Dhaka ০১:৩১ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

লালন প্রেমী বাউল মোয়াজ্জেম হোসেন মজনু / একজন ত্যাগী সংগীত গুরু

সংবাদদাতা-
  • প্রকাশের সময় : ০৬:৪৩:০২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৫ নভেম্বর ২০১৯
  • / ১৮৪৮ জন সংবাদটি পড়েছেন

আশিফ মাহমুদ ॥
সেদিনের বিকেলটা ছিল একরকম অবসন্নই। বলা চলে অনেকটাই মলিন। অন্য বিকেলের মতো প্রাণবন্ত নয়। বাইরে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি নেই বললেই চলে। আকাশের অবস্থা যে কোন সময় রুদ্র মূর্তি হয়ে যেতে পারে। তবু মন ভীষন ব্যাকুল হারমোনিয়ামের জন্য ছোট একটি ছেলের। নাম তার মজনু। চঞ্চল মন তাই আকাশের দিকে না তাকিয়ে এবং সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে দে ছুট, ফকির ইয়াছিন মল্লিক কাকার বাড়ীর উদ্দেশ্যে। মনটা পড়ে রয়েছে ইয়াছিন কাকার হারমোনিয়ামটার প্রতি। সমগ্র তল্লাটে তখন ঐ একটি মাত্রই হারমোনিয়াম। বাড়ী থেকে ইয়াছিন কাকার বাড়ীর দূরত্ব বেশ অনেকটা পথ।
ইয়াছিন কাকার বাড়ী যাওয়ার সময়টা প্রকৃতি বলাচলে কিছুটা সদয় ছিল। হারমোনিয়াম বাজানোর নেশায় প্রকৃতির রুদ্র মূর্র্তির প্রতি এতটুকু ভ্রুক্ষেপ নেই, সে সময় মজনু নামের সেই ছোট ছেলেটির । যেতেই হবে। এবং অবশেষে গন্তব্যে। কিন্তু প্রকৃতি বাঁধ সাধল তার ফেরার পথে। প্রতিশোধ নিল প্রকৃতি ঠিকই। ছোট মজনু যখন বাড়ী ফেরার পথে। পথিমধ্যে প্রচন্ড ঝড়ের তোড়ে মজনুর ছোট দেহ তখন মাটি থেকে বেশ খানিকটা ওপরে। প্রচন্ড বাতাস তাকে ছিটকে ফেলে দেয় দুই থেকে তিন ফুট দূরত্বে। তবে সে যাত্রায় প্রাণে বেঁচে যায় সেই ছোট ছেলে মজনু। বাড়ীতে ফেরার পর পরিবারের সবার কাছে বিষয়টি জানাজানি হলে প্রথমে বকুনি খাওয়ার পালা। পরবর্তীতে নিষেধাজ্ঞা হারমোনিয়াম বাজানোর জন্য আর কোথাও যাওয়া যাবেনা। কিন্তু হারমোনিয়ামের সুর যার রন্ধ্রে রন্ধ্রে, তার কি কোন নিষেধাজ্ঞা শোভা পায় কিংবা প্রকৃতির রুদ্র মূর্তিকে ভয় পাওয়া।
সব নিষেধাজ্ঞাকে উপেক্ষা করে এবং প্রকৃতির ভয়কে অবশেষে জয় করে আজ সেই ছোট মজনু, একজন স্বার্থক নিবেদিত প্রাণ সংগীত গুরু মোয়াজ্জেম হোসেন মজনু হয়েছেন। তবে সংগীত জীবনে তাঁর মিলিমিটার থেকে মিটারে পরিণত হতে কিন্তু অনেক বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। বৈষম্যের যন্ত্রনার অভিজ্ঞতাও অর্জন করতে হয়েছে বিস্তর তার এসময়। শহরে শিল্পকলায় গান শিখতে এসে গ্রামের শিক্ষার্থী আর শহরের শিক্ষার্থীর পার্থক্যের মানদন্ডের যে তিক্ত অভিজ্ঞতা, সেটাও সঞ্চয় করতে হয়েছে তাকে। তারপরও দুর্দমনীয় একজন মেধাবি মজনুকে কেউ ঠেকাতে পারেনি তার অহংকারের সংগীত সাধনায়।
স্কুলের প্রথম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত সকল শ্রেণীতেই প্রথম স্থান যার দখলে, তাকে মেধাবি ছাড়া আর কি বলা যায়। আর কেই বা তাকে ঠেকাতে পারে। শুধু মেধার ক্ষেত্রেই নয়; খেলাধূলা, নাটক সব ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন সমান পারঙ্গম। পারিবরিক পরিমন্ডলটাও ছিল সংস্কৃতি ছোঁয়া। বাবা-কাকারা ছিলেন সংস্কৃতি প্রেমী। এলাকায় প্রায় সময়ই লেগে থাকত বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক পার্বণ। কখনও যাত্রা-পালা, নাটক, কখনও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অথবা বাউল গানের আসর। এলাকার মুরুব্বীদের আয়োজনে এসব অনুষ্ঠানে ক্ষুদে মজনুকে থাকতে হতো অনুষ্ঠান তদারকিতে পাশাপাশি অংশগ্রহণ করতে হতো একজন শিল্পী হিসেবেও। বড়দের মাঝেও ছোট মজনু যেন অপ্রতিদ্বন্দ্বি হয়ে উঠতেন সে সময় তার পারদর্শীতায়। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার সাংস্কৃতিক আবহ তাকে সব সময় যেন ঘিরে রাখত মোহাচ্ছন্ন করে। যার কারনেই সব অসম্ভব সম্ভব হয়েছে মজনুর কাছে। মোয়াজ্জেম হোসেন মজনুর ছেলেবেলার বিবরণটা ঠিক এ রকমই। যেটি তার সরল স্বীকারোক্তির মাধ্যমেই জানা।
মজনু- পুরো নাম মোয়াজ্জেম হোসেন মজনু। ‘মজনু’ বাবা-মা’র দেওয়া নাম আর ‘মোয়াজ্জেম হোসেন’ প্রাইমারী স্কুলের প্রধাণ শিক্ষক আহমদ আলী’র দেওয়া নাম। বাবা মৃত: খোরশেদ আলী যিনি ছিলেন একজন গ্রাম্য সামাজিক মাতব্বর আর মা মৃত কোহিনুর বেগম এর একজন গর্বিত সন্তানই বটে তিনি। ছেলেবেলা থেকে সংগীতই যার অভিষ্ট্য লক্ষ্য সেই মজনু এখন খুলনা বেতারের লোকসংগীতের একজন নিয়মিত শিল্পী। সংগীতের জন্য ছেলেবেলার স্বপ্ন বাস্তবায়নে যিনি এখনও আপোষহীন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন নিরলসভাবে দিনরাত। সংসারের মায়াজাল তেমন করে আবদ্ধ করে রাখতে পারেনি তাঁকে সংগীতকে গভীরভাবে ভালবাসার কারনে। গর্বিত তিন কন্যার জনক বটে তিনি কিন্তু তাদের বড় করে তোলার ক্ষেত্রে যে কৃতিত্ব মূলত: সেটির দাবীদার বলাচলে তার সহধর্মিণী দোলেনা পারভিন। আর যার কারনে বড় মেয়ে মনিরা আক্তার মিতা বর্তমানে রাজবাড়ী আবুল হোসেন কলেজে প্রভাষক হিসেবে দায়িত্বরত, মেজ মেয়ে রুবিনা আক্তার রুমী রাজবাড়ী সিভিল সার্জন অফিসে সরকারী চাকুরিতে দায়িত্বরত। আর ছোট মেয়ে দিশা মনি তার অভিষ্ট্য লক্ষ্যের জন্য স্কলারশীপ নিয়ে বর্তমানে সুদূর চীনে পড়াশোনা করছেন। এবং দিশার দৃঢ় সংকল্প পিএইচডি’র আগে কোন বিয়ে নয়। তবে বাবার ব্যাপারে তাদের কোন অভিযোগ নেই। বাবার বাউলিয়ানাকে তারা সম্মান করে আসছে বরাবর। বাবার কর্মকান্ডে তারা গর্বিত। অবশ্য মায়াজ্জেম হোসেন মজনুকে জীবনের বড় একটা অংশ কাটাতে হয়েছে পেশার জন্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। বেসরকারি এনজিও ব্র্যাক এর ঋণ কর্মসূচীর ব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে তাকে অনেকদিন। কর্মস্থলে তার পরিবারের অভাবটা অনেকখানি ঘুচিয়েছে তার সংগীত।
বেশ কিছুদিন আগে মুঠোফোনে আলাপ হলো সংগীত গুরু মোয়াজ্জেম হোসেন মজনু’র সংগে। তাঁর সংগে দেখা করার ইচ্ছের বিষয়টি ব্যাক্ত করতেই তার পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক সাদর আমন্ত্রন। তবে শর্ত ছিল দিনব্যাপি তার ওখানে অবস্থান করতে হবে। আমিও সেই শর্তে সাথে সাথে রাজি হয়ে গেলাম। মূলত: আমারও উদ্দেশ্য ছিল রথ দেখা পাশাপাশি কলা বেচাও। বিষয়টি ঠিক এমন যে, তাঁর সান্নিধ্যে তাঁর সংগীত একাডেমীটি পরিদর্শন করা আর উপরন্ত তাঁর উপর একটি ইন্টারভ্যূ করা। সেজন্য দিনব্যাপী তাঁর একাডেমীতে অবস্থানের যে মধূর আমন্ত্রনটা তিনি প্রস্তাব করলেন, তা সাথে সাথে লুফে নিলাম।
যে কথা সেই কাজ। দিনক্ষণ অনুযায়ী নির্ধারিত দিনে, যথাসময়ে উপস্থিত হলাম তার একাডেমীতে। তাঁর প্রতিষ্ঠানের আঙিনাতে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ল একটি বড় আকৃতির সাইনবোর্ড। যাতে বড় বড় অক্ষরে লেখা রয়েছে মজনু আপন শিল্পী গোষ্ঠী। সদর দরজার সামনেই একটি ফুল গাছ। সাদা রংয়ের ছোট ছোট ফুল ফুটে আছে। ফুলটি সর্ম্পকে তেমন ধারনা ছিল না আমার পূর্বে। অনেকের কাছ থেকে বিফল হয়ে একপর্যায়ে জোৎ¯œা রাণী সরকার মাসীর কাছ থেকে জানতে পারলাম, পাঁচ পাপড়ি বিশিষ্ট এ ফুলটি সাদা ফুল নামে পরিচিত। মূলত: রাধা-মাধবের চরণে এ ফুল সমর্পন করে পুজো করতে হয়। দিনটি ছিল মেঘলা। সদর দরজার কাছে যেতেই হঠাৎ বাতাসের ঝাপটায় ফুলগুলো দুলে উঠল। মনে হলো যেন আমায় সাদর সম্ভাষণ জানালো। ফুলগুলোর বিষয়টি ভেবে অবাক হলাম পাশাপাশি মনে হলো ফুলগুলোও যেন মোয়াজ্জেম হোসেন মজন’ুর জন্য নিবেদিত।
রাজবাড়ীর আলাদিপুরস্থ আলীপুর ইউনিয়ন পরিষদের ঠিক পেছনেই তাঁর স্বপ্নের মজনু আপন শিল্পী গোষ্ঠি। দরজার চৌকাঠ পেরুতেই সব কিছু চোখে পড়ল। আয়তনের দিক দিয়ে একাডেমীর ঘরটি যথার্থই ছোট এক কথায়। চারিদিকে টিন বেষ্টিত। কিন্ত তাতে কি! তবে ভেতরের পরিবেশটা যেন অহংকার করার মতো। নিজেদের সাধ্যমতো সাজিয়েছেন ঘরটিকে। ঘরের চারদিকের চার খুঁটিতে আলপনা করা চারটি মটির কলস। যেগুলো শিকের মধ্যে যতœ করে রাখা। মাথার উপরের ছাদ বেগুনি শালু দিয়ে ঢাকা আর নীচের মেঝেতে শতরঞ্জি দিয়ে আবৃত। টিনের চার দেওয়ালে তার ছাত্র-ছাত্রীদের ছবি গাঁথা, যা সত্যিই বিরল এবং ভীষন আর্টিস্টিক। সচরাচর এমনটি দেখা যায়না। কোন প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-ছাত্রীদের ছবি যা কল্পনার অতীত। কিন্তু মজনু তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের রেখেছেন খুব সযতনে। দেশীয় কিছু সৌখিন কারু শিল্পের তৈজসপত্র ঘরটিতে। এককোণে একটি সাব বক্স, যেটিকে আমার মনে হল যেন এটি মোয়াজ্জেম হোসনে মজনুর যাদুর ঝাঁপি। হাতে তৈরী সাউন্ড সিস্টেম। পাশেই একটি পুরোনো কাঠের চেয়ারে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত সম্মাননা ক্রেষ্ট সাজানো। পাশাপাশি সংগীতের বিভিন্ন ধরনের উপকরণ (দেশীয়) যা দিয়ে বাউল গান থেকে শুরু করে সব ধরনের গান পরিবেশন সম্ভব। এই ঘরটির মাহাত্বই হল, এখানে একজন শিল্পী তার শিল্পী স¦ত্বা এই ঘরেই প্রকাশ করতে যেন সব সময় মুখিয়ে থাকে, এমন একটি মায়াবী পরিবেশ ঘরটিতে। উপরন্ত ঝিকিমিকি জরি এবং ছাত্রীদের হাতে তৈরী লাভ প্রতীকের কাগজের ফুলগুলো ঝুলছে দরজার একপাশে। গুরুকে ছাত্র-ছাত্রীদের ভালবাসার প্রমাণ মিলল যেন লাভ প্রতীকের এই কাগজের ফুলগুলোর মাঝে। আমারও অবাক হওয়ার পালা ঘরটিতে প্রবেশের পর থেকেই এর ভেতরের নানারকম বৈচিত্রতার জন্য।
অবিশ্বাস্য যে বিষয়টি, সেটি এই ঘরটি থেকেই অনেক চাঁদের আলো (তাঁর ছাত্র-ছাত্রী) তাদের বিকিরণ ছড়িয়ে দিচ্ছে সারা দেশে। তাদের অনেকের সাফল্য বলা চলে আকাশচুম্বি, আর আত্ববিশ্বাস যেন হিমালয়সম। আর এ সবই সম্ভব হয়েছে একজন মোয়াজ্জেম হোসেন মজনু’র অক্লান্ত প্ররিশ্রম আর তাঁর আত্বত্যাগের মহীমায়। সংসার এর মায়াজাল রেখে দিনমান শুধু শিল্পী গড়ার স্বপ্ন তাঁর দু’চোখে সেই শুরু থেকেই। সূর্য উদয় থেকে শুর করে সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত তার গর্বের ঘরটি খোলা থাকে তার প্রাণপ্রিয় ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য। অবাধ বিচরণ তাদের এখানে বাধাহীনভাবে। আর যার কারনেই আজ মজনু আপন শিল্পী গোষ্ঠীর নাম যশ ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। পাশাপাশি স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হচ্ছে তাঁর এক একজন ছাত্র, ছাত্রী। আর এখানেই মোয়াজ্জেম হোসেন মজন’ুর স্বার্থকতা।
বাইরে থেকে তার গান এর সুর কানে প্রবেশ ঘটিয়ে ঘরে প্রবেশ করতেই গান থামিয়ে সাদর সম্ভাষন জানালেন আমাকে। অত্যন্ত সজ্জন, বিণয়ী একজন মানুষ তিনি। মনে হলো যেন অনেক দিনের সখ্যতা তাঁর সংগে আমার। আসলে গুনী মানুষরা এমনটিই হয়। তাঁর জাদুকরী কন্ঠে পরিবেশিত মায়াজড়ানো বাউল গানের পালা চলতে থাকল পাশাপাশি সমসাময়িক বিভিন্ন প্রসংগে শুরু হয়ে গেল আমাদের আলাপচারিতা সেই সংগে চা-নাস্তা চক্র।
একপর্যায়ে তাঁর প্রিয় বিষয় বাউল প্রসংগ আসতেই জানতে চাইলাম আচ্ছা- বাউল হওয়ার কি ভীষণ ইচ্ছে ছিল আপনার সেই ছোটবেলা থেকেই? আপনার ছাত্র-ছাত্রীদের যে বাউল মানসিকতায় তৈরী করছেন। কারনটা কি?
কিছুক্ষন ভেবে তিনি বলতে শুরু করলেন ঠিক এভাবেই-আসলে জীবনের প্রথম পর্যায়ে মূলত: বাউল হওয়ার ভীষণ ইচ্ছে তেমনটি ছিল না। সে সময় আমি সংগীতের অন্যান্য শাখায় বিচরণ করছি। পরবর্তীতে ফকির লালন সাইজীর গান, তাঁর সাহিত্য, তাঁর জীবনী পর্যালোচনা করে এবং সর্বোপরী তাঁর মাজার পরিদর্শন করে আমার হৃদয়ে বিশেষভাবে একটি গভীর দাগ কাটে। আর এভাবেই ফকির লালন সাইজীর বাউল সংগীতের প্রতি আকৃষ্ট হই এবং এ সংগীতের গভীর প্রেমে পড়ি। মানুষের সেবার মধ্যে সৃষ্টিকর্তার সন্তষ্টি লাভ-এ ভাবধারা আমার জীবনে একসময় ভীষনভাবে প্রতিফলিত হয়। যার ফলশ্রুতিতে এই ধারাটি আমার ছাত্র-ছাত্রী এবং আমার পরিবারের মাঝেও প্রতিফলন এবং প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছি। মূলত: এটিই কারণ। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার এই ভাবধারাটি আমার ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝেও বাউল মানসিকতা তৈরী করেছে।
আরও একটি বিষয় জানতে ইচ্ছে করছে আপনার কাছে, সেটি হলো- আমরা জেনেছি সেই শৈশব থেকেই আপনি বহুমূখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। বিদ্যালয়ে বরাবরই প্রথম হতেন, পাশাপাশি খেলাধূলা এবং সাংস্কৃতিক অংগনেও ছিলেন তুখোড়। তবে সব কিছুকে ছাপিয়ে সংগীতকে কেন এত নিবিড় করে নিলেন। এক্ষেত্রে কাদের অনুপ্রেরণা পেয়েছেন।
মজনু ভাই সহাস্যে বললেন, ঠিকই বলেছেন। আসলে সবকিছুই করতাম। পড়াশোনা, খেলাধূলায় বলা চলে ভালই ছিলাম। কিন্তু এসবের মাঝেও একটা বিষয়ের ভীষণ অভাব অনুভব করতাম- সেটি হল, ’প্রাণের আনন্দ’। কিন্তু একমাত্র সংগীতের মাঝেই বলা চলে আমি প্রাণের আনন্দে সব সময় মাতোয়ারা হয়ে থাকতাম। সংগীতের ব্যাপারটি আমাকে শয়নে স্বপনে সবসময় ভাব জগতে ডুবিয়ে রাখত এবং আমার ভাল লাগার একটি নির্ভরযোগ্য জায়গাই ছিল এই সংগীত। কেমন যেন একধরনের নেশা অনুভব করতাম সংগীতের প্রেমে পড়ে। তবে সেই নেশাই যে একসময় পেশা হয়ে দাঁড়াবে ভাবতে পারিনি। আমার বড়ভাই হাতেম আলী, আমার বাবা-মা এবং এলাকার কিছু বড় ভাই এদের অনুপ্রেরণাতে আজ আমি মোয়াজ্জেম হোসেন মজনু হতে পেরেছি। সংগীত জগতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি। তাদের ঋণ কখনও শোধ হবার নয়।
মজনু ভাই আরেকটি প্রশ্ন- এই সংগীতকে ভালবাসার পেছনে নেপথ্য কোন কারন রয়েছে কি? বিষয়টি যদি বলতেন।
তিনি বলতে শুরু করলেন- আসলে আমি যখন ছোট, সে সময় আমার বড় ভাইরা রুপবান, আপান দুলাল, আলোমতি সহ বিভিন্ন ধরনের ছোট যাত্রা যেমন কমলার বনবাস ইত্যাদি পালা মঞ্চস্থ করতো। আমি সেগুলো বড় ভাইদের হাত ধরে দেখতে যেতাম আর উপভোগ করতাম। এরপর একটু বড় হলে আমি সে সমস্থ যাত্রা পালাগুলোতে অভিনয় করার সুযোগ পাই। পাশাপাশি গান করারও সুযোগ ঘটে সে সময়। আর সেখান থেকেই আমার আত্ববিশ^াসের জায়গাটা প্রখর হয়। আর একটা ভাল লাগার জায়গা তৈরী হয়। মূলত: সেই ভাল লাগা থেকেই আমার পথ চলা শুরু। আর এখন অবধি সংগীতের এ তরী বয়ে চলা। তবে মজার বিষয় যেটি, আমি যখন গান এবং অভিনয় করতাম আমার বাবা-মা সেগুলো শুনতে এবং দেখতে যেতেন। যেদিন আমার পারফরম্যান্স ভাল হত সেদিন বাবা-মা আর ভাইদের খুব ভালবাসা পেতাম। বাবা-মা’র প্রসংগ আসতেই মজনু ভাইয়ের চেহারার মাঝে একটু পরিবর্তন দেখতে পেলাম। মনে হল শত বরষার জল তার দু’চোখে। সেসময় পরিবেশটা একটু ভারি হয়ে যাওয়াতে অন্য প্রসংগে যেতে বাধ্য হলাম।
পুনরায় তাকে জিজ্ঞেস করলাম-সংগীতের তো বিশাল অংগন। কিন্তু আপনি বাউল নির্ভর হয়ে বাউল সংগীতকে বেছে নিলেন। এর নেপথ্যে কি কোন যথার্থ কারন রয়েছে।
স্বভাবসুলভ ভঙিতেই তিনি আবার বলতে শুরু করলেন- আমি প্রায় পাঁচ বছর রাজবাড়ী শিল্পকলা একাডেমিতে ওস্তাদ দুলাল নাগ এর সান্নিধ্যে তালিম নেই। এরপর ফরিদপুরে ওস্তাদ করুণাময় অধিকারীর কাছে প্রায় একবছর তালিম গ্রহনের সুযোগ পাই।
এ সময় রবীন্দ্র সংগীত এবং নজরুল গীতির পাশাপাশি পল্লীগীতিও করতাম। পরে বাংলাদেশের বিভিন্ন সাধকের গান করতাম। তবে এ সব গানে আমার আত্বা শান্তি পেত। এই গানগুলোতে অনেক গভীর অর্থ নিহিত রয়েছে। মানুষ, সৃষ্টি, মানবতা পাশাপাশি মানুষের দায়িত্ব কর্তব্য সবকিছু। বাউল গানের ভাব-বাণী, আমার অন্তরের ভিতরে দাগ কাটে। সুরের পাশাপাশি গানের ভাব-বাণী মানুষ হিসেবে আমাকে মুগ্ধ করে। যার ফলে বাউল গানের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়।
আবার প্রশ্নে ফিরে গেলাম বর্তমান প্রজন্মের শিল্পীদের ঘিরে। কারন বর্তমান প্রজন্মের শিল্পীরা বাউল সংগীত নিয়ে যথেষ্ট কাজ করছে।
তাকে জিজ্ঞেস করলাম, বর্তমান প্রজন্মের শিল্পীদের বাউল সংগীতের প্রতি আগ্রহ কতোখানি?
তিনি এ প্রশ্নের জবাব দিলেন ঠিক এভাবে- বর্তমান প্রজন্মের শিল্পীরা বাউল গানকে আশির্বাদ হিসেবে মনে করে। কারন কোন স্থানে গান হলে বাউল গান পরিবেশনের জন্য অনুরোধ আসে। যে কোন অনুষ্ঠান, সেটা যদি কনসার্টও হয় সেখানেও একটি হলেও বাউল গান থাকে। বাউল গান একটি বিশেষ লোকাচার ও ধর্মমত। এই মতের সৃষ্টি বাংলার মাটিতে। বাউল গান যেমন জীবন-দর্শন সম্পর্কিত; তেমনি সুর সমৃদ্ধ। বাউল গান সহজ-সরল ভাষায় মানুষকে সৃষ্টি রহস্য অনুধাবনে সহায়তা করে। আর আমার মনে হয় এ কারনে বর্তমান প্রজন্মের শিল্পীরা বাউল গানে আগ্রহী হয়ে উঠছে।
পরের প্রশ্ন ছিল, বাউল সংগীত নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা কি কিছু বলবেন।
খুব দৃঢ়তার সাথেই তিনি এ প্রশ্নের জবাব দিলেন, বললেন- বাউল সংগীতের জন্য আমি মনে করি প্রতিটি ইউনিয়নে একটি করে বাউল চর্চ্চা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা দরকার এবং এ ব্যাপারে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে বাউল সংগীতের উপর কর্মশালা করা আমি মনে করি বিশেষ প্রয়োজন। আমি আমার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই বিষযগুলো নিয়ে কাজ করার পাশাপাশি সংগ্রাম করে যাব। সবচেয়ে বড় বিষয়, সংগীতের সংশ্লিষ্ট যারা তারা কখনও নিষ্ঠরু প্রকৃতির হয়না। আর বাউল যারা তারা কিন্তু নিরীহ প্রকৃতির হয়। এদের জন্য কিছু করতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করব।
বাউল সংগীতের বর্তমান হালচাল নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তার কাছে জানতে চাইলাম।
বাউল সংগীতের ক্ষেত্রে আপনি কোন বিষয়গুলোকে বর্তমানে সমস্যা হিসেবে মনে করেন। এ থেকে উত্তরনের কোন উপায় আছে কি?
তিনি খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলতে শুরু করলেন- আসলে বাঊল সংগীতের বর্তমান সমস্যার ক্ষেত্রে প্রথমত: যে বিষয়টি আমার কাছে অন্তরায় মনে হয় সেটি হল এ সেক্টরে পৃষ্ঠপোষকতার ভীষন অভাব। দারিদ্রতা এক্ষেত্রে আরও একটি অন্তরা। কারন বাউল শিল্পীদের অধিকাংশই বলা চলে দরিদ্র। বাউল সংগীত মিডিয়াতে প্রচারের ক্ষেত্রে এখনও সমস্যা রয়েছে। আবার যোগ্য শিল্পীরাও সুযোগ পাচ্ছে কম।
আর উত্তরনের ক্ষেত্রে আমি মনে করি সরকারি ও বেসরকারি উদ্দ্যোগে পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন। দরিদ্র শিল্পীদের অর্থনৈতিক সহযোগীতা নিশ্চিত করা পাশাপাশি বাউল শিল্পীদের পরিবেশনা মিডিয়াতে বেশি করে প্রচার করা। কারন বাউল গান এর প্রতি বর্তমানে মানুষের আগ্রহ অনেকখানি বেড়েছে।
পরের প্রশ্নটি মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল তার সংগীত জীবনের প্রাপ্তি -অপ্রাপ্তির বিষয়ে। প্রশ্ন ছিল-
আপনার সংগীত জীবনে চলার পথে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসেবে কি কোন গরমিল রয়েছে।
এ প্রশ্নটিও খুব চিন্তা এবং সময় নিয়ে বলতে থাকলেন ঠিক এভাবে- সংগীত জীবনে আমি অনেক পেয়েছি। আমার প্রাপ্তির খাতা বেশ সমৃদ্ধ। প্রাপ্তির ক্ষেত্রে আমি বলব মূলত: অনেক ছোট কাল থেকেই সংগীত জগতের সংগে আমি ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। সংগীত সংশ্লিস্টতার কারণে অনেক মানুষের ভালোবাসা যেমন পেয়েছি; তেমনি পেয়েছি অনেক সন্মানও। এছাড়াও অনেক বড় মাপের প্রতিষ্ঠান, বড় বড় পদের মানুষের সাথে পরিচয় হওয়ার সুযোগ হয়েছে এই সংগীতের কারনেই। যা আদৌও সংগীত ছাড়া সম্ভব হতো না। আর যে বিষয়টি উল্লেখযোগ্য সেটি সংগীতের কারনে আমি আমার প্রাণপ্রিয় ছাত্র-ছাত্র পেয়েছি। ওরা আমার জন্য ওদের সর্বোচ্চটা দেওয়ার চেষ্টা করছে এবং এখন অবধি করে যাচ্ছে। এটা আমার জন্য এক বিশাল প্রাপ্তি। যার জন্য আমার এ প্রাপ্তিতে সৃষ্টিকর্তার কাছে শোকরিয়া আদায় করি। আর অপ্রাপ্তির খাতাটি বলতে গেলে যৎসামন্যই। তবে এখনও আমার অনেক স্বপ্ন পূরণ হয়নি। বাউল গান সারা বাংলাদেশে এখনও সেভাবে বিকশিত হয়নি; এক্ষেত্রে অপসংস্কৃতি বাঁধা হিসাবে কাজ করছে। এক্ষেত্রে আমার প্রাপ্তিটা তখনই শতভাগ পূর্ণ হবে যখন বাউল গান সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়বে আনাচে কানাচে। জানিনা ততদিন আমি বেঁচে থাকব কিনা।
পরিবার প্রসংগ আসতেই, তার পক্ষ থেকে সরেজমিনে পরিদর্শনের প্রস্তাব। আর প্রস্তাবটি বুঝে ওঠার আগেই ততক্ষনে তার গৃহে প্রবেশ ঘটে গেছে আমার। একাডেমী থেকে বাসার দূরত্ব মাত্র পাঁচ মিনিটের পথ। বুঝে ফেললাম মানুষকে বশীকরণ করার ক্ষমতা তার কতখানি। তা না হলে মাত্র একদিনের সম্পর্কে তিনি কিভাবে আমাকে তার বাড়ীতে নিয়ে যেতে পারলেন। এখানেও তাঁর সেই বিণয়। যার কারনে আমি তার প্রতিটি প্রস্তাব মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছিলাম বরাবরই। তবে তার গৃেহ প্রবেশের পর যে বিষয়টি বেশী প্রাধান্য পেল সেটি সেই মহীয়সী নারীর দর্শণ পাওয়ার সৌভাগ্য এবং সুযোগ। যিনি মজনু ভাই এর অনুপস্থিতিতেও তার মেয়েদের মানুষ করতে পেরেছেন। আরও একজন বিনয়ী মানুষ তার সহধর্মিণী। প্রথম দর্শনেই তার ব্যবহারে বুঝতে পারলাম সত্যিই একজন দোলেনা পারভীন একজন মজনুর জন্য কতখানি সহায়ক। স্বামীর সংগীত সাধনার সংগ্রামকে তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন বলেই তিনি স্বামীকে সংসারের মায়াজালে ততটা বেঁধে রাখেননি। পাছে স্বামীর ব্রত সাধনায় ব্যাঘাত ঘটে। সত্যিই তার এই আত্বত্যাগ মহানুভবতার বিশাল পরিচয় বহন করে। অতিথি পরায়নতায়ও যে তিনি কম যান না সেটিও তিনি প্রমাণ করে ছাড়লেন। দুপুরের আহার না করে বাসা থেকে বের হতে পারলাম না। তার সেই রান্ন্া করা পোলাও এবং ভুনা মাংসের স্বাদ আমার মায়ের হাতের রান্নার স্বাদ মনে করিয়ে দিল সে মুহুর্তে।
আহার সমাপনান্তে পুনরায় একাডেমিতে প্রবেশ । আবার সেই আলাপচারিতা, গান শোনা। পড়ন্ত বিকেল গড়িয়ে সন্ধার আভা সেসময় আকাশে। বিদায়ের মুহুর্ত ঘনিয়ে এলো। ঠিক সে সময়ে তার কাছে আমার শেষ প্রশ্নটি ছিল এরকম।
কথিত আছে আপনি আপনার প্রতিষ্ঠান মজনু আপন শিল্পী গোষ্ঠীর ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য একজন নিবেদিত প্রাণ সংগীত গুরু। তাদের পেছনে আপনি দিনরাত নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন, এ প্রসংগে যদি কিছু বলতেন।
প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলতে শুরু করলেন এভাবে- নিবেদিত প্রাণ কিনা জানিনা। তবে ওদেরকে আমি আমার নিজের সন্তানদের মতোই মনে করি। ওদের মাঝে আমি আজীবন বেঁচে থাকতে চাই। আমি পৃথিবি ছেড়ে চলে গেলেও ওরা আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে আমার দেওয়া দীক্ষার মাধ্যমে। যে দীক্ষা আমি ওদের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছি এবং এখনও দিয়ে যাচ্ছি। এটা আমার দৃঢ় বিশ^াস। হয়তো পৃথিবীতে চিরদিন বেঁচে থাকবো না; তবে আমার স্বপ্ন বীজ ওরা বয়ে নেবে।
আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার ওদের যে কোন কষ্ট আমাকে ভীষনভাবে ব্যথিত করে। আমার এ প্রতিষ্ঠানটি ‘মজনু আপন শিল্পী গোষ্ঠী’ যাতে বাংলাদেশের মধ্যে ভাল পর্যায়ে থাকে, এই স্বপ্ন আমি এখনও বুকে ধারন করে যাচ্ছি। পাশাপাশি আমার সন্তানরা এগিয়ে চলবে সংগীতকে একান্ত ভালবেসে, এটাই আমার প্রত্যাশা। এ কথাগুলো বলা শেষ হলে মজনু’র দু’চোখ আবারও সেই শত বরষার জল দেখতে পেলাম। তবে এ সুখের কান্নার রেশ থাকতে থাকতেই আমি তাঁর অনুমতির অপেক্ষায় রইলাম বিদায়ের জন্য। নিজেকে সংবরণ করে তিনি আমাকে পুনরায় তার সেই বিনয়ের দৃষ্টান্ত প্রদর্শন করলেন। বিদায় দেওয়াটাও যে বিনয়ের অংশ হতে পারে তা দেখতে পেলাম সে মুহূর্তে এবং যা শিক্ষনীয়ও বটে। তবে বিদায়ের ঘন্টা বেজেছে অনেক পরে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাতে।
একাডেমী থেকে বেরিয়ে রিক্সা যোগে যখন বাসার উদ্দেশ্যে তখন বেশ রাত। ফাঁকা মহাসড়কে রিক্সাটি এগিয়ে চলছে আর আমার মনের ভেতর তখন মজনুুর মায়াবি কন্ঠে পরিবেশিত ফকির লালন সাইজীর সেই গানটির কলিটি একধরনের অনুরণন ছড়াচ্ছে- “মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি”। মনে মনে আমিও গাইবার চেষ্টা করলাম।
সাক্ষাৎকার গ্রহণ: আশিফ মাহমুদ
আলোকচিত্রী: সংগীতা সাহা

Tag :

সংবাদটি আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন-

লালন প্রেমী বাউল মোয়াজ্জেম হোসেন মজনু / একজন ত্যাগী সংগীত গুরু

প্রকাশের সময় : ০৬:৪৩:০২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৫ নভেম্বর ২০১৯

আশিফ মাহমুদ ॥
সেদিনের বিকেলটা ছিল একরকম অবসন্নই। বলা চলে অনেকটাই মলিন। অন্য বিকেলের মতো প্রাণবন্ত নয়। বাইরে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি নেই বললেই চলে। আকাশের অবস্থা যে কোন সময় রুদ্র মূর্তি হয়ে যেতে পারে। তবু মন ভীষন ব্যাকুল হারমোনিয়ামের জন্য ছোট একটি ছেলের। নাম তার মজনু। চঞ্চল মন তাই আকাশের দিকে না তাকিয়ে এবং সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে দে ছুট, ফকির ইয়াছিন মল্লিক কাকার বাড়ীর উদ্দেশ্যে। মনটা পড়ে রয়েছে ইয়াছিন কাকার হারমোনিয়ামটার প্রতি। সমগ্র তল্লাটে তখন ঐ একটি মাত্রই হারমোনিয়াম। বাড়ী থেকে ইয়াছিন কাকার বাড়ীর দূরত্ব বেশ অনেকটা পথ।
ইয়াছিন কাকার বাড়ী যাওয়ার সময়টা প্রকৃতি বলাচলে কিছুটা সদয় ছিল। হারমোনিয়াম বাজানোর নেশায় প্রকৃতির রুদ্র মূর্র্তির প্রতি এতটুকু ভ্রুক্ষেপ নেই, সে সময় মজনু নামের সেই ছোট ছেলেটির । যেতেই হবে। এবং অবশেষে গন্তব্যে। কিন্তু প্রকৃতি বাঁধ সাধল তার ফেরার পথে। প্রতিশোধ নিল প্রকৃতি ঠিকই। ছোট মজনু যখন বাড়ী ফেরার পথে। পথিমধ্যে প্রচন্ড ঝড়ের তোড়ে মজনুর ছোট দেহ তখন মাটি থেকে বেশ খানিকটা ওপরে। প্রচন্ড বাতাস তাকে ছিটকে ফেলে দেয় দুই থেকে তিন ফুট দূরত্বে। তবে সে যাত্রায় প্রাণে বেঁচে যায় সেই ছোট ছেলে মজনু। বাড়ীতে ফেরার পর পরিবারের সবার কাছে বিষয়টি জানাজানি হলে প্রথমে বকুনি খাওয়ার পালা। পরবর্তীতে নিষেধাজ্ঞা হারমোনিয়াম বাজানোর জন্য আর কোথাও যাওয়া যাবেনা। কিন্তু হারমোনিয়ামের সুর যার রন্ধ্রে রন্ধ্রে, তার কি কোন নিষেধাজ্ঞা শোভা পায় কিংবা প্রকৃতির রুদ্র মূর্তিকে ভয় পাওয়া।
সব নিষেধাজ্ঞাকে উপেক্ষা করে এবং প্রকৃতির ভয়কে অবশেষে জয় করে আজ সেই ছোট মজনু, একজন স্বার্থক নিবেদিত প্রাণ সংগীত গুরু মোয়াজ্জেম হোসেন মজনু হয়েছেন। তবে সংগীত জীবনে তাঁর মিলিমিটার থেকে মিটারে পরিণত হতে কিন্তু অনেক বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। বৈষম্যের যন্ত্রনার অভিজ্ঞতাও অর্জন করতে হয়েছে বিস্তর তার এসময়। শহরে শিল্পকলায় গান শিখতে এসে গ্রামের শিক্ষার্থী আর শহরের শিক্ষার্থীর পার্থক্যের মানদন্ডের যে তিক্ত অভিজ্ঞতা, সেটাও সঞ্চয় করতে হয়েছে তাকে। তারপরও দুর্দমনীয় একজন মেধাবি মজনুকে কেউ ঠেকাতে পারেনি তার অহংকারের সংগীত সাধনায়।
স্কুলের প্রথম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত সকল শ্রেণীতেই প্রথম স্থান যার দখলে, তাকে মেধাবি ছাড়া আর কি বলা যায়। আর কেই বা তাকে ঠেকাতে পারে। শুধু মেধার ক্ষেত্রেই নয়; খেলাধূলা, নাটক সব ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন সমান পারঙ্গম। পারিবরিক পরিমন্ডলটাও ছিল সংস্কৃতি ছোঁয়া। বাবা-কাকারা ছিলেন সংস্কৃতি প্রেমী। এলাকায় প্রায় সময়ই লেগে থাকত বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক পার্বণ। কখনও যাত্রা-পালা, নাটক, কখনও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অথবা বাউল গানের আসর। এলাকার মুরুব্বীদের আয়োজনে এসব অনুষ্ঠানে ক্ষুদে মজনুকে থাকতে হতো অনুষ্ঠান তদারকিতে পাশাপাশি অংশগ্রহণ করতে হতো একজন শিল্পী হিসেবেও। বড়দের মাঝেও ছোট মজনু যেন অপ্রতিদ্বন্দ্বি হয়ে উঠতেন সে সময় তার পারদর্শীতায়। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার সাংস্কৃতিক আবহ তাকে সব সময় যেন ঘিরে রাখত মোহাচ্ছন্ন করে। যার কারনেই সব অসম্ভব সম্ভব হয়েছে মজনুর কাছে। মোয়াজ্জেম হোসেন মজনুর ছেলেবেলার বিবরণটা ঠিক এ রকমই। যেটি তার সরল স্বীকারোক্তির মাধ্যমেই জানা।
মজনু- পুরো নাম মোয়াজ্জেম হোসেন মজনু। ‘মজনু’ বাবা-মা’র দেওয়া নাম আর ‘মোয়াজ্জেম হোসেন’ প্রাইমারী স্কুলের প্রধাণ শিক্ষক আহমদ আলী’র দেওয়া নাম। বাবা মৃত: খোরশেদ আলী যিনি ছিলেন একজন গ্রাম্য সামাজিক মাতব্বর আর মা মৃত কোহিনুর বেগম এর একজন গর্বিত সন্তানই বটে তিনি। ছেলেবেলা থেকে সংগীতই যার অভিষ্ট্য লক্ষ্য সেই মজনু এখন খুলনা বেতারের লোকসংগীতের একজন নিয়মিত শিল্পী। সংগীতের জন্য ছেলেবেলার স্বপ্ন বাস্তবায়নে যিনি এখনও আপোষহীন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন নিরলসভাবে দিনরাত। সংসারের মায়াজাল তেমন করে আবদ্ধ করে রাখতে পারেনি তাঁকে সংগীতকে গভীরভাবে ভালবাসার কারনে। গর্বিত তিন কন্যার জনক বটে তিনি কিন্তু তাদের বড় করে তোলার ক্ষেত্রে যে কৃতিত্ব মূলত: সেটির দাবীদার বলাচলে তার সহধর্মিণী দোলেনা পারভিন। আর যার কারনে বড় মেয়ে মনিরা আক্তার মিতা বর্তমানে রাজবাড়ী আবুল হোসেন কলেজে প্রভাষক হিসেবে দায়িত্বরত, মেজ মেয়ে রুবিনা আক্তার রুমী রাজবাড়ী সিভিল সার্জন অফিসে সরকারী চাকুরিতে দায়িত্বরত। আর ছোট মেয়ে দিশা মনি তার অভিষ্ট্য লক্ষ্যের জন্য স্কলারশীপ নিয়ে বর্তমানে সুদূর চীনে পড়াশোনা করছেন। এবং দিশার দৃঢ় সংকল্প পিএইচডি’র আগে কোন বিয়ে নয়। তবে বাবার ব্যাপারে তাদের কোন অভিযোগ নেই। বাবার বাউলিয়ানাকে তারা সম্মান করে আসছে বরাবর। বাবার কর্মকান্ডে তারা গর্বিত। অবশ্য মায়াজ্জেম হোসেন মজনুকে জীবনের বড় একটা অংশ কাটাতে হয়েছে পেশার জন্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। বেসরকারি এনজিও ব্র্যাক এর ঋণ কর্মসূচীর ব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে তাকে অনেকদিন। কর্মস্থলে তার পরিবারের অভাবটা অনেকখানি ঘুচিয়েছে তার সংগীত।
বেশ কিছুদিন আগে মুঠোফোনে আলাপ হলো সংগীত গুরু মোয়াজ্জেম হোসেন মজনু’র সংগে। তাঁর সংগে দেখা করার ইচ্ছের বিষয়টি ব্যাক্ত করতেই তার পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক সাদর আমন্ত্রন। তবে শর্ত ছিল দিনব্যাপি তার ওখানে অবস্থান করতে হবে। আমিও সেই শর্তে সাথে সাথে রাজি হয়ে গেলাম। মূলত: আমারও উদ্দেশ্য ছিল রথ দেখা পাশাপাশি কলা বেচাও। বিষয়টি ঠিক এমন যে, তাঁর সান্নিধ্যে তাঁর সংগীত একাডেমীটি পরিদর্শন করা আর উপরন্ত তাঁর উপর একটি ইন্টারভ্যূ করা। সেজন্য দিনব্যাপী তাঁর একাডেমীতে অবস্থানের যে মধূর আমন্ত্রনটা তিনি প্রস্তাব করলেন, তা সাথে সাথে লুফে নিলাম।
যে কথা সেই কাজ। দিনক্ষণ অনুযায়ী নির্ধারিত দিনে, যথাসময়ে উপস্থিত হলাম তার একাডেমীতে। তাঁর প্রতিষ্ঠানের আঙিনাতে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ল একটি বড় আকৃতির সাইনবোর্ড। যাতে বড় বড় অক্ষরে লেখা রয়েছে মজনু আপন শিল্পী গোষ্ঠী। সদর দরজার সামনেই একটি ফুল গাছ। সাদা রংয়ের ছোট ছোট ফুল ফুটে আছে। ফুলটি সর্ম্পকে তেমন ধারনা ছিল না আমার পূর্বে। অনেকের কাছ থেকে বিফল হয়ে একপর্যায়ে জোৎ¯œা রাণী সরকার মাসীর কাছ থেকে জানতে পারলাম, পাঁচ পাপড়ি বিশিষ্ট এ ফুলটি সাদা ফুল নামে পরিচিত। মূলত: রাধা-মাধবের চরণে এ ফুল সমর্পন করে পুজো করতে হয়। দিনটি ছিল মেঘলা। সদর দরজার কাছে যেতেই হঠাৎ বাতাসের ঝাপটায় ফুলগুলো দুলে উঠল। মনে হলো যেন আমায় সাদর সম্ভাষণ জানালো। ফুলগুলোর বিষয়টি ভেবে অবাক হলাম পাশাপাশি মনে হলো ফুলগুলোও যেন মোয়াজ্জেম হোসেন মজন’ুর জন্য নিবেদিত।
রাজবাড়ীর আলাদিপুরস্থ আলীপুর ইউনিয়ন পরিষদের ঠিক পেছনেই তাঁর স্বপ্নের মজনু আপন শিল্পী গোষ্ঠি। দরজার চৌকাঠ পেরুতেই সব কিছু চোখে পড়ল। আয়তনের দিক দিয়ে একাডেমীর ঘরটি যথার্থই ছোট এক কথায়। চারিদিকে টিন বেষ্টিত। কিন্ত তাতে কি! তবে ভেতরের পরিবেশটা যেন অহংকার করার মতো। নিজেদের সাধ্যমতো সাজিয়েছেন ঘরটিকে। ঘরের চারদিকের চার খুঁটিতে আলপনা করা চারটি মটির কলস। যেগুলো শিকের মধ্যে যতœ করে রাখা। মাথার উপরের ছাদ বেগুনি শালু দিয়ে ঢাকা আর নীচের মেঝেতে শতরঞ্জি দিয়ে আবৃত। টিনের চার দেওয়ালে তার ছাত্র-ছাত্রীদের ছবি গাঁথা, যা সত্যিই বিরল এবং ভীষন আর্টিস্টিক। সচরাচর এমনটি দেখা যায়না। কোন প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-ছাত্রীদের ছবি যা কল্পনার অতীত। কিন্তু মজনু তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের রেখেছেন খুব সযতনে। দেশীয় কিছু সৌখিন কারু শিল্পের তৈজসপত্র ঘরটিতে। এককোণে একটি সাব বক্স, যেটিকে আমার মনে হল যেন এটি মোয়াজ্জেম হোসনে মজনুর যাদুর ঝাঁপি। হাতে তৈরী সাউন্ড সিস্টেম। পাশেই একটি পুরোনো কাঠের চেয়ারে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত সম্মাননা ক্রেষ্ট সাজানো। পাশাপাশি সংগীতের বিভিন্ন ধরনের উপকরণ (দেশীয়) যা দিয়ে বাউল গান থেকে শুরু করে সব ধরনের গান পরিবেশন সম্ভব। এই ঘরটির মাহাত্বই হল, এখানে একজন শিল্পী তার শিল্পী স¦ত্বা এই ঘরেই প্রকাশ করতে যেন সব সময় মুখিয়ে থাকে, এমন একটি মায়াবী পরিবেশ ঘরটিতে। উপরন্ত ঝিকিমিকি জরি এবং ছাত্রীদের হাতে তৈরী লাভ প্রতীকের কাগজের ফুলগুলো ঝুলছে দরজার একপাশে। গুরুকে ছাত্র-ছাত্রীদের ভালবাসার প্রমাণ মিলল যেন লাভ প্রতীকের এই কাগজের ফুলগুলোর মাঝে। আমারও অবাক হওয়ার পালা ঘরটিতে প্রবেশের পর থেকেই এর ভেতরের নানারকম বৈচিত্রতার জন্য।
অবিশ্বাস্য যে বিষয়টি, সেটি এই ঘরটি থেকেই অনেক চাঁদের আলো (তাঁর ছাত্র-ছাত্রী) তাদের বিকিরণ ছড়িয়ে দিচ্ছে সারা দেশে। তাদের অনেকের সাফল্য বলা চলে আকাশচুম্বি, আর আত্ববিশ্বাস যেন হিমালয়সম। আর এ সবই সম্ভব হয়েছে একজন মোয়াজ্জেম হোসেন মজনু’র অক্লান্ত প্ররিশ্রম আর তাঁর আত্বত্যাগের মহীমায়। সংসার এর মায়াজাল রেখে দিনমান শুধু শিল্পী গড়ার স্বপ্ন তাঁর দু’চোখে সেই শুরু থেকেই। সূর্য উদয় থেকে শুর করে সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত তার গর্বের ঘরটি খোলা থাকে তার প্রাণপ্রিয় ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য। অবাধ বিচরণ তাদের এখানে বাধাহীনভাবে। আর যার কারনেই আজ মজনু আপন শিল্পী গোষ্ঠীর নাম যশ ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। পাশাপাশি স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হচ্ছে তাঁর এক একজন ছাত্র, ছাত্রী। আর এখানেই মোয়াজ্জেম হোসেন মজন’ুর স্বার্থকতা।
বাইরে থেকে তার গান এর সুর কানে প্রবেশ ঘটিয়ে ঘরে প্রবেশ করতেই গান থামিয়ে সাদর সম্ভাষন জানালেন আমাকে। অত্যন্ত সজ্জন, বিণয়ী একজন মানুষ তিনি। মনে হলো যেন অনেক দিনের সখ্যতা তাঁর সংগে আমার। আসলে গুনী মানুষরা এমনটিই হয়। তাঁর জাদুকরী কন্ঠে পরিবেশিত মায়াজড়ানো বাউল গানের পালা চলতে থাকল পাশাপাশি সমসাময়িক বিভিন্ন প্রসংগে শুরু হয়ে গেল আমাদের আলাপচারিতা সেই সংগে চা-নাস্তা চক্র।
একপর্যায়ে তাঁর প্রিয় বিষয় বাউল প্রসংগ আসতেই জানতে চাইলাম আচ্ছা- বাউল হওয়ার কি ভীষণ ইচ্ছে ছিল আপনার সেই ছোটবেলা থেকেই? আপনার ছাত্র-ছাত্রীদের যে বাউল মানসিকতায় তৈরী করছেন। কারনটা কি?
কিছুক্ষন ভেবে তিনি বলতে শুরু করলেন ঠিক এভাবেই-আসলে জীবনের প্রথম পর্যায়ে মূলত: বাউল হওয়ার ভীষণ ইচ্ছে তেমনটি ছিল না। সে সময় আমি সংগীতের অন্যান্য শাখায় বিচরণ করছি। পরবর্তীতে ফকির লালন সাইজীর গান, তাঁর সাহিত্য, তাঁর জীবনী পর্যালোচনা করে এবং সর্বোপরী তাঁর মাজার পরিদর্শন করে আমার হৃদয়ে বিশেষভাবে একটি গভীর দাগ কাটে। আর এভাবেই ফকির লালন সাইজীর বাউল সংগীতের প্রতি আকৃষ্ট হই এবং এ সংগীতের গভীর প্রেমে পড়ি। মানুষের সেবার মধ্যে সৃষ্টিকর্তার সন্তষ্টি লাভ-এ ভাবধারা আমার জীবনে একসময় ভীষনভাবে প্রতিফলিত হয়। যার ফলশ্রুতিতে এই ধারাটি আমার ছাত্র-ছাত্রী এবং আমার পরিবারের মাঝেও প্রতিফলন এবং প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছি। মূলত: এটিই কারণ। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার এই ভাবধারাটি আমার ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝেও বাউল মানসিকতা তৈরী করেছে।
আরও একটি বিষয় জানতে ইচ্ছে করছে আপনার কাছে, সেটি হলো- আমরা জেনেছি সেই শৈশব থেকেই আপনি বহুমূখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। বিদ্যালয়ে বরাবরই প্রথম হতেন, পাশাপাশি খেলাধূলা এবং সাংস্কৃতিক অংগনেও ছিলেন তুখোড়। তবে সব কিছুকে ছাপিয়ে সংগীতকে কেন এত নিবিড় করে নিলেন। এক্ষেত্রে কাদের অনুপ্রেরণা পেয়েছেন।
মজনু ভাই সহাস্যে বললেন, ঠিকই বলেছেন। আসলে সবকিছুই করতাম। পড়াশোনা, খেলাধূলায় বলা চলে ভালই ছিলাম। কিন্তু এসবের মাঝেও একটা বিষয়ের ভীষণ অভাব অনুভব করতাম- সেটি হল, ’প্রাণের আনন্দ’। কিন্তু একমাত্র সংগীতের মাঝেই বলা চলে আমি প্রাণের আনন্দে সব সময় মাতোয়ারা হয়ে থাকতাম। সংগীতের ব্যাপারটি আমাকে শয়নে স্বপনে সবসময় ভাব জগতে ডুবিয়ে রাখত এবং আমার ভাল লাগার একটি নির্ভরযোগ্য জায়গাই ছিল এই সংগীত। কেমন যেন একধরনের নেশা অনুভব করতাম সংগীতের প্রেমে পড়ে। তবে সেই নেশাই যে একসময় পেশা হয়ে দাঁড়াবে ভাবতে পারিনি। আমার বড়ভাই হাতেম আলী, আমার বাবা-মা এবং এলাকার কিছু বড় ভাই এদের অনুপ্রেরণাতে আজ আমি মোয়াজ্জেম হোসেন মজনু হতে পেরেছি। সংগীত জগতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি। তাদের ঋণ কখনও শোধ হবার নয়।
মজনু ভাই আরেকটি প্রশ্ন- এই সংগীতকে ভালবাসার পেছনে নেপথ্য কোন কারন রয়েছে কি? বিষয়টি যদি বলতেন।
তিনি বলতে শুরু করলেন- আসলে আমি যখন ছোট, সে সময় আমার বড় ভাইরা রুপবান, আপান দুলাল, আলোমতি সহ বিভিন্ন ধরনের ছোট যাত্রা যেমন কমলার বনবাস ইত্যাদি পালা মঞ্চস্থ করতো। আমি সেগুলো বড় ভাইদের হাত ধরে দেখতে যেতাম আর উপভোগ করতাম। এরপর একটু বড় হলে আমি সে সমস্থ যাত্রা পালাগুলোতে অভিনয় করার সুযোগ পাই। পাশাপাশি গান করারও সুযোগ ঘটে সে সময়। আর সেখান থেকেই আমার আত্ববিশ^াসের জায়গাটা প্রখর হয়। আর একটা ভাল লাগার জায়গা তৈরী হয়। মূলত: সেই ভাল লাগা থেকেই আমার পথ চলা শুরু। আর এখন অবধি সংগীতের এ তরী বয়ে চলা। তবে মজার বিষয় যেটি, আমি যখন গান এবং অভিনয় করতাম আমার বাবা-মা সেগুলো শুনতে এবং দেখতে যেতেন। যেদিন আমার পারফরম্যান্স ভাল হত সেদিন বাবা-মা আর ভাইদের খুব ভালবাসা পেতাম। বাবা-মা’র প্রসংগ আসতেই মজনু ভাইয়ের চেহারার মাঝে একটু পরিবর্তন দেখতে পেলাম। মনে হল শত বরষার জল তার দু’চোখে। সেসময় পরিবেশটা একটু ভারি হয়ে যাওয়াতে অন্য প্রসংগে যেতে বাধ্য হলাম।
পুনরায় তাকে জিজ্ঞেস করলাম-সংগীতের তো বিশাল অংগন। কিন্তু আপনি বাউল নির্ভর হয়ে বাউল সংগীতকে বেছে নিলেন। এর নেপথ্যে কি কোন যথার্থ কারন রয়েছে।
স্বভাবসুলভ ভঙিতেই তিনি আবার বলতে শুরু করলেন- আমি প্রায় পাঁচ বছর রাজবাড়ী শিল্পকলা একাডেমিতে ওস্তাদ দুলাল নাগ এর সান্নিধ্যে তালিম নেই। এরপর ফরিদপুরে ওস্তাদ করুণাময় অধিকারীর কাছে প্রায় একবছর তালিম গ্রহনের সুযোগ পাই।
এ সময় রবীন্দ্র সংগীত এবং নজরুল গীতির পাশাপাশি পল্লীগীতিও করতাম। পরে বাংলাদেশের বিভিন্ন সাধকের গান করতাম। তবে এ সব গানে আমার আত্বা শান্তি পেত। এই গানগুলোতে অনেক গভীর অর্থ নিহিত রয়েছে। মানুষ, সৃষ্টি, মানবতা পাশাপাশি মানুষের দায়িত্ব কর্তব্য সবকিছু। বাউল গানের ভাব-বাণী, আমার অন্তরের ভিতরে দাগ কাটে। সুরের পাশাপাশি গানের ভাব-বাণী মানুষ হিসেবে আমাকে মুগ্ধ করে। যার ফলে বাউল গানের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়।
আবার প্রশ্নে ফিরে গেলাম বর্তমান প্রজন্মের শিল্পীদের ঘিরে। কারন বর্তমান প্রজন্মের শিল্পীরা বাউল সংগীত নিয়ে যথেষ্ট কাজ করছে।
তাকে জিজ্ঞেস করলাম, বর্তমান প্রজন্মের শিল্পীদের বাউল সংগীতের প্রতি আগ্রহ কতোখানি?
তিনি এ প্রশ্নের জবাব দিলেন ঠিক এভাবে- বর্তমান প্রজন্মের শিল্পীরা বাউল গানকে আশির্বাদ হিসেবে মনে করে। কারন কোন স্থানে গান হলে বাউল গান পরিবেশনের জন্য অনুরোধ আসে। যে কোন অনুষ্ঠান, সেটা যদি কনসার্টও হয় সেখানেও একটি হলেও বাউল গান থাকে। বাউল গান একটি বিশেষ লোকাচার ও ধর্মমত। এই মতের সৃষ্টি বাংলার মাটিতে। বাউল গান যেমন জীবন-দর্শন সম্পর্কিত; তেমনি সুর সমৃদ্ধ। বাউল গান সহজ-সরল ভাষায় মানুষকে সৃষ্টি রহস্য অনুধাবনে সহায়তা করে। আর আমার মনে হয় এ কারনে বর্তমান প্রজন্মের শিল্পীরা বাউল গানে আগ্রহী হয়ে উঠছে।
পরের প্রশ্ন ছিল, বাউল সংগীত নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা কি কিছু বলবেন।
খুব দৃঢ়তার সাথেই তিনি এ প্রশ্নের জবাব দিলেন, বললেন- বাউল সংগীতের জন্য আমি মনে করি প্রতিটি ইউনিয়নে একটি করে বাউল চর্চ্চা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা দরকার এবং এ ব্যাপারে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে বাউল সংগীতের উপর কর্মশালা করা আমি মনে করি বিশেষ প্রয়োজন। আমি আমার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই বিষযগুলো নিয়ে কাজ করার পাশাপাশি সংগ্রাম করে যাব। সবচেয়ে বড় বিষয়, সংগীতের সংশ্লিষ্ট যারা তারা কখনও নিষ্ঠরু প্রকৃতির হয়না। আর বাউল যারা তারা কিন্তু নিরীহ প্রকৃতির হয়। এদের জন্য কিছু করতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করব।
বাউল সংগীতের বর্তমান হালচাল নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তার কাছে জানতে চাইলাম।
বাউল সংগীতের ক্ষেত্রে আপনি কোন বিষয়গুলোকে বর্তমানে সমস্যা হিসেবে মনে করেন। এ থেকে উত্তরনের কোন উপায় আছে কি?
তিনি খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলতে শুরু করলেন- আসলে বাঊল সংগীতের বর্তমান সমস্যার ক্ষেত্রে প্রথমত: যে বিষয়টি আমার কাছে অন্তরায় মনে হয় সেটি হল এ সেক্টরে পৃষ্ঠপোষকতার ভীষন অভাব। দারিদ্রতা এক্ষেত্রে আরও একটি অন্তরা। কারন বাউল শিল্পীদের অধিকাংশই বলা চলে দরিদ্র। বাউল সংগীত মিডিয়াতে প্রচারের ক্ষেত্রে এখনও সমস্যা রয়েছে। আবার যোগ্য শিল্পীরাও সুযোগ পাচ্ছে কম।
আর উত্তরনের ক্ষেত্রে আমি মনে করি সরকারি ও বেসরকারি উদ্দ্যোগে পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন। দরিদ্র শিল্পীদের অর্থনৈতিক সহযোগীতা নিশ্চিত করা পাশাপাশি বাউল শিল্পীদের পরিবেশনা মিডিয়াতে বেশি করে প্রচার করা। কারন বাউল গান এর প্রতি বর্তমানে মানুষের আগ্রহ অনেকখানি বেড়েছে।
পরের প্রশ্নটি মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল তার সংগীত জীবনের প্রাপ্তি -অপ্রাপ্তির বিষয়ে। প্রশ্ন ছিল-
আপনার সংগীত জীবনে চলার পথে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসেবে কি কোন গরমিল রয়েছে।
এ প্রশ্নটিও খুব চিন্তা এবং সময় নিয়ে বলতে থাকলেন ঠিক এভাবে- সংগীত জীবনে আমি অনেক পেয়েছি। আমার প্রাপ্তির খাতা বেশ সমৃদ্ধ। প্রাপ্তির ক্ষেত্রে আমি বলব মূলত: অনেক ছোট কাল থেকেই সংগীত জগতের সংগে আমি ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। সংগীত সংশ্লিস্টতার কারণে অনেক মানুষের ভালোবাসা যেমন পেয়েছি; তেমনি পেয়েছি অনেক সন্মানও। এছাড়াও অনেক বড় মাপের প্রতিষ্ঠান, বড় বড় পদের মানুষের সাথে পরিচয় হওয়ার সুযোগ হয়েছে এই সংগীতের কারনেই। যা আদৌও সংগীত ছাড়া সম্ভব হতো না। আর যে বিষয়টি উল্লেখযোগ্য সেটি সংগীতের কারনে আমি আমার প্রাণপ্রিয় ছাত্র-ছাত্র পেয়েছি। ওরা আমার জন্য ওদের সর্বোচ্চটা দেওয়ার চেষ্টা করছে এবং এখন অবধি করে যাচ্ছে। এটা আমার জন্য এক বিশাল প্রাপ্তি। যার জন্য আমার এ প্রাপ্তিতে সৃষ্টিকর্তার কাছে শোকরিয়া আদায় করি। আর অপ্রাপ্তির খাতাটি বলতে গেলে যৎসামন্যই। তবে এখনও আমার অনেক স্বপ্ন পূরণ হয়নি। বাউল গান সারা বাংলাদেশে এখনও সেভাবে বিকশিত হয়নি; এক্ষেত্রে অপসংস্কৃতি বাঁধা হিসাবে কাজ করছে। এক্ষেত্রে আমার প্রাপ্তিটা তখনই শতভাগ পূর্ণ হবে যখন বাউল গান সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়বে আনাচে কানাচে। জানিনা ততদিন আমি বেঁচে থাকব কিনা।
পরিবার প্রসংগ আসতেই, তার পক্ষ থেকে সরেজমিনে পরিদর্শনের প্রস্তাব। আর প্রস্তাবটি বুঝে ওঠার আগেই ততক্ষনে তার গৃহে প্রবেশ ঘটে গেছে আমার। একাডেমী থেকে বাসার দূরত্ব মাত্র পাঁচ মিনিটের পথ। বুঝে ফেললাম মানুষকে বশীকরণ করার ক্ষমতা তার কতখানি। তা না হলে মাত্র একদিনের সম্পর্কে তিনি কিভাবে আমাকে তার বাড়ীতে নিয়ে যেতে পারলেন। এখানেও তাঁর সেই বিণয়। যার কারনে আমি তার প্রতিটি প্রস্তাব মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছিলাম বরাবরই। তবে তার গৃেহ প্রবেশের পর যে বিষয়টি বেশী প্রাধান্য পেল সেটি সেই মহীয়সী নারীর দর্শণ পাওয়ার সৌভাগ্য এবং সুযোগ। যিনি মজনু ভাই এর অনুপস্থিতিতেও তার মেয়েদের মানুষ করতে পেরেছেন। আরও একজন বিনয়ী মানুষ তার সহধর্মিণী। প্রথম দর্শনেই তার ব্যবহারে বুঝতে পারলাম সত্যিই একজন দোলেনা পারভীন একজন মজনুর জন্য কতখানি সহায়ক। স্বামীর সংগীত সাধনার সংগ্রামকে তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন বলেই তিনি স্বামীকে সংসারের মায়াজালে ততটা বেঁধে রাখেননি। পাছে স্বামীর ব্রত সাধনায় ব্যাঘাত ঘটে। সত্যিই তার এই আত্বত্যাগ মহানুভবতার বিশাল পরিচয় বহন করে। অতিথি পরায়নতায়ও যে তিনি কম যান না সেটিও তিনি প্রমাণ করে ছাড়লেন। দুপুরের আহার না করে বাসা থেকে বের হতে পারলাম না। তার সেই রান্ন্া করা পোলাও এবং ভুনা মাংসের স্বাদ আমার মায়ের হাতের রান্নার স্বাদ মনে করিয়ে দিল সে মুহুর্তে।
আহার সমাপনান্তে পুনরায় একাডেমিতে প্রবেশ । আবার সেই আলাপচারিতা, গান শোনা। পড়ন্ত বিকেল গড়িয়ে সন্ধার আভা সেসময় আকাশে। বিদায়ের মুহুর্ত ঘনিয়ে এলো। ঠিক সে সময়ে তার কাছে আমার শেষ প্রশ্নটি ছিল এরকম।
কথিত আছে আপনি আপনার প্রতিষ্ঠান মজনু আপন শিল্পী গোষ্ঠীর ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য একজন নিবেদিত প্রাণ সংগীত গুরু। তাদের পেছনে আপনি দিনরাত নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন, এ প্রসংগে যদি কিছু বলতেন।
প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলতে শুরু করলেন এভাবে- নিবেদিত প্রাণ কিনা জানিনা। তবে ওদেরকে আমি আমার নিজের সন্তানদের মতোই মনে করি। ওদের মাঝে আমি আজীবন বেঁচে থাকতে চাই। আমি পৃথিবি ছেড়ে চলে গেলেও ওরা আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে আমার দেওয়া দীক্ষার মাধ্যমে। যে দীক্ষা আমি ওদের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছি এবং এখনও দিয়ে যাচ্ছি। এটা আমার দৃঢ় বিশ^াস। হয়তো পৃথিবীতে চিরদিন বেঁচে থাকবো না; তবে আমার স্বপ্ন বীজ ওরা বয়ে নেবে।
আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার ওদের যে কোন কষ্ট আমাকে ভীষনভাবে ব্যথিত করে। আমার এ প্রতিষ্ঠানটি ‘মজনু আপন শিল্পী গোষ্ঠী’ যাতে বাংলাদেশের মধ্যে ভাল পর্যায়ে থাকে, এই স্বপ্ন আমি এখনও বুকে ধারন করে যাচ্ছি। পাশাপাশি আমার সন্তানরা এগিয়ে চলবে সংগীতকে একান্ত ভালবেসে, এটাই আমার প্রত্যাশা। এ কথাগুলো বলা শেষ হলে মজনু’র দু’চোখ আবারও সেই শত বরষার জল দেখতে পেলাম। তবে এ সুখের কান্নার রেশ থাকতে থাকতেই আমি তাঁর অনুমতির অপেক্ষায় রইলাম বিদায়ের জন্য। নিজেকে সংবরণ করে তিনি আমাকে পুনরায় তার সেই বিনয়ের দৃষ্টান্ত প্রদর্শন করলেন। বিদায় দেওয়াটাও যে বিনয়ের অংশ হতে পারে তা দেখতে পেলাম সে মুহূর্তে এবং যা শিক্ষনীয়ও বটে। তবে বিদায়ের ঘন্টা বেজেছে অনেক পরে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাতে।
একাডেমী থেকে বেরিয়ে রিক্সা যোগে যখন বাসার উদ্দেশ্যে তখন বেশ রাত। ফাঁকা মহাসড়কে রিক্সাটি এগিয়ে চলছে আর আমার মনের ভেতর তখন মজনুুর মায়াবি কন্ঠে পরিবেশিত ফকির লালন সাইজীর সেই গানটির কলিটি একধরনের অনুরণন ছড়াচ্ছে- “মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি”। মনে মনে আমিও গাইবার চেষ্টা করলাম।
সাক্ষাৎকার গ্রহণ: আশিফ মাহমুদ
আলোকচিত্রী: সংগীতা সাহা