আমলানির্ভর ব্যবস্থাপনা নয়, সংস্কার চান স্বাস্থ্য ক্যাডাররা
- প্রকাশের সময় : ১১:৩৪:৪৪ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪
- / 21
দুই সপ্তাহ ধরে আন্দোলন করছেন বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা। স্বাস্থ্য খাতে সংস্কার চান স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা, তবে আমলাতান্ত্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা চান না, এমন দাবি তাদের। এ দাবি আদায়ে এরই মধ্যে তাঁরা সংবাদ সম্মেলনসহ মানববন্ধন ও কলমবিরতি করেছেন। দিয়েছেন প্রতিবাদলিপি।
সম্প্রতি স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ক্যাডার বিলুপ্ত করে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে সুপারিশ করে। এটি প্রত্যাখ্যান করে উল্লিখিত দাবিতে আন্দোলন করছেন স্বাস্থ্যের কর্মকর্তারা। তাঁদের ভাষ্য, সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে সবচেয়ে সুবিধাভোগী প্রশাসন ক্যাডার। বদলি, পদোন্নতি, কেনাকাটা এমনকি নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সব সিদ্ধান্ত তাঁরা নিয়ে থাকেন।
অথচ মাঠ পর্যায়ে কাজের কোনো অভিজ্ঞতা নেই তাঁদের। এতে স্বাস্থ্য খাত কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি, বরং আমলাকেন্দ্রিক পুঁজিবাদী ও স্বার্থবাদী স্বাস্থ্য খাত সৃষ্টি হয়েছে। তাঁরা বলছেন, সংস্কারের পক্ষে তাঁদেরও মত রয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকের মাধ্যমে স্বাস্থ্য খাত পরিচালনা, অর্থাৎ মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের নীতিনির্ধারণী পদে পদায়ন, উপসচিব পদ উন্মুক্ত রাখা এবং পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ দিতে হবে।
জনস্বার্থকে প্রাধান্য না দিয়ে এমন সংস্কার সরকারকে সংকটে ফেলবে বলে মনে করছেন জনপ্রশাসন বিশ্লেষক ফিরোজ মিয়া। তিনি বলেন, জনস্বার্থ নিয়ে এদের কোনো মাথাব্যথা নেই। নিজেদের সুবিধার পাল্লা ভারী করতে এরা এখন মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে।
ফিরোজ মিয়া বলেন, সংস্কার কমিশনের কাজ হবে জনগণের সেবা সহজলভ্য করার পরামর্শ দেওয়া, দুর্নীতি বন্ধের প্রস্তাব তৈরি, কাঠামোগত ত্রুটি বের করা। সেসব না করে ক্যাডার বৈষম্য দূর করার বিষয়টি তারা ভাবল কী করে?
বিসিএস হেলথ ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বায়ক মোহাম্মদ নেয়ামত হোসেন বলেন, দুই থেকে তিনটি দেশে ক্যাডার ব্যবস্থা রয়েছে।
এর বাইরে কোথাও নেই। সে ক্ষেত্রে ২৬টি ক্যাডারের সব কয়টি বাতিল হতে হবে। নীতিনির্ধারণী পদে স্বাস্থ্য ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদায়ন করতে হবে।
তিনি বলেন, সচিবালয়ে অচিকিৎসক কর্মকর্তারা স্বাস্থ্য খাত পরিচালনা করছেন। জনস্বার্থমুখী স্বাস্থ্য খাতের জন্য প্রয়োজন মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের নীতিনির্ধারণী পদে পদায়ন। মন্ত্রী ও আমলাকেন্দ্রিক পুঁজিবাদী ও স্বার্থবাদী প্রথা ভাঙতে হবে। সংস্কারটা প্রয়োজন মূলত সেখানে।
গত ১৭ ডিসেম্বর জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী এবং সদস্যসচিব ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. মোখলেস উর রহমান তাঁদের কিছু সুপারিশের কথা তুলে ধরেন। কমিশনের সুপারিশের মধ্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত না রেখে আলাদা রাখা, উপসচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্য ৫০ শতাংশ ও অন্য ক্যাডারের জন্য ৫০ শতাংশ করা ইত্যাদির কথা বলা হয়েছে। এর পর থেকে ক্যাডারগুলোর মধ্যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।
বিসিএস হেলথ ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটির সদস্যসচিব উম্মে তানিয়া নাসরিন বলেন, স্বাস্থ্যের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কোনো সরকারি ডাক্তার নেই। একজন অচিকিৎসক কিভাবে চিকিৎসার দায়িত্ব নিতে পারেন? কিভাবে সচিবালয়ের নীতিনির্ধারণী পদগুলোতে চিকিৎসক না রেখে স্বাস্থ্য সংস্কারের প্রস্তাব দেওয়া হতে পারে? এটা কি যৌক্তিক? বিগত সময়ে সচিবালয়ে অচিকিৎসক কর্মকর্তারা স্বাস্থ্যকে বিজ্ঞানভিত্তিক ও যুগোপযোগী না করে আমলাতান্ত্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা কায়েম করেছেন। ফলে স্বাস্থ্য খাত কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি এবং জনস্বার্থমুখী স্বাস্থ্য খাত না হয়ে মন্ত্রী ও আমলামুখী পুঁজিবাদী ও স্বার্থবাদী স্বাস্থ্য খাত সৃষ্টি হয়েছে।
তিনি বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল ও নীতিনির্ধারণী পদে মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন স্বাস্থ্য ক্যাডারের দক্ষ কর্মকর্তাদের পদায়ন করে প্রকৃত বিজ্ঞানভিত্তিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা সম্ভব। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন প্রকৃত সংস্কার প্রস্তাব বাদ দিয়ে স্বাস্থ্যকে ক্যাডারবহির্ভূত করার যে হঠকারী সুপারিশ করেছেন, তা অন্তর্বর্তী সরকারের মেধাভিত্তিক জনপ্রশাসন তৈরি ও বৈষম্যবিরোধী মূল চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এই সুপারিশ প্রত্যাহার না হলে প্রশাসনিক সংস্কার ব্যর্থ হবে।
স্বাস্থ্য কমিশনের সদস্য চিকিৎসাবিজ্ঞানী অধ্যাপক লিয়াকত আলী বলেন, ‘স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনে এ বিষয়ে এখনো কোনো বৈঠক হয়নি। তবে আমার ব্যক্তিগত মতামত হলো স্বাস্থ্য ক্যাডারকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান না করে আরো চিন্তা-ভাবনা করা উচিত। তাঁরা স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের সিদ্ধান্তের জন্য অন্তত অপেক্ষা করুন। জনপ্রশাসনের সংস্কার কমিশনের ব্যাখ্যা জেনেশুনে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।’
লিয়াকত আলী বলেন, বিসিএস ক্যাডার থেকে বের হওয়া মানে এই নয় যে তাঁরা ক্যাডারের পদমর্যাদা হারাচ্ছেন। তাঁরা আলাদা একটা স্বতন্ত্র ক্যাডার হচ্ছেন, আলাদা সুযোগ-সুবিধা তৈরি হচ্ছে। জুডিশিয়াল কমিশন যেভাবে আলাদা হয়ে অনেক ভালো আছে, তাঁদের ক্ষেত্রেও একই হচ্ছে। সেটা চাইলে স্বাস্থ্য ক্যাডাররা জেনে নিতে পারেন।