Dhaka ০৮:৩৬ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ডা. মো. গোলাম মোস্তফার উদ্দেশ্যে লেখা মেয়ের চিঠি

সংবাদদাতা-
  • প্রকাশের সময় : ০৬:৫৮:০৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ৮ অগাস্ট ২০২২
  • / ১৩৫০ জন সংবাদটি পড়েছেন

প্রিয় আব্বা, কেমন আছো তুমি? আজ কতদিন পর যে, তোমায় লিখছি! তোমার মনে আছে আব্বা, ছোট বেলায় আমাদের সংসারটা ছিল সুদূর আফ্রিকান দেশ, লিবিয়াতে? তুমি, আম্মা আর আমরা তিন বোন। আমাদের কোন ভাই ছিলো না। এমন মধুর শান্তির নীড় আমি আর দ্বিতীয়টি দেখিনি।

তুমি ওখানে ছিলে সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার। লিবিয়ানরা তোমায় দেবতুল্য সম্মান করতো।আমরা থাকতাম বেনওয়ালিদে,তাইনা?

চারিদিকে বড় বড় পাহাড়। পাহাড় বেষ্টিত এক সবুজ উপত্যকাও ছিলো সেখানে। জয়তুন, খেজুর, ফনিমনসা আর কাঁটা যুক্ত একধরনের গাছে ভরপুর ছিল সেই উপত্যকা। দু’বছর পর পর তোমার কয়েক হাজার মাইল দূরে তিনিনা নামক এক ছোট্ট শহরে পোস্টিং হতো। ছোট্ট বেলায় তিনিনা যাওয়ার পথে তুমি সেই মরুময় বালুকা পথে প্রথম আমাদের মরীচিকা চিনিয়েছিলে।

মনে আছে তোমার? তিনিনায় হাসপাতালের সাথেই আমাদের কোয়ার্টার ছিলো। লিবিয়ান রুগীরা প্রায়ই চিকিৎসা নিতে এলে চিকিৎসা শেষে আম্মাকে দেখার জন্য আসতো। আম্মার দীঘল কালো জলপ্রপাতের মতো এক ঢাল চুলের বর্ণনা তখন ওদের মুখে মুখে।ওরা আম্মার চুল দেখতে আসতো। আর ওদের রুক্ষ কোঁকড়ানো চুল কিভাবে এমন স্ট্রেইট,লম্বা ও সিল্কী হতে পারে সে টিপস্ও চাইতে আসতো।

ওরা তোমায় খুব ভালোবাসতো।

তোমার বেশি কণ্যা ভাগ্যে খুশী হয়ে বলতো, “ডাক্তার, তুমি কত ভাগ্যবান।তোমার তিন মেয়ে।তুমিতো মেয়েদের বিয়ে দিয়ে ধনী হয়ে যাবে।”

লিবিয়ায় যে বিয়ের সময় দেনমোহরানা পরিশোধ করে মেয়ে নিতে হয়। তুমি আর আম্মা মুখ টিপে হাসতে। বলতে, ওদেরকে আমাদের বাংলাদেশ ঘুরিয়ে আনা দরকার। বাংলাদেশে যে কণ্যা সন্তানের পিতা মাতাকে ফ্যামিলি শেইমিং – এ পড়তে হয়, তা ওখানে থাকতে তোমরা আমাদের একটুও বুঝতে দাওনি। এতো ভালবেসেছো! এতো যতœ নিয়েছো!

আব্বা, তোমার মনে আছে, বেনওয়ালিদে তুমি আমাদের কিভাবে উঁচু উঁচু দুর্গম পাহাড় ডিঙাতে হয়, তা শিখিয়েছিলে?আমরা মাঝে মাঝে কষ্টে পাহাড়ে উঠতে চাইতাম না। তুমি মিষ্টি হেসে হাত বাড়িয়ে অনুপ্রেরণা দিতে।পাহাড়ের উপরে দৃশ্যমান শহরে উঠতে তুমি আমাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে। একসময় পাহাড়ে উঠতে ঠিকই সফল হতাম।আমাদের সাফল্যে তুমি হাসতে।

বলতে,”একবার না পারিলে দেখো শতবার। “আব্বা,আজ বুঝি, ওটা যে মামুলি দুর্গম বন্ধুর পাহাড় ডিঙানোর শিক্ষা ছিলো না।

ছিলো- জীবনের দূর্গমতাকে জয় করার প্রথম পাঠ। তোমার মনে আছে আব্বা, লিবিয়ায় শীতের সময় তীব্র শীত পড়তো।কনকনে ঠান্ডা। তুমি আমাদের ভারী উলেন কোট কিনে দিয়েছিলে।আমারটা ছিলো পীচ সবুজ।

বাইরে বের হওয়ার সময় তুমি নিজ হাতে আমাদের কোট পরাতে। ফুলহাতা শার্টের উপর কোট চাপাতে নীচের শার্টের হাতা যেন গুটিয়ে উপরে উঠে না যায়,সেই শিক্ষাও যে তোমার কাছ থেকেই পাওয়া। আজও শীতকাল এলে কার্ডগ্যান পরতে গেলে তোমাকেই যে মনে পড়ে, আব্বা। জীবন চলার পথে ছোট বড়, জানা – অজানা সব অলি গলিতে আলোক রশ্মি প্রক্ষেপণ করে পথতো তুমিই দেখিয়েছো!

তোমার ভালবাসা এতো গভীর ছিলো কেন, আব্বা? অতলান্তিক মহাসমুদ্রের মতোই যার ঠাঁই পাওয়া অসম্ভব।

খুব মনে পড়ে – আমি বাসে চড়তে পারতাম না। বমি হয়ে যেতো। এক শীতে ত্রিপলীতে বড় মামার বাসায় যাওয়ার পথে বমি করে তোমায় গোসল করিয়ে দিলাম।তুমি অস্হির হয়ে আমায় সেবা করলে কিন্তু সারাটা পথ বমির দূর্গন্ধ ও ভেজা পোশাকে কি কষ্টটাই না পেলে! হীরক খচিত তোমার ভালোবাসা, আব্বা।তুমি যে অনন্য, অসাধারণ।

আব্বা, তুমি- ই আমার জীবনের মোহময় প্রথম পুরুষ। যার গভীর সান্নিধ্যে বড় হতে হতে নিজের কাঙ্ক্ষিত পুরুষকে তোমার-ই মতো চাইতাম। তোমারই মতো সুদর্শন,স্মার্ট, পোশাক সচেতন, মার্জিত,সুবক্তা, দয়ালু, সৎ ও নীতি আদর্শে অটল – সুদৃঢ় ব্যক্তিত্বের কেউ।

তুমি যে ছিলে হাজার গুনের মিশ্রণে গঠিত এক তুলনাহীন অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় এক ব্যাক্তিত্ব। তোমার উপস্থিতি এক চুম্বকার্ষনীয় ভালো লাগা ও জ্ঞানের দ্যুতি ছড়াতো চারপাশ।

এমন পুরুষ-ই তো মেয়েদের আরাধ্য। ছোট বেলায় তুমি কত গল্প – ই না করতে!আমাদের নিয়ে মুভি দেখতে।

শিশু রাসেলের হত্যাকান্ড,”রুটস”- কালোদের শোষণ, ব্রিটিশ সাম্রাজ্য, ক্ষুদিরাম, ভাষা আন্দোলন, বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ —মনের আকাশে উন্মোচিত করে তুলতে এক একটি দিগন্ত।

তোমার চেতনায় মুক্তিযুদ্ধ। স্বপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড। তুমি বলতে। আমরা শুনতাম। দাবা,ফুটবল, ক্রিকেটের জ্ঞানতো তোমার দান। সাহিত্যে ভালবাসা সৃষ্টিতেও তোমারই প্রভাব। রবীন্দ্র, নজরুল, বিমল মিত্রৃৃৃ..। দেবতার গ্রাস, ছুটি, দেনা পাওনা পড়ে পড়ে শোনাও। আমরা কেঁদে বুক ভাসাই।

উত্তম -সুচিত্রা – সাগরিকা, অড্রে হেপবার্ণ – এর ” কাম সেপ্টেম্বর ” — কি নয়! নবিজীর হিলফুল ফুজুল, বিদায় হজ্জের ভাষনের ব্যাখ্যা তোমার বক্তব্য থেকেই পাওয়া।

তোমার মনে আছে আব্বা,জীবনের প্রথম তোমার সাথে দাবা খেলতে যেয়ে তুমি আমায় মাত্র চার দানেই হারিয়ে দিলে? আমার সে-কি কান্না! ভেবেছিলাম, তুমি আমায় জিতে যাওয়ার সুযোগ করে দিবে।

ঐ দিন তুমি আমায় বুকে নিয়ে আদর করে শেখালে – “প্রতিপক্ষকে কেঁদে নয়,বুদ্ধিতে হারাতে হয়। আর সুযোগে নয় যোগ্যতায় জয়ী হওয়াই আসল জয়।” এরপর আমি উঠে পরে লাগলাম তোমাকে হারাতে। একদিন জিতেও গেলাম।

আর তুমি? হেরে গিয়েও যেন জিতে গেলে। উইনিং গিফট হিসেবে এক রিস্ট ওয়াচ কিনে দিয়েছিলে আমায়- সিকো ফাইভ। আজ আমি দাবা খেলায় অনেককেই হারাতে পারি। অনেকদিন দাবা খেলিনা।কিন্তু তোমার সেই – “প্রতিপক্ষকে বুদ্ধিতে হারানোর আর যোগ্যতায় জয়ী হওয়ার” মেসেজটা আমার জীবন পথের পাথেয়।

বাংলাদেশে এসে আমাদের আরেকটা বোন হলো।সমাজকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তুমি আমাদের কানে কানে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মন্ত্রপাঠ দিলে। বললে,এই শিক্ষা ও প্রতিষ্ঠাই একদিন তোমাদের নিরাপত্তা দেবে। বললে, “এই জীবনে যার আইডেন্টিটি নাই, তার মতো দূর্ভাগা আর নাই।” আজ আমরা চার বোনই প্রতিষ্ঠিত। যা হতে পারে পুত্রহীন পরিবারগুলোর জন্য উদাহরণ।

জানো আব্বা, আজ তোমার বইগুলো নেড়ে চেড়ে দেখলাম। তোমার কোরআনের তাফসীর,রিডার্স ডাইজেস্ট, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিনগুলো কি সুন্দর থরে থরে সাজানো! আচ্ছা, তুমি না খুব পড়তে ভালবাসাতে? প্রায় একবছর হতে চলল তুমি পড়না। আচ্ছা আব্বা, তুমিতো আমাদের না দেখে বা আমাদের কন্ঠস্বর না শুনে একদিনও কাটাতে পারতে না। আজ আমাদের ছেড়ে তুমি এতোদিন কেমন করে আছো? তোমার প্রিয়তমা হাবিবা, আমাদের মা, তাকেও মনে পরেনা বুঝি? খুব,খুব ইচ্ছা করছে আব্বা -তোমার পকেটের রুমাল দিয়ে আমার অঝোর ধারার চোখের পানি একবার, শুধু একবার মুছে দিয়ে যাও। তোমারই মা রমন।

(ডাঃ মোঃ গোলাম মোস্তফা, ছিলেন রাজবাড়ী জেলা বিএমএ,স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) ও জেলা বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি। দেশের এই গর্বিত সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা ২০২০ সালের ৮ই আগষ্ট করোনায় আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেন।

লেখক ঃ মঞ্জুরা মোস্তফা (ডাঃ মোঃ গোলাম মোস্তফার দ্বিতীয় কন্যা), সহকারি অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা কলেজ, ঢাকা।

Tag :

সংবাদটি আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন-

ডা. মো. গোলাম মোস্তফার উদ্দেশ্যে লেখা মেয়ের চিঠি

প্রকাশের সময় : ০৬:৫৮:০৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ৮ অগাস্ট ২০২২

প্রিয় আব্বা, কেমন আছো তুমি? আজ কতদিন পর যে, তোমায় লিখছি! তোমার মনে আছে আব্বা, ছোট বেলায় আমাদের সংসারটা ছিল সুদূর আফ্রিকান দেশ, লিবিয়াতে? তুমি, আম্মা আর আমরা তিন বোন। আমাদের কোন ভাই ছিলো না। এমন মধুর শান্তির নীড় আমি আর দ্বিতীয়টি দেখিনি।

তুমি ওখানে ছিলে সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার। লিবিয়ানরা তোমায় দেবতুল্য সম্মান করতো।আমরা থাকতাম বেনওয়ালিদে,তাইনা?

চারিদিকে বড় বড় পাহাড়। পাহাড় বেষ্টিত এক সবুজ উপত্যকাও ছিলো সেখানে। জয়তুন, খেজুর, ফনিমনসা আর কাঁটা যুক্ত একধরনের গাছে ভরপুর ছিল সেই উপত্যকা। দু’বছর পর পর তোমার কয়েক হাজার মাইল দূরে তিনিনা নামক এক ছোট্ট শহরে পোস্টিং হতো। ছোট্ট বেলায় তিনিনা যাওয়ার পথে তুমি সেই মরুময় বালুকা পথে প্রথম আমাদের মরীচিকা চিনিয়েছিলে।

মনে আছে তোমার? তিনিনায় হাসপাতালের সাথেই আমাদের কোয়ার্টার ছিলো। লিবিয়ান রুগীরা প্রায়ই চিকিৎসা নিতে এলে চিকিৎসা শেষে আম্মাকে দেখার জন্য আসতো। আম্মার দীঘল কালো জলপ্রপাতের মতো এক ঢাল চুলের বর্ণনা তখন ওদের মুখে মুখে।ওরা আম্মার চুল দেখতে আসতো। আর ওদের রুক্ষ কোঁকড়ানো চুল কিভাবে এমন স্ট্রেইট,লম্বা ও সিল্কী হতে পারে সে টিপস্ও চাইতে আসতো।

ওরা তোমায় খুব ভালোবাসতো।

তোমার বেশি কণ্যা ভাগ্যে খুশী হয়ে বলতো, “ডাক্তার, তুমি কত ভাগ্যবান।তোমার তিন মেয়ে।তুমিতো মেয়েদের বিয়ে দিয়ে ধনী হয়ে যাবে।”

লিবিয়ায় যে বিয়ের সময় দেনমোহরানা পরিশোধ করে মেয়ে নিতে হয়। তুমি আর আম্মা মুখ টিপে হাসতে। বলতে, ওদেরকে আমাদের বাংলাদেশ ঘুরিয়ে আনা দরকার। বাংলাদেশে যে কণ্যা সন্তানের পিতা মাতাকে ফ্যামিলি শেইমিং – এ পড়তে হয়, তা ওখানে থাকতে তোমরা আমাদের একটুও বুঝতে দাওনি। এতো ভালবেসেছো! এতো যতœ নিয়েছো!

আব্বা, তোমার মনে আছে, বেনওয়ালিদে তুমি আমাদের কিভাবে উঁচু উঁচু দুর্গম পাহাড় ডিঙাতে হয়, তা শিখিয়েছিলে?আমরা মাঝে মাঝে কষ্টে পাহাড়ে উঠতে চাইতাম না। তুমি মিষ্টি হেসে হাত বাড়িয়ে অনুপ্রেরণা দিতে।পাহাড়ের উপরে দৃশ্যমান শহরে উঠতে তুমি আমাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে। একসময় পাহাড়ে উঠতে ঠিকই সফল হতাম।আমাদের সাফল্যে তুমি হাসতে।

বলতে,”একবার না পারিলে দেখো শতবার। “আব্বা,আজ বুঝি, ওটা যে মামুলি দুর্গম বন্ধুর পাহাড় ডিঙানোর শিক্ষা ছিলো না।

ছিলো- জীবনের দূর্গমতাকে জয় করার প্রথম পাঠ। তোমার মনে আছে আব্বা, লিবিয়ায় শীতের সময় তীব্র শীত পড়তো।কনকনে ঠান্ডা। তুমি আমাদের ভারী উলেন কোট কিনে দিয়েছিলে।আমারটা ছিলো পীচ সবুজ।

বাইরে বের হওয়ার সময় তুমি নিজ হাতে আমাদের কোট পরাতে। ফুলহাতা শার্টের উপর কোট চাপাতে নীচের শার্টের হাতা যেন গুটিয়ে উপরে উঠে না যায়,সেই শিক্ষাও যে তোমার কাছ থেকেই পাওয়া। আজও শীতকাল এলে কার্ডগ্যান পরতে গেলে তোমাকেই যে মনে পড়ে, আব্বা। জীবন চলার পথে ছোট বড়, জানা – অজানা সব অলি গলিতে আলোক রশ্মি প্রক্ষেপণ করে পথতো তুমিই দেখিয়েছো!

তোমার ভালবাসা এতো গভীর ছিলো কেন, আব্বা? অতলান্তিক মহাসমুদ্রের মতোই যার ঠাঁই পাওয়া অসম্ভব।

খুব মনে পড়ে – আমি বাসে চড়তে পারতাম না। বমি হয়ে যেতো। এক শীতে ত্রিপলীতে বড় মামার বাসায় যাওয়ার পথে বমি করে তোমায় গোসল করিয়ে দিলাম।তুমি অস্হির হয়ে আমায় সেবা করলে কিন্তু সারাটা পথ বমির দূর্গন্ধ ও ভেজা পোশাকে কি কষ্টটাই না পেলে! হীরক খচিত তোমার ভালোবাসা, আব্বা।তুমি যে অনন্য, অসাধারণ।

আব্বা, তুমি- ই আমার জীবনের মোহময় প্রথম পুরুষ। যার গভীর সান্নিধ্যে বড় হতে হতে নিজের কাঙ্ক্ষিত পুরুষকে তোমার-ই মতো চাইতাম। তোমারই মতো সুদর্শন,স্মার্ট, পোশাক সচেতন, মার্জিত,সুবক্তা, দয়ালু, সৎ ও নীতি আদর্শে অটল – সুদৃঢ় ব্যক্তিত্বের কেউ।

তুমি যে ছিলে হাজার গুনের মিশ্রণে গঠিত এক তুলনাহীন অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় এক ব্যাক্তিত্ব। তোমার উপস্থিতি এক চুম্বকার্ষনীয় ভালো লাগা ও জ্ঞানের দ্যুতি ছড়াতো চারপাশ।

এমন পুরুষ-ই তো মেয়েদের আরাধ্য। ছোট বেলায় তুমি কত গল্প – ই না করতে!আমাদের নিয়ে মুভি দেখতে।

শিশু রাসেলের হত্যাকান্ড,”রুটস”- কালোদের শোষণ, ব্রিটিশ সাম্রাজ্য, ক্ষুদিরাম, ভাষা আন্দোলন, বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ —মনের আকাশে উন্মোচিত করে তুলতে এক একটি দিগন্ত।

তোমার চেতনায় মুক্তিযুদ্ধ। স্বপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড। তুমি বলতে। আমরা শুনতাম। দাবা,ফুটবল, ক্রিকেটের জ্ঞানতো তোমার দান। সাহিত্যে ভালবাসা সৃষ্টিতেও তোমারই প্রভাব। রবীন্দ্র, নজরুল, বিমল মিত্রৃৃৃ..। দেবতার গ্রাস, ছুটি, দেনা পাওনা পড়ে পড়ে শোনাও। আমরা কেঁদে বুক ভাসাই।

উত্তম -সুচিত্রা – সাগরিকা, অড্রে হেপবার্ণ – এর ” কাম সেপ্টেম্বর ” — কি নয়! নবিজীর হিলফুল ফুজুল, বিদায় হজ্জের ভাষনের ব্যাখ্যা তোমার বক্তব্য থেকেই পাওয়া।

তোমার মনে আছে আব্বা,জীবনের প্রথম তোমার সাথে দাবা খেলতে যেয়ে তুমি আমায় মাত্র চার দানেই হারিয়ে দিলে? আমার সে-কি কান্না! ভেবেছিলাম, তুমি আমায় জিতে যাওয়ার সুযোগ করে দিবে।

ঐ দিন তুমি আমায় বুকে নিয়ে আদর করে শেখালে – “প্রতিপক্ষকে কেঁদে নয়,বুদ্ধিতে হারাতে হয়। আর সুযোগে নয় যোগ্যতায় জয়ী হওয়াই আসল জয়।” এরপর আমি উঠে পরে লাগলাম তোমাকে হারাতে। একদিন জিতেও গেলাম।

আর তুমি? হেরে গিয়েও যেন জিতে গেলে। উইনিং গিফট হিসেবে এক রিস্ট ওয়াচ কিনে দিয়েছিলে আমায়- সিকো ফাইভ। আজ আমি দাবা খেলায় অনেককেই হারাতে পারি। অনেকদিন দাবা খেলিনা।কিন্তু তোমার সেই – “প্রতিপক্ষকে বুদ্ধিতে হারানোর আর যোগ্যতায় জয়ী হওয়ার” মেসেজটা আমার জীবন পথের পাথেয়।

বাংলাদেশে এসে আমাদের আরেকটা বোন হলো।সমাজকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তুমি আমাদের কানে কানে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মন্ত্রপাঠ দিলে। বললে,এই শিক্ষা ও প্রতিষ্ঠাই একদিন তোমাদের নিরাপত্তা দেবে। বললে, “এই জীবনে যার আইডেন্টিটি নাই, তার মতো দূর্ভাগা আর নাই।” আজ আমরা চার বোনই প্রতিষ্ঠিত। যা হতে পারে পুত্রহীন পরিবারগুলোর জন্য উদাহরণ।

জানো আব্বা, আজ তোমার বইগুলো নেড়ে চেড়ে দেখলাম। তোমার কোরআনের তাফসীর,রিডার্স ডাইজেস্ট, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিনগুলো কি সুন্দর থরে থরে সাজানো! আচ্ছা, তুমি না খুব পড়তে ভালবাসাতে? প্রায় একবছর হতে চলল তুমি পড়না। আচ্ছা আব্বা, তুমিতো আমাদের না দেখে বা আমাদের কন্ঠস্বর না শুনে একদিনও কাটাতে পারতে না। আজ আমাদের ছেড়ে তুমি এতোদিন কেমন করে আছো? তোমার প্রিয়তমা হাবিবা, আমাদের মা, তাকেও মনে পরেনা বুঝি? খুব,খুব ইচ্ছা করছে আব্বা -তোমার পকেটের রুমাল দিয়ে আমার অঝোর ধারার চোখের পানি একবার, শুধু একবার মুছে দিয়ে যাও। তোমারই মা রমন।

(ডাঃ মোঃ গোলাম মোস্তফা, ছিলেন রাজবাড়ী জেলা বিএমএ,স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) ও জেলা বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি। দেশের এই গর্বিত সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা ২০২০ সালের ৮ই আগষ্ট করোনায় আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেন।

লেখক ঃ মঞ্জুরা মোস্তফা (ডাঃ মোঃ গোলাম মোস্তফার দ্বিতীয় কন্যা), সহকারি অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা কলেজ, ঢাকা।