একজন আনোয়ার হোসেন ॥ বাল্যবিয়ে মুক্ত দেশ গড়ার স্বপ্নে সাইকেল চালিয়ে ঘুরছেন দেশ
- প্রকাশের সময় : ০৭:৫৭:৪৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ৪ জানুয়ারী ২০২০
- / ১৬২৩ জন সংবাদটি পড়েছেন
জনতার আদালত অনলাইন ॥ পরনে তার লাল পোশাক। জামার বামপাশে লেখা ‘বাল্যবিয়েকে না বলুন, ডানপাশে লেখা বাল্যবিয়েকে লাল কার্ড দেখান। বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে সচেতন করতে আনোয়ার হোসেন তালুকদার সাইকেল চালিয়ে দেশ ঘুরছেন। সাইকেলের সামনে ছোট্ট যে সাইনবোর্ড তাতে তার পরিচয়ের সাথে ‘হতে চাইনা বিয়ের পাত্রী, হতে চাই স্কুলছাত্রী’ স্লোগান লেখা। পঞ্চাশোর্ধ বয়সী আনোয়ার হোসেন পেশায় একজন কাঠমিস্ত্রী। তিনি বগুড়া সদও উপজেলার নিশিন্দারা ইউনিয়নের বারবাকপুর গ্রামের বাসিন্দা। বাল্যবিয়ে সমাজের জন্য খারাপ এজন্য তিনি লাল পোশাক পরেছেন।
সম্প্রতি রাজবাড়ীর পুলিশ সুপার কার্যালয়ের সামনে কথা হয় আনোয়ার হোসেনের সাথে। জানান, বাল্যবিয়ে মুক্ত দেশ গড়াই তার স্বপ্ন। অকালে যেন কোনো ছাত্রী ঝরে না পড়ে। কারও যেন অকাল মৃত্যু না হয়। সাইকেল চালিয়ে দেশের ৬৪ টি জেলা ও ২২৭টি উপজেলা পরিভ্রমণ করে এসেছেন রাজবাড়ীতে। তিনি জানান, তার ভাগ্নির বাল্য বিয়ে হয়েছিল। ম্ত্রা ১৪ বছর বয়সে সন্তান হওয়ার পর স্বামী তার ভাগ্নিকে ছেড়ে দেয়। এরপর ভগ্নিপতি (ভাগ্নির বাবা) সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলে ওই পরিবারের করুণ পরিণতি দেখে বাল্যবিবাহ রোধ ও জনগণকে সচেতন করতে ২০১৫ সালের মার্চে তার দোকান বিক্রি করে বাই সাইকেল নিয়ে দেশ ভ্রমণ শুরু করেন। মাত্র ৬৭ দিনে তিনি ৬৪ জেলা ভ্রমণ করেন এবং জেলা পর্যায় শেষে এখন উপজেলা পর্যায় ভ্রমণ করে বাল্যবিবাহ রোধ ও বাল্যবিয়ের কুফল সম্পর্কে লিফলেট বিতরণ করছেন। বাল্যবিয়ের কারণে স্বামী স্ত্রী উভয়েরই জীবনের ঝুঁকি বাড়ে। সন্তান প্রসবের সময় অনেক প্রসূতি মৃত্যুবরণ করেছে। এছাড়া পারিবারিক ও দাম্পত্য কলহও বাল্যবিয়ের অন্যতম কারণ। রয়েছে আরও অনেক রকম ঝুঁকি। এসব কারণে বাল্যবিয়ে বন্ধ হওয়া সময়ের দাবি।
দুই ছেলে ও দুই মেয়ের বাবা আনোয়ার হোসেন। বড় ছেলে আসিফ পেশায় একজন ব্যবসায়ী। ছোট ছেলে আব্দুল্লাহ তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। তবে ১১ বছর আগে যখন বড় মেয়ের বিয়ে দেন তখন তার বয়স ছিল ১৬ বছর। এজন্য তিনি ভীষণ অনুতপ্ত। আনোয়ার হোসেন জানান, তখন তিনি বাল্যবিয়ের ভালো মন্দ বুঝতেন না, তাই রভুল করেছেন। তবে ছোট মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন ২০ বছর বয়সেই।
আনোয়ার হোসেন বলেন, বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করতে যখন লাল পোশাক পড়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লেন, তখন অনেকেই তাকে পাগল বলেছিল। এমনকি তার এলাকার নিশিন্দারা ইউপি চেয়ারম্যানও তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছিলেন। পরে যখন সবাই তাকে বহবা দিতে শুরু করলো। তখন ইউপি চেয়ারম্যান ডেকে তাকে সংবর্ধনা দিয়েছেন।
এ পর্যন্ত তিনি নিজে চারটি বাল্যবিয়ে বন্ধ করেছেন। কয়েক বছর আগে তার এলাকার ষষ্ঠ শ্রেণির এক ছাত্রীর বিয়ের আয়োজনের কথা শুনে শিশুটির পরিবারের কাছে গিয়ে বিয়েটি বন্ধ করার অনুরোধ করেন। কিন্তু তার কথায় কেউ কর্ণপাত করেনি। তখন তিনি উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসন ও পুলিশকে বিষয়টি জানান। তারা ঘটনাস্থলে গিয়ে বিয়েটি বন্ধ করেন। তবে এলাকায় কারও বিয়ে বন্ধ করলে মানুষের শত্র“ হতে হয়। এজন্য প্রশাসনের কর্মকর্তারা তাকে বলেছেন, বাল্যবিয়ের খবর পেলে ফোন করে জানাতে। আর আমি যেভাবে বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন কও উব্দুদ্ধ করছি তা করে যেতে বলেছেন। বাল্যবিয়ের খবর পেলেই তিনি সাথে সাথে প্রশাসন ও পুলিশকে অবহিত করেন।
তিনি বলেন, আমার স্ত্রী পারভীন আক্তার এবং বড় ছেলে আমাকে একাজে খুবই উৎসাহিত করে। সাইকেলে চড়ে দেশ ঘুরে বেড়ানোর সময় কখনও কোনো সমস্যার মুখোমুখি হইনি। এটা আল্লাহরই বিশেষ রহমত।
আনোয়ার হোসেনের মতে, যে পরিবার বাল্যবিয়ে দেবে বা আয়োজন করবে তাদের স্মার্ট কার্ড বাতিল করে দিতে হবে। তাহলে তারা সরকারি কোনো সুযোগ সুবিধা পাবেনা। সরকারি সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ার ভয়ে তখন আর কেউ বাল্য বিয়ে দেয়ার উদ্যোগ নেবেনা। এছাড়া ষষ্ঠ থেকে একাদশ শ্রেণির ছাত্র ছাত্রীদের হাতে মোবাইল ফোন যেন না দেয়া হয় সেব্যাপারেও সজাগ হওয়া দরকার। কারণ, মোবাইল ফোন শিশুদেরকে বিপথে চালিত করে।
আনোয়ার হোসেন জানান, তিনি যে উপজেলায় যান সেখানকার জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তার থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। এছাড়া লিফলেটের খরচসহ অন্যান্য খরচ এখন তার ছেলের কাছ থেকে নেন। তিনি আরো জানান, ভ্রমণ করতে এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে কোন আর্থিক সহযোগিতা পাননি। শুধুমাত্র ইউনিসেফের একটি প্রোগ্রাম করে তিন মাসে ৭২ হাজার টাকা পেয়েছিলেন। উপজেলা পর্যায় ভ্রমণ শেষে ইউনিয়ন পর্যায় ভ্রমণ করার ইচ্ছে আছে তার। আর যেন কোন মেয়ের বাল্য বিয়ে না হয় এবং তার ভাগ্নির মত অবস্থা না হয় সে জন্য ভ্রমণ চালিয়ে যাবেন।