Dhaka ০৩:৪২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

গোয়ালন্দে থামছে না বাল্যবিয়ে

সংবাদদাতা-
  • প্রকাশের সময় : ০৯:৩৫:৫৮ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৭ নভেম্বর ২০১৯
  • / ১৭৯১ জন সংবাদটি পড়েছেন

জনতার আদালত অনলাইন ॥ রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলায় বাল্যবিয়ের প্রবণতা কোন ভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। দরিদ্রতা ও সামাজিক নিরাপত্তা ছাড়াও কিছু অসাধু নোটারীয়ানের সহযোগিতায় বাল্যবিয়ে দিন দিন এ এলাকায় ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসন মুচলেকা নিয়ে বিয়ে বন্ধ করার দাবি করলেও কার্যত তা বন্ধ হচ্ছে না। প্রশাসনের বন্ধ করা ৯৫ শতাংশ বাল্যবিয়েই নানা কৌশলে পারবর্তীতে বিয়ে সম্পন্ন করা হয়েছে বলে অভিযোগ আছে।
গোয়ালন্দে চলমান জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষায় অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী অনুপস্থিত রয়েছে। বাল্য বিয়ে, দারিদ্রতা ও নদী ভাঙনের শিকার হওয়ায় এরা পরীক্ষা দিতে পারছে না বলে জানা গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উপজেলার পদ্মা নদী তীরবর্তী চরাঞ্চল ও নদী ভাঙ্গন কবলিত এলাকায় বাল্যবিয়ে অহরহ সংগঠিত হচ্ছে। এছাড়া পৌর শহরেও অনেক কিশোরী বাল্যবিয়ের শিকার হচ্ছে। আইন অনুযায়ী মেয়েদের বিয়ের বসয় নুন্যতম ১৮ বছর হলেও এখানে ১২/১৩ বছরের কিশোরীদের বিয়ে হচ্ছে। এক্ষেত্রে সরকারের কঠোর আইন থাকলেও তার যথাযথ প্রয়োগ নেই। আইনের চোখ ফাঁকি দিতে কিছু অসাধু নোটারীয়ানদের থেকে অভিভাবকরা তাদের মেয়েদের বয়স বাড়িয়ে অ্যাফিডেভিট নিয়ে আসছে। এছাড়া আইনগত কোন ভিত্তি না থাকলেও আ্যাফিডেভিট করে কথিত কোর্টম্যারিজ নাম দিয়ে বিয়ে সম্পন্ন করছে। কিন্তু বয়স ও বিয়ের ক্ষেত্রে অ্যাফিডেভিট কার্যকর নয় বলে সুনির্দিষ্ট সরকারী নির্দেশনা রয়েছে। এর বাইরেও বিনা কাবিনে শুধু শরীয়া মতে বাল্যবিয়ে ঘটনাও ঘটছে। এক্ষেত্রে মেয়েদের অভিষ্যত আরো অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ছে।
এছাড়া বাল্যবিয়ের কারণে বিদ্যালয় থেকে ঝড়ে পড়ার সংখ্যাও দিন দিন আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষা কেন্দ্র সূত্রে জানা যায়, এবার গোয়ালন্দ উপজেলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো হতে মোট ১৫৩৫ জন পরীক্ষার্থী জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে। এর মধ্যে শুরু থেকেই ৫২ জন পরীক্ষার্থী অনুপস্থিত রয়েছে। এর মধ্যে ৪৩ জন মেয়ে ও ৯ জন ছেলে রয়েছে।
তাদের অনুপস্থিতির ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সূত্র জানায়, মেয়েদের প্রায় সবাই বাল্য বিয়ের শিকার হওয়ায় ফরম পূরণ করা সত্ত্বেও পরীক্ষা দিতে পারছে না। ছেলেরা মূলত পরিবারে অভাবের কারণে কাজের সন্ধানে বিভিন্ন জায়গায় চলে গেছে। কেউ কেউ নিজ এলাকাতেও আয় রোজগারে লিপ্ত হয়েছে। চর দৌলতদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের (৮ম শ্রেণি পর্যন্ত) পরীক্ষার্থী ইতি আক্তার ও আফসানা খাতুন জানায়, তাদের ৩ জন বান্ধবীর বিয়ে হয়ে যাওয়াতে ওরা পরীক্ষা দিতে পারছে না। ওদের এভাবে ঝড়ে পড়ায় আমরা খুব ব্যাথিত। যেকোন ভাবেই হোক বাল্যবিয়ে ঠেকাতে প্রশাসনসহ সকলের কাছে আমরা দাবী জানাচ্ছি।
গোয়ালন্দ আইডিয়াল হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ফকীর আ. কাদের জানান, তার স্কুল থেকে এ বছর ৯জন মেয়ে পরীক্ষা দিচ্ছে না। পারিবারিক অভাব অনটনের কারণে অভিভাবকরা এদের পড়ালেখা বন্ধ করে দিয়েছে। কয়েকজনের বিয়ে হয়ে গেছে বলে শুনেছি।
উপজেলার একাধিক বিবাহ নিবন্ধনকারী (কাজী) দাবি করেন, প্রাপ্ত বয়স নিশ্চিত না হয়ে তারা কোন বিয়ে নিবন্ধন করেন না। তবে গোপনে শুধু মৌলভী দিয়েও অনেক বিয়ে হচ্ছে বলে তারা মন্তব্য করেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সম্প্রতি বাল্যবিয়ে হওয়ায় এক কিশোরীর মা বলেন, তার স্বামী দরিদ্র দিনমজুর। নানা প্রতিকুলতার মধ্যেও তার মেয়েকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করিয়েছে। তাছাড়া মেয়েটাকে কিছুদিন যাবৎ বখাটেরা উত্তক্ত করে আসছিল। তাই বিয়ের প্রস্তাব পাওয়ায় মেয়েটিকে বিয়ে দিয়ে দিলাম।
গোয়ালন্দ উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের মা ও শিশু স্বাস্থ্য বিষয়ক মেডিকেল অফিসার ডা. মো. আব্দুর রহমান জানান, নিয়ম মেনে বিয়ে, পদ্ধতি মেনে সংসার, বিশের পরে সন্তান এ শ্লোগান নিয়ে আমরা কাজ করলেও এ এলাকায় বাল্যবিয়ে রোধ করা যাচ্ছে না। এতে বাল্যবিয়ের শিকার কিশোরীরা মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুকির মধ্যে পড়ছে।
গোয়ালন্দ উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভুমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুল্লাহ আল মামুন এ উপজেলায় বাল্যবিয়ের প্রবনতা বৃদ্ধির বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, এ ধরনের সামাজিক সমস্যা দুর করতে সরকারী ও বেসরকারী ব্যবস্থপনা ছাড়াও দায়িত্বশীল সকল মহলের সোচ্চার হতে হবে। ইতিপূর্বে বিভিন্ন সময় বাল্যবিয়ে বন্ধের মুচলেকা নিয়ে দন্ড থেকে রেহাই দিলেও পরবর্তীতে নানান অপকৌশনে অনেক বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে বলে জেনেছি। সে কারণে সম্প্রতি কয়েকজন বর-কণেকে কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। সেই সাথে অভিভাবকদের জরিমানা করা হয়েছে। এখন থেকে বাল্যবিয়ের অভিযোগ পেলে কঠিন শাস্তি দেয়া হবে।
গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী অফিসার রুবায়েত হায়াত শিপলু জানান, অষ্টম শ্রেণিতেই অর্ধশতাধিক ছেলে-মেয়ের ঝড়ে যাওয়ার ঘটনা খুবই দুঃখজনক। তাদের অনুপস্থিতির ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট প্রধান শিক্ষকদের কাছে কারণ জানতে চাওয়া হবে। কোন মেয়ে বাল্যবিয়ের শিকার হয়ে থাকলে সে বিষয়েও ব্যবস্থা নেয়া হবে।

Tag :

সংবাদটি আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন-

গোয়ালন্দে থামছে না বাল্যবিয়ে

প্রকাশের সময় : ০৯:৩৫:৫৮ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৭ নভেম্বর ২০১৯

জনতার আদালত অনলাইন ॥ রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলায় বাল্যবিয়ের প্রবণতা কোন ভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। দরিদ্রতা ও সামাজিক নিরাপত্তা ছাড়াও কিছু অসাধু নোটারীয়ানের সহযোগিতায় বাল্যবিয়ে দিন দিন এ এলাকায় ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসন মুচলেকা নিয়ে বিয়ে বন্ধ করার দাবি করলেও কার্যত তা বন্ধ হচ্ছে না। প্রশাসনের বন্ধ করা ৯৫ শতাংশ বাল্যবিয়েই নানা কৌশলে পারবর্তীতে বিয়ে সম্পন্ন করা হয়েছে বলে অভিযোগ আছে।
গোয়ালন্দে চলমান জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষায় অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী অনুপস্থিত রয়েছে। বাল্য বিয়ে, দারিদ্রতা ও নদী ভাঙনের শিকার হওয়ায় এরা পরীক্ষা দিতে পারছে না বলে জানা গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উপজেলার পদ্মা নদী তীরবর্তী চরাঞ্চল ও নদী ভাঙ্গন কবলিত এলাকায় বাল্যবিয়ে অহরহ সংগঠিত হচ্ছে। এছাড়া পৌর শহরেও অনেক কিশোরী বাল্যবিয়ের শিকার হচ্ছে। আইন অনুযায়ী মেয়েদের বিয়ের বসয় নুন্যতম ১৮ বছর হলেও এখানে ১২/১৩ বছরের কিশোরীদের বিয়ে হচ্ছে। এক্ষেত্রে সরকারের কঠোর আইন থাকলেও তার যথাযথ প্রয়োগ নেই। আইনের চোখ ফাঁকি দিতে কিছু অসাধু নোটারীয়ানদের থেকে অভিভাবকরা তাদের মেয়েদের বয়স বাড়িয়ে অ্যাফিডেভিট নিয়ে আসছে। এছাড়া আইনগত কোন ভিত্তি না থাকলেও আ্যাফিডেভিট করে কথিত কোর্টম্যারিজ নাম দিয়ে বিয়ে সম্পন্ন করছে। কিন্তু বয়স ও বিয়ের ক্ষেত্রে অ্যাফিডেভিট কার্যকর নয় বলে সুনির্দিষ্ট সরকারী নির্দেশনা রয়েছে। এর বাইরেও বিনা কাবিনে শুধু শরীয়া মতে বাল্যবিয়ে ঘটনাও ঘটছে। এক্ষেত্রে মেয়েদের অভিষ্যত আরো অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ছে।
এছাড়া বাল্যবিয়ের কারণে বিদ্যালয় থেকে ঝড়ে পড়ার সংখ্যাও দিন দিন আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষা কেন্দ্র সূত্রে জানা যায়, এবার গোয়ালন্দ উপজেলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো হতে মোট ১৫৩৫ জন পরীক্ষার্থী জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে। এর মধ্যে শুরু থেকেই ৫২ জন পরীক্ষার্থী অনুপস্থিত রয়েছে। এর মধ্যে ৪৩ জন মেয়ে ও ৯ জন ছেলে রয়েছে।
তাদের অনুপস্থিতির ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সূত্র জানায়, মেয়েদের প্রায় সবাই বাল্য বিয়ের শিকার হওয়ায় ফরম পূরণ করা সত্ত্বেও পরীক্ষা দিতে পারছে না। ছেলেরা মূলত পরিবারে অভাবের কারণে কাজের সন্ধানে বিভিন্ন জায়গায় চলে গেছে। কেউ কেউ নিজ এলাকাতেও আয় রোজগারে লিপ্ত হয়েছে। চর দৌলতদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের (৮ম শ্রেণি পর্যন্ত) পরীক্ষার্থী ইতি আক্তার ও আফসানা খাতুন জানায়, তাদের ৩ জন বান্ধবীর বিয়ে হয়ে যাওয়াতে ওরা পরীক্ষা দিতে পারছে না। ওদের এভাবে ঝড়ে পড়ায় আমরা খুব ব্যাথিত। যেকোন ভাবেই হোক বাল্যবিয়ে ঠেকাতে প্রশাসনসহ সকলের কাছে আমরা দাবী জানাচ্ছি।
গোয়ালন্দ আইডিয়াল হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ফকীর আ. কাদের জানান, তার স্কুল থেকে এ বছর ৯জন মেয়ে পরীক্ষা দিচ্ছে না। পারিবারিক অভাব অনটনের কারণে অভিভাবকরা এদের পড়ালেখা বন্ধ করে দিয়েছে। কয়েকজনের বিয়ে হয়ে গেছে বলে শুনেছি।
উপজেলার একাধিক বিবাহ নিবন্ধনকারী (কাজী) দাবি করেন, প্রাপ্ত বয়স নিশ্চিত না হয়ে তারা কোন বিয়ে নিবন্ধন করেন না। তবে গোপনে শুধু মৌলভী দিয়েও অনেক বিয়ে হচ্ছে বলে তারা মন্তব্য করেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সম্প্রতি বাল্যবিয়ে হওয়ায় এক কিশোরীর মা বলেন, তার স্বামী দরিদ্র দিনমজুর। নানা প্রতিকুলতার মধ্যেও তার মেয়েকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করিয়েছে। তাছাড়া মেয়েটাকে কিছুদিন যাবৎ বখাটেরা উত্তক্ত করে আসছিল। তাই বিয়ের প্রস্তাব পাওয়ায় মেয়েটিকে বিয়ে দিয়ে দিলাম।
গোয়ালন্দ উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের মা ও শিশু স্বাস্থ্য বিষয়ক মেডিকেল অফিসার ডা. মো. আব্দুর রহমান জানান, নিয়ম মেনে বিয়ে, পদ্ধতি মেনে সংসার, বিশের পরে সন্তান এ শ্লোগান নিয়ে আমরা কাজ করলেও এ এলাকায় বাল্যবিয়ে রোধ করা যাচ্ছে না। এতে বাল্যবিয়ের শিকার কিশোরীরা মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুকির মধ্যে পড়ছে।
গোয়ালন্দ উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভুমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুল্লাহ আল মামুন এ উপজেলায় বাল্যবিয়ের প্রবনতা বৃদ্ধির বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, এ ধরনের সামাজিক সমস্যা দুর করতে সরকারী ও বেসরকারী ব্যবস্থপনা ছাড়াও দায়িত্বশীল সকল মহলের সোচ্চার হতে হবে। ইতিপূর্বে বিভিন্ন সময় বাল্যবিয়ে বন্ধের মুচলেকা নিয়ে দন্ড থেকে রেহাই দিলেও পরবর্তীতে নানান অপকৌশনে অনেক বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে বলে জেনেছি। সে কারণে সম্প্রতি কয়েকজন বর-কণেকে কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। সেই সাথে অভিভাবকদের জরিমানা করা হয়েছে। এখন থেকে বাল্যবিয়ের অভিযোগ পেলে কঠিন শাস্তি দেয়া হবে।
গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী অফিসার রুবায়েত হায়াত শিপলু জানান, অষ্টম শ্রেণিতেই অর্ধশতাধিক ছেলে-মেয়ের ঝড়ে যাওয়ার ঘটনা খুবই দুঃখজনক। তাদের অনুপস্থিতির ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট প্রধান শিক্ষকদের কাছে কারণ জানতে চাওয়া হবে। কোন মেয়ে বাল্যবিয়ের শিকার হয়ে থাকলে সে বিষয়েও ব্যবস্থা নেয়া হবে।