মাস বাংলাদেশের মানুষ কী অসহনীয় সময় কাটিয়েছে। চারিদিকে গুলির শব্দ। লাশ আর রক্ত। জীবন বাঁচাতে পালিয়ে বাড়িছাড়া কতশত মানুষ। মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। তবে তার ভয়াবহতা আমরা উপলদ্ধি করতে পারি। প্রথমও দ্বিতীয়ু বিশ্বযুদ্ধ আর মুক্তিযুদ্ধ ছাড়াও ছাড়াও তারা দেখেছে কলেরা, প্লেগ এর মহামারী।

করোনাকালে দীর্ঘ দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে মানুষ পার করছে এক কঠিন সময়। গত মার্চ মাসের ৮ তারিখে বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। তখন কেউ  কী ধারণা করতে পেরেছিল কোথায় গিয়ে থামবে? ১৭  মার্চের পরে ক্রমশঃ সংক্রমণ বাড়তে থাকায় ২৬ মার্চ থেকে লকডাউন। গাড়ি-ঘোড়া, অফিস-কাচারী, স্কুল-কলেজ, মানুষের কাজ-কর্ম সব বন্ধ। লকডাউন শুরু হওয়ার পর সন্ধ্যার পরেই নিস্তব্ধ হয়ে যায় রাজবাড়ী শহর। চিরচেনা  সেই শহর আর নেই। একদম জনমানবশূন্য। মাঝে মধ্যে দুএকজনকে দেখা যায়। রেলগেটে যাত্রীর অপেক্ষায় দু একজন রিক্সাচালক। এমন দৃশ্যের সাথে আমরা কখনই পরিচিত ছিলাম না। পরিবর্তন এলো আমার প্রতিদিনকার রুটিনেও।

অনেকেই ভেবেছিলো হয়তো বা ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যেই স্বাভাবিক হয়ে যাবে সবকিছু। দিন যায়। অসহায় মানুষের হাহাকার বাড়তে থাকে। আশার কথা এই যে, বিপর্র্যস্তদের সহায়তায় সরকারি নানা কার্যক্রম এখনও অব্যাহত রয়েছে। সরকার বিভিন্নভাবে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, বিপন্নরা যাতে দুর্যোগ কাটিয়ে ফিরে আসতে পারে স্বাভাবিক জীবনে। সামাজিক, ব্যবসায়িক, সাংস্কৃতিক বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরাও নিজ নিজ অবস্থান থেকে প্রসারিত করেছেন সহায়তার হাত। ব্যক্তি পর্যায়েও চলছে মানবিক কার্যক্রম। মানুষই মানুষের সাহায্যে এগিয়ে এসেছে যে যার মত করে।

কোথাও কাজ নেই। থেমে গেছে মানুষের জীবনজীবকা। সম্ভবতঃ এপ্রিলের মাঝামাঝি একদিন অফিসে বসে আছি। একটি মধ্যবয়সী লোক এসে বললো; আমি ‘চন্দন স্যার’ এর সাথে দেখা করবো। বললাম, আমার নাম চন্দন। কিন্তু আমি স্যার নই। লোকটি বললো; কোথাও কাজকর্ম খুঁজে পাচ্ছিনা। বাড়িতে সবাই না খেয়ে আছে। আমাকে কিছু সাহায্য করেন। কী বলবো, বুঝতে পারছিলাম না। বললাম, আপনি জনপ্রতিনিধিদের কাছে যান। উত্তর; গিয়েছিলাম। দুর্ব্যবহার করে। তাড়িয়ে দেয়। লোকটি কেঁদে ফেলল। বললাম, ঠিক আছে। সাহায্য পেলে আমি আপনাকে জানাবো। আমি ক্ষুদ্র মানুষ। লকডাউন শুরুর প্রথম দিকে কয়েকজনকে যৎসামান্য সাহায্য দিয়েছিলাম। বৃহৎ সাহায্য করার সামর্থ্য আমার কই? কিন্তু লোকটিকে সাহায্য করাই দরকার। কীভাবে করবো? অনুজ কল্লোল তার সংগঠন থেকে কিছু মানুষকে সাহায্য করছে জানতে পারে কল্লোলকে বললাম, লোকটির জন্য একটা ব্যবস্থা করতে। কল্লোল তা করে দিল। লোকটিকে খবর পাঠালাম। নির্দিষ্ট দিন অফিসে চলে এলো। ব্যাগে চাল, ডাল, তেল, লবণ দেখে কেঁদে ফেলল। বললো, আপনাকে প্রাণভরে দোয়া করি। লোকটির চোখে আনন্দাশ্রু দেখে মনটা ভরে গেল। জানিনা এমন আরও কতজন কর্মহীন হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে।

‘করোনা ফ্রন্ট লাইনার্স’ বলে একটা শব্দ আবিষ্কার হয়েছে। রাজবাড়ীতে ফ্রন্ট লাইনার্স কারা? করোনা শুরুর প্রাক্কালে দেখেছি মহিলা পরিষদের সভাপতি লাইলী নাহার বৃদ্ধ বয়সেও রাত জেগে মাস্ক তৈরি করছেন। তার কন্যা শায়লা তাবাসসুম নেওয়াজ, জামাতা  কলেজ শিক্ষক নাসিম হায়দার কল্লোলও তার সাথে যোগ দিয়েছেন। দেখেছি অগ্রজ নেহাল ভাই হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি করার জন্য কীভাবে আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। তার সাথে যোগ দিয়েছেন সঞ্জয় ভৌমিক ও স্মৃতি ইসলাম। এই পাঁচজন শুরু থেকে এখন পর্যন্ত মানুষের সাহায্যে  কাজ করে চলেছেন। করোনাযুদ্ধে অসামান্য অবদান রেখে চলেছে রাজবাড়ীর পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান পিপিএম। বাড়ি বাড়ি বাড়ি গিয়ে মাস্ক স্যানিটাইজার বিতরণ করেছেন। শুরুতেই বিদেশ ফেরত মানুষের তালিকা তৈরি করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদেরকে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকতে বলেছেন। তিনি নিজে উদ্যোগি হয়ে মানুষকে খাদ্যসামগ্রী দিয়েছেন। রমজান শুরু হওয়ার পর নামমাত্র মূল্যে পাঁচ টাকার ইফতার সামগ্রী সরবরাহে সহযোগিতা করেছেন। দিয়েছেন হতদরিদ্রদের ঈদ পোশাক। নিঃসন্দেহে রাজবাড়ীর পুলিশ বাহিনী ধন্যবাদ পাওয়ার দাবিদার।

দেখতে দেখতে দুই মাস পেরিয়ে গেল। এসে গেল  মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর। এবার এক মর্মন্তুদ প্রেক্ষাপটে ঈদুল ফিতর পালিত হলো। করোনাভাইরাসের সংক্রমণে প্রায় গোটা বিশ্বে মর্মন্তুদ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। আমরাও এর বাইরে নই। এক ভিন্ন বাস্তবতার মধ্য দিয়ে পালিত হলো এবারের ঈদ। ঈদগাহে নামাজ নেই। নামাজ শেষে কোলাকুলি নেই। একে অপরের বাড়িতে যাওয়া নেই। বাজারে কেনাকেটা নেই। কোথাও কোলাহল নেই। মোড়ে মোড়ে বিশালকায় সাউন্ড সিস্টেম বাজানো নেই। সবাই যেন এটা মেনেই নিয়েছে।

যে কোনো উৎসবের অন্যতম দিক হচ্ছে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি-মৈত্রীর সেতুবন্ধ আরও পোক্ত করা। উৎসব আমাদের সেই পথই সৃষ্টি করে দেয়। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে সম্প্রীতির বন্ধন নিয়ে আমরা গর্ব করি। নিশ্চয়ই এই গর্ব অমূলক নয়। আমাদের এই গর্বের প্রেক্ষাপটও অনেক বিস্তৃৃত। আমাদের সমাজে ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’- এই বক্তব্যের তাৎপর্য রয়েছে। উৎসব মানবিক আবেগের আনন্দঘন এক সর্বজনীন বহিঃপ্রকাশ। মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে উৎসব সম্পর্কিত। আমরা যদি একে অন্যের পাশে বিশেষ করে যারা অসহায় তাদের পাশে আরও উদাত্তভাবে দাঁড়াই, তাহলে উৎসব যে মানুষের মহামিলনকে মূর্ত করে দেয় মানবিকতার ছোঁয়ায় তার প্রকাশ হবে আরও ব্যাপক।

পৃথিবীতে দুর্যোগ আসে তা আবার চলেও যায়। এই করোনা দুর্যোগও একসময় শেষ হয়ে যাবে। মাঝখানে ঝরে যাবে কিছু প্রাণ। এটাই সত্য, কেউ থাকবো কেউ থাকবোনা। তবুও আমরা আশা নিয়ে বাঁচি। সেই আশা থেকেই বলি; দুর্যোগের মেঘ কেটে চারদিকে আলোর বিচ্ছুরণ ছড়িয়ে পড়ুক। জয় হোক মানবতার। সব অশুভের অবসান ঘটুক।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক জনতার আদালত

জেলা প্রতিনিধি: দৈনিক সমকাল ও দেশটিভি