এসপিকে বদলি করাতে কেন মরিয়া এমপি জিল্লুল হাকিম?
- প্রকাশের সময় : ০১:১৩:০৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০
- / ১৮৮৫ জন সংবাদটি পড়েছেন
জনতার আদালত অনলাইন ॥ রাজবাড়ীর সাহসী মানবিক পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান পিপিএমকে বদলি করাতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন রাজবাড়ী-২ আসনের এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জিল্লুল হাকিম। ইতিমধ্যে এমপি জিল্লুল হাকিম পুলিশ সদর দপ্তরে ডিও লেটার দিয়েছেন বলে সূত্র জানিয়েছে।
সাম্প্রতিককালে পাংশা ও কালুখালীতে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান চালানোতে এলাকার শান্তিপ্রিয় মানুষ উল্লসিত ও খুশী। কিন্তুএমপি জিল্লুল হাকিম ক্ষুব্ধ হয়ে পুলিশ সুপার মিজানুর রহমানকে বদলির চেষ্টা করছেন বলে অভিমত এলাকাবাসীর। এলাকাবাসী এমপি জিল্লুল হাকিমের এই অপচেষ্টাকে নিন্দা জানিয়ে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান বহাল রাখার দাবি জানিয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৫ বছর আগে রাজবাড়ি কালুখালি উপজেলা বিএনপির দপ্তর সম্পাদক ও হত্যাসহ একাধিক মামলার আসামী ইউসুফ হোসেন ওরফে ইউসুফ মেম্বারকে উপজেলা আওয়ামী লীগের সহপ্রচার সম্পাদক ও মাঝবাড়ি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ দেয়া হয়। এরপর ইউসুফ মেম্বার শতাধিক আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীর ওপর অমানবিক নির্যাতন চালায়। হাত-পা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়ায় নেতাকর্মীরা এখন পঙ্গু জীবনযাপন করছেন। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১৫ আগস্ট গভীর রাতে খুন হন বেতবাড়িয়ার গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আছির উদ্দিনের ছেলে ইউনিয়ন যুবলীগ নেতা রবিউল ইসলাম। ঘটনার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে ইউসুফ মেম্বারের দুই ছেলে সোহেল রাসেলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তারা এখন জেল হাজতে। গ্রেপ্তারের পর যুবলীগ নেতার খুনের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি পুলিশের কাছে স্বীকারও করেন।
মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের খুনী সেই ইউসুফ মেম্বারসহ দুই ছেলেকে বাঁচাতেই মরিয়া হয়ে উঠেন রাজবাড়ি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও এমপি জিল্লুল হাকিম ও তাঁর পুত্র মিতুল হাকিম। বিভিন্নভাবে ওইসব আসামীদের পক্ষে নানাভাবে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা শুরু করেন। কিন্তু রাজবাড়ির পুলিশ সুপার মিজানুর রহমাানের নেতৃত্বে পুলিশ প্রশাসন কালুখালি পাংশাসহ আশপাশের উপজেলার দুর্র্ধষ সন্ত্রাসী, খুনী মাদক ব্যবসায়ীসহ ভয়ংকর সন্ত্রাসীদের ধরতে একের পর এক অভিযান চলতে থাকে। পুলিশের অভিযানে সম্প্রতি গ্রেপ্তার হন রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলার কসবামাজাইল ইউনিয়নের সুবর্নখোলা গ্রামের নিরীহ স্কুল শিক্ষক আসাদুল খান (৪৫) হত্যা মামলার অন্যতম আসামী জজ আলী বিশ্বাসসহ খুনের সঙ্গে জড়িতরা। জজ আলী বিশ্বাস রাজবাড়ি পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী।
গত ২২ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে সাঁড়াশি অভিযানে ডাকাতির প্রস্তুতিকালে গ্রেপ্তার করা হয় জজ আলী, পিন্টু জোয়র্দারসহ ৩৭ জনকে। এদের মধ্যে ৩০ জন শিক্ষক আসাদুল হত্যার অন্যতম আসামি। জজ আলীর অতীত কর্মকান্ড সম্পে র্ক সকলেই ওয়াকিবহাল। চার চারটি খুনের মামলা রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এসব সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারের পর এলাকাবাসী উল্লসি ত হয়েছে। এলাকায় মিষ্টি বিতরণ করেছে। স্বস্তি ফিরে এসেছে মানুষের মনে। অথচ নাখোশ হয়েছেন এমপি জিল্লুল হাকিম। তার নির্দেশে পুলিশের বিরুদ্ধে সাংবাদিক সম্মেলনও করেছে উপজেলা আওয়ামী লীগ। এমপি জিল্লুল হাকিম তথা পাংশা উপজেলা আওয়ামী লীগের এ অবস্থানে হতাশ রাজবাড়ী-২ আসনের শান্তিপ্রিয় মানুষ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এমপি জিল্লুল হাকিম জজ আলীকে ছাড়াতে ব্যর্থ হয়ে এসপিকে বদলির জন্য নিজের প্যাডে ডিও লেটার দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামালের কাছে। শুধু তাই নয়- সন্ত্রাসী এবং খুনীদেও বাঁচনোর জন্য এসপি মিজানকে বদলি করতে সরকারের প্রভাবশালী মহলেও নানাভাবে তদবির করে যাচ্ছেন।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, এমপি জিল্লুল হাকিম ও তাঁর পুত্র মিতুল হাকিমের আশ্রয় প্রশ্রয়ে ইউসুফ মেম্বার, জজ আলী বিশ্বাসসহ একটি সিন্ডিকেট এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব চালিয়ে যাচ্ছে। ওইসব সন্ত্রাসীদেও বিরুদ্ধে যখন পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে যখন পুলিশ সাড়াশি অভিযান চালিয়ে একের পর এক সন্ত্রাসী খুনীদের গ্রেপ্তার করছিল তখনই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন এমপি ও তাঁর সমর্থকরা। একজন এমপি জেলার শীর্ষ সন্ত্রাসী তালিকাভুক্ত ব্যাক্তির পক্ষে এসপির বিরুদ্ধে ডিও দেয়ার বিষয়টি কোনভাবেই মেনে নিতে পারেনি।
জজ আলীর বিরুদ্ধে রয়েছে, ডাকাতি, হত্যা, সন্ত্রাস, ছিনতাই ও অপহরণসহ নানা অভিযোগের ১৮টি মামলা। সর্বশেষ আসাদুল খান নামে এক স্কুল শিক্ষককে হত্যার নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। গত ২২ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে পুনরায় দলবল নিয়ে অস্ত্রসস্ত্রসহ করছিলেন তিনি ডাকাতির চেষ্টা। আর সে সময়ই জেলা গোয়েন্দা শাখা ও পাংশা থানা পুলিশের সদস্যরা যৌথভাবে অভিযান চালিয়ে জজ আলীসহ ৩৭ জনকে তারা গ্রেপ্তার করে। একই সাথে উদ্ধার করে ২টি ওয়ান শুটার গান, ৩টি কাতুজ, ৯ টি চাপাতি, ৬ টি হাসুয়া, ৪ টি ছোরা, ২টি রামদা, ১টি দা, ১টি ভোজালী, ২টি জিআই পাইপ ও ১টি লোহার রড়। অথচ ভয়ঙ্কার এই সন্ত্রাসী ও তার দলবলকে রক্ষা করতে তৎপর হয়ে পড়েছে তার মদদাতারা।
রাজবাড়ীর পুলিশের বিশেষ শাখা সূত্রে জানা গেছে, ২০১২ সালে জেলা পুলিশের বিশেষ শাখা, ডিজিএফআই ও এনএসআই চরমপন্থী সন্ত্রাসীদের তালিকায় রাজবাড়ীর শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে জেলার পাংশা উপজেলার কশবামাজাইল ইউনিয়নের শান্তিখোলা গ্রামের মৃত আফজাল বিশ্বাসের ছেলে জজ আলী বিশ্বাসের নাম রয়েছে। তার ছবি রাজবাড়ীর পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে সন্ত্রাসীদের তালিকার বোর্ডেও টানানো রয়েছে। তৃতীয় শ্রেণী পাস জজ আলী একজন ভয়ংকর সন্ত্রাসী। সে আওয়ামীলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত থাকলেও সন্ত্রাসী গ্রুপ করতো নিয়ন্ত্রণ। গত ১৩ মার্চ পাশ্ববর্তী সুবর্ণখোলা গ্রামে জজ আলীর নেতৃত্বে প্রতিপক্ষের উপর হামলা ও বেশ কিছু ঘরবাড়ী ভাংচুর করার স্কুল শিক্ষক আসাদুল খানকে নির্মমভাবে হত্যা করে। ওই হত্যার ঘটনায় নিহতের পরিবারের সদস্যরা জজ আলীকে প্রধান আসামি করে ৫১ জনের বিরুদ্ধে পাংশা থানায় একটি মামলা করা হয়। যে মামলা জজ আলী হাইকোট থেকে জামিন নিয়ে এলাকায় অবস্থান করছিলেন।
তবে তার সে জামিনের মেয়াদও শেষ হয়ে গিয়েছিলো। গত ২২ সেপ্টেম্বর রাতে যে ৩৭ জনকে পুলিশ ডাকাতির প্রস্তুতির ঘটনায় গ্রেপ্তার করেছে তার মধ্যে ৩৪ জনই শিক্ষক আসাদুল খান হত্যার মামলার পলাতক আসামি। জজ আলীকে নিবেদিত আওয়ামীলীগ নেতা আখ্যায়িত করে, স্বষ্ট্রমন্ত্রীকে গত বৃহস্পতিবার ডিওলেটার প্রদান করেছেন, রাজবাড়ী-২ আসনের এমপি মোঃ জিল্লুল হাকিম। ওই ডিওলেটারে তিনি রাজবাড়ীর পুলিশ সুপারের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ করেছেন। ওই ডিওলেটারে স্বষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এমপি “আইজিপি দেখুন” লিখে পাঠিয়ে দিয়েছেন আইজিপি দপ্তরে। অভিযোগ রয়েছে, এমপি জিল্লুলের ভয়ে নির্বাচনী এলাকার দুই শতাধিক নেতাকর্মী এলাকাছাড়া বলে অভিযোগ উঠেছে। তাদের অনেকেই এমপির বাহিনীর হামলার শিকার হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন।
নির্যাতনের ভয়ে নিজ এলাকায় যেতে পারছেন না আওয়ামী লীগের অসংখ্যা নেতা। তরা বিচার চেয়ে প্রধানমন্ত্রী, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় দপ্তর, স্বরাষ্ট্রন্ত্রী, পুলিশের আইজি, রাজবাড়ী জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ বহু দপ্তরে অভিযোগ করা হয়েছে। নিজ দলের কর্মীদের নির্যাতনই নয় জিল্লুল হাকিমের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের অভিযোগ জমা হয়েছে। রাজবাড়ির পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান বলেন,‘ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান খুনের সঙ্গে জড়িত ইউসুফ মেম্বারসহ খুনীদের গ্রেপ্তার অভিযানের পর থেকেই একটি মহল নানাভাবে আমাদের পুলিশ বাহিনীর উপর পরোক্ষভাবে চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। কিন্তু পুলিশ ওইসবকেক পাত্তা না নিয়ে একের পর এক অভিযান চালাতে থাকে। সম্প্রতি স্কুল শিক্ষক হত্যা মামলার অন্যতম আসামী ও ১৮ মামলার অন্যতম জজ আলী বিশ্বাসসহ খুনীদের গ্রেপ্তারের পর থেকে প্রভাবশালী মহলটটি নানাভাবে পুলিশের মনোবল ভাঙ্গার চেষ্টা করছে