রাসসুন্দরী পাঠাগার ‘ হোক বোধের কেন্দ্রস্থল
- প্রকাশের সময় : ০৭:৪৯:৪৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২০
- / ২১৮০ জন সংবাদটি পড়েছেন
- নেহাল আহমেদ
রাসসুন্দরী জন্ম ১৮০৯ সালে অবভিক্ত বাংলার পাবনা জেলার পোতাদিয়া গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। মাত্র তের বছর বয়সে বৈবাহিক সুত্রে তিনি রাজবাড়ী জেলার ভররামদিয়া গ্রামে চলে আসেন। এখানকার পরিবেশ সাংস্কৃতির চিন্তাধারনা নিয়ে তিনি লিখেন বাংলা সাহিত্যের প্রথম আতœ জীবনী আমার জীবন।
শিবনাথ শাস্ত্রী ১৮৮৪ সালে তাঁর ডায়রির এক জায়গায় লিখেছিেেন ‘আমাদের লেখকদের মধ্যে সংস্কার আছে যে জীবনচরিত্র লিখতে হইলে, বড় বড় লোকদেরেই জীবনচরি লেখা র্কত্তব্য —–তোমার আমার মত লোকের জীবনচরিত্র আবার কি লিখবি। কিন্ত ইহা ভ্রম, যে কেহ সৎ পথে থাকিয়া নিজ পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের গুণে আপনার উন্নতিসাধন করিয়াছে, সে সকলেরই জীবনচরিত্ত লেখা কর্তব্য । ১৮৯১ সালে বিদ্যাসাগরের মৃত্যুর তিন মাস পরে তাঁর অসর্ম্পূণ জীবনচরিত্ত প্রকাশতি হয়। তারও সাত বছর পরে পুত্র রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগে মর্হষি দেবেন্দ্রেনাথরে ‘আত্মচরিত্ত’ প্রকাশতি হয়ছেলি ১৮৯৮ সালে। রাজনারায়ণ বসুর আত্মজীবনী বেরোয় ১৯০৯ সালে। আরও পরে ১৯১৮ সালে শিবনাথ শাস্ত্রীর ‘আত্মচরিত্ত’ প্রকাশতি হলে বাংলা সাহিত্যে আত্মচরিত্রে প্লাবন বইতে শুরু করে। কিন্ত ১৮৭৬ সালে বাংলা ভাষার প্রথম আত্মজীবনীটি লিখে যিনি সাহিত্যের ইতিহাসে অমর হয়ে গেলেন তিনি এক সাধারণ গৃহবধু রাসসুন্দরী দাসী। সবাইকে আর্শ্চয করে দিয়ে এই লেখাপড়া না জানা মহিলা একটু একটু করে পড়তে শিখে তাঁর ৬০ বছর বয়সে গিয়ে লিখে ফেলেছিলেন অপরূপ এক অন্তরীণ জীবনকথা। কলকিাতা সুচারু যন্ত্রে মুিদ্রত, ‘আমার জীবন’ ( প্রথম ভাগ ) ১৩৫ পৃষ্ঠার এই আত্মজীবনী বাংলা সাহিত্যরে ইতিহাসে এক মাইলফলক হয়ে রয়ে গেল। অষ্টআশি বছরে এসে রাসসুন্দরী যোগ করলনে পরের পঁচাশি বছরের তাঁর জীবনরে ঘটনাপ্রবাহ। সেই সংস্করণরে প্রকাশকাল ১৮৯৮ সাল। সর্ম্পূণ গ্রন্থটরি নামও ছিল ‘আমার জীবন’।
রাসসুন্দরী যখন বালিকা তখন বাঙলার সংস্কৃতিতে একটু একটু করে আধুনিকতার সংযোজন হয়ে চলেছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নিজেদের রাজনীতির ক্ষমতা বাড়িয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে এদেশে ছাপাখানা আমদানি, ইউরোপীয় রীতির মেশিনারী শিক্ষা, র্ফোট উইলয়িাম কলেজ, হিদিু স্কুল, স্কুল বুক সোসাইটি প্রতিষ্ঠা, বাঙলা হরফ বিন্যাস, সংবাদপত্র প্রকাশ এসবরে মধ্যে দিয়ে উত্তর ঔপনিবেশিক আধুিনকতারও সূচনা করে চলেছে। ১৮১৮ সাল থকেইে প্রথম প্রথাগত শিক্ষার বাঁধা গন্ডি ভেঙে এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় কিছুটা সংস্কার শুরু হয়েছিল। রাসসুন্দরী গ্রামে থেকে, বিশাল সংসার সামলে যখন নিজের বড় ছেলের কাছে সদ্য অক্ষর চিনতে শিখেছেন, সেই আলো, সেই অন্ধকার
‘রাসসুন্দরীর যৌবনে তখনও মেয়েদের শায়া-ব্লাউজ পরার চল ছিলি না। অনেক পরে উনিশ শতকের মাঝামাঝি ঠাকুরবাড়ীর ঘরানার ‘বোম্বাই দস্তুর শাড়ি মেয়েদের পরতে শিখিয়েছিলেন জ্ঞানদানন্দিনী। রবীন্দ্রনাথরে দিদি সৌদামিনী লিখিছেন, “আমরা যখন শেমিজ, শায়া, জুতা, মোজা পরিয়া গাড়ী চড়িয়া বাহির হইতে লাগিলাম তখন চারদিকি হইতে যে কিরূপ ধিক্কার উঠিয়াছিল তাহা এখনকার দিনে কল্পনা করা সহজ নয়।” রাসসুন্দরী জন্মে ছিলেন সেই নবযুগ থেকে র্অধশতাব্দী পিছনে। গোলাম মুরশদি তাঁর ‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’ বইতে লখিছেনে, “রাসসুন্দরী দেবীর বিয়ে হয় বারো বছর বয়সে। তা সত্বেও বিয়ের পরে লম্বা ঘোমটা টেেন তিনি শাশুড়ী এবং তাঁর দুই ননদের সঙ্গে নিজের পর্দা রক্ষা করতেন। আর স্বামীকে তিনি চিরদিনই দারুণ ভয় এবং লজ্জা করতনে। এই লজ্জা এতো বেশি ছিলোযে, স্বামীর ঘোড়ার সামনে যেতেও তিনি লজ্জা পেতেন।”
তখন রাসসুন্দরীর পঁচশি বছর, একদনি বড় ছেলেকে তাঁর স্বামীর ঘোড়া ‘জয়হরি-র পিঠে চাপিয়ে তাঁকে দেখাতে নিয়ে এসে কেউ বললে —-দেখে, দেখে, ছেলে কেমন ঘোড়ায় চড়ে এসেছে দেখে ! রাসসুন্দরী ঘরে ছিলেন, র্কতার ঘোড়া জেনে ভাবতে লাগলেন-র্কতার ঘোড়ার সম্মুখে আমি কেমনে করিয়া যাই, ঘোড়া যদি আমাকে দেখে —–তবে বড় লজ্জার কথা।”
জ্যোতিরিন্দ্রনাথরে মতোই দীনেশচন্দ্র সেনও (১৮৬৬-১৯৩৯) বইটি সর্ম্পকে লিখিছেন “এই জীবনীখানি ব্যক্তিগত কথা বলিয়া উপেক্ষা করা চলে না। ইহা প্রাচীন হিন্দু রমণীর একটি খাঁটি নক্সা। যিনি নিজের কথা সরল ভাবে কহিয়া থাকেন, তিনি অলক্ষিতে সামাজিক চরিত্র অঙ্কন করিয়া যান। ‘আমার জীবন’ পুস্তকখানি শুধু রাসসুন্দরীর কথা নহে, উহা সেকেলে হিন্দু রমণীগণরে সকলরে কথা; এই চত্রিরে মত যথাযথ ও অকপট মহিলা-চরিত্র আমাদের বাঙ্গালা সাহিত্যে আর নাই। এখন মনে হয় এই পুস্তকখানি লিখিত না হইলে বাঙ্গলা সাহিত্যের একটি অধ্যায় অসর্ম্পূণ থাকয়িা যাইত।”অথচ াামাদের কি দুভাগ্য আজ দুশ বচরের পার হলেও তার মর্যদা আমরা দিতে পারি নাই।তার জন্ম স্থান রাজবাড়ীর অত্যন্ত পল্লী হলেও তার স্মৃতি রক্ষা কিংবা সম্পদ রক্ষা করার জন্য সরকার কিংবা রাজবাড়ীবাসী কেহ উদ্যোগ কেন নেননি তা সত্যিই বিস্ময়।রাসসুন্দরীর বাড়ীর দালানের ভগ্ন অংশ আর কিছু জায়গা এখনো অবশিষ্ট আছে।বর্তমানে তারবাড়ীতে একজন অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক বসবাস করেন। কোনসুত্রে তিনি জায়গা ভোগদখল করেন খবর নিলেই জানা যাবে।রাজবাড়ীর জেলার শিশু সংগঠক এবং নারী নেত্রী এ্যাডভোকেট দেবাগহুতি চক্রবর্তী তার মৃত্যর দুশো বছর উপলক্ষে একটি আলোচনা সভা করলেও হয়তো নানান কারনে তার ধারাবাহিকতা আর রাখতে পারেন নি।সর্¤úতি তার সম্পর্কে জানার পর এলাকাবাসীর সহায়তায় একটি স্মৃতি পাঠাগার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।আমরা আশা করবো এমন একটা মহৎকাজে সবাই এগিয়ে আসবেন।
একটি দেশের প্রতœতার্ত্তিক নিদর্শন কালক্রমে সেই দেশ-জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক-বাহক হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের জাতিসত্তা বিকাশের সুদীর্ঘ পথপরিক্রমা উদ্ঘাটনে, আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য সঠিকভাবে অনুধাবন করতে প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যে কোনো পুরোনো স্থাপনা পুরোনো বলেই পুরাতত্ত্ব, এই প্রতœ নিদর্শনগুলো খুবই মূল্যবান। পুরোনো স্থাপনায় ব্যবহূত ইট, কাঠ, পাথরের ব্যবহার হয়েছে, যা আমাদের গৌরবময় অতীত ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে আছে। উন্নত বিশ্ব তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর।অথচ আমরা ক্রমাগত উল্টো দিকেই হাঁটছি।
নেহাল আহমেদ
কবি, সাংস্কৃতিক কর্মী