Dhaka ০১:০২ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ২১ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

গোয়ালন্দে পদ্মার ভাঙনে গৃহহারা হাজারো মানুষের দুর্দশার শেষ কোথায়?

সংবাদদাতা-
  • প্রকাশের সময় : ০৭:৪১:৪৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ৯ অক্টোবর ২০১৯
  • / ১৫৫৩ জন সংবাদটি পড়েছেন


জনতার আদালত অনলাইন ॥
শরীরে প্রচন্ড দুর্বলতার ছাপ স্পষ্ট। কথা বলতে গিয়েই বোঝা গেল তিনি অন্ত্বসত্ত্বা। নাম জিজ্ঞাসা করতেই রাজ্যের লজ্জাভরা কণ্ঠে বললেন রওশনারা। চোখে মুখে তার রাজ্যের হতাশা। অন্যান্যদের সাথে তাদেরও আশ্রয় হয়েছে দৌলতদিয়া মডেল হাইস্কুল মাঠের এক পাশে। আশ্রয় বলতে বসতঘরের টিনের দুখানা চাল আড়াআড়ি করে তাবুর মতো করে স্থাপন করা। তার মাঝে কাঠের একখানা চৌকি পাতা। সাথে ঘর-গৃহস্থের কিছু জরুরী জিনিসপত্র। তখন বেলা প্রায় ৩টা। সকালে সামান্য কিছু খেলেও তখনো দুপুরের খাওয়া হয়নি। ৪/৫ দিন আগে ১নং ফেরি ঘাট এলাকা থেকে ভাঙনে ভিটে-মাটি হারিয়ে খোলা আকাশের নীচে তাদের ঠাঁই হয়েছে।
আলাপকালে রওশনারা জানান, তার স্বামী দিনমুজুর মমিন মন্ডল গেছেন ভাঙন থেকে তার বোনের বাড়ী-ঘর উদ্ধার করতে। তার শ্বশুর-শ্বাশুরী আশ্রয় নিয়েছেন আমার এক চাচা শ্বশুরের বাড়ীতে। এখানে খুবই অসহায় অবস্থায় আছে সে। শরীরের এই অবস্থায় কখন কি হয়ে যায় সে চিন্তাই শুধু তাকে তাড়া করে বেড়ায়। ভাঙনে সাজানো সংসার ও সহায় সম্বল হারানোর কথা বলতে বলতে অঝোরে কেঁদে ফেলেন রওশনারা।
সরেজমিন গোয়ালন্দ উপজেলার দেবগ্রাম ইউনিয়নের আরপিডিএস মাঠে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে শতাধিক পরিবার তাদের বসত ঘর সরিয়ে এনে স্তুপ করে রেখেছে। স্তুপ করে রাখা ঘরের চালা ও আসবাবপত্রের ফাঁক-ফোকরে তাদের চরম মানবেতর দিন-রাত কাটছে। সবার চোখে-মুখে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ভাবনা। কোথায় যাবে, কি ভাবে কাটবে তাদের আগামী দিন তা তারা কেউ জানেন না। চোখে পড়ল স্তুপ করে রাখা একটি ঘরের পাশে বসে ঘাসযুক্ত মাটি তুলে একটি পাত্রে রাখছেন বৃদ্ধ দম্পতি। নাম জিজ্ঞেসা করলে জানান, আব্দুল কুদ্দুস খা (৭০) ও হাসনা বেগম (৬৫)। কি করছেন বলতেই রাজ্যের হতাশা নিয়ে জানালেন, পাশের গ্রাম থেকে কিছু ধান চেয়ে এনেছিলাম, সে ধান ঘাসের মধ্যে পড়ে গেছে, তাই ঘাস-মাটিসহ ধান তুলে পানিতে ধুয়ে ধান আলাদা করব। কবে এখানে এসেছেন জানতে চাইলে তারা শুরু করলেন তাদের দুঃখগাঁথা। জানালেন, দেবগ্রাম ইউনিয়রেন আজিজ সরদারের পাড়ায় তাদের বাড়ি ছিল। নদী ভাঙনের শিকার হয়ে এক সপ্তাহ আগে এখানে আশ্রয় নিয়েছেন। বৃদ্ধ আব্দুল কুদ্দুস দৌলতদিয়া ঘাটে কুলির কাজ করতেন। কাজ করার সময় একটি হাত ভেঙে যাওয়ায় আর কাজ করতে পারেন না। একটি ছেলে সেলুনে কাজ করে, আরেকজন রিক্সা চালায়। তাদের আয়ে তাদের সংসারই চলে না। রিক্সা চালক ছেলে রফিক খা’র রিক্সাটিও বিকল হয়ে থাকায় রোজগার নেই বললেই চলে। এরমধ্যে রফিকের ঘরে একটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। ১৯ দিন বয়সী সেই সন্তানকে নিয়ে এখানে আশ্রয় নিয়েছি। শিশু নাতি কেমন আছে জানতে চাইলে বৃদ্ধা হাসনা বেগম বলেন, ‘কেমন আর থাকব বাবা, নিজেরা খাওন পাইনা, ছেলের বৌকে কি খাওয়াব? আর নাতির মা যুদি খাওন না পায় কোলের পোলার খাওনের দুধ আসপো কোহানথনে। এক ফোটা বুহির দুধির জন্নি নাতিটা খালি চিল্লায়।’ এ রকম শত শত গল্প এখন পদ্মা পাড়ের ঘরে ঘরে।
এখানে আশ্রয় নেয়া হাবিব খা, নাজিমদ্দিনসহ অনেকেই জানান, এই খোলা মাঠে তারা অত্যন্ত মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এখানে নেই কোনা টিউবওয়েল ও পায়খানা। তাদের কয়েকশ অসহায় মানুষের কথা চিন্তা করে যদি এখানে কয়েকটি টিউবওয়েল ও পায়খানা স্থাপন করা হয় তবে তারা কিছুটা স্বস্তি পেত।
গত কয়েক দিনে পদ্মার ভাঙনে গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া ও দেবগ্রাম ইউনিয়নের প্রায় ১ হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে হাজার হাজার বিঘা ফসলী জমি। গত এক সপ্তাহে শত শত পরিবার ভিটেমাটি ছাড়া হয়ে বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। এদের মধ্যে বেশীর ভাগ পরিবার বিভিন্ন সড়ক, মহাসড়ক, স্কুলের মাঠে খোলা আকাশের নীচে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। সামান্য আয়ের দিন মজুর মানুষ গুলি তাদের পরিবারের প্রয়োজনীয় জিনিষ পত্র গরু ছাগল নিয়ে খোলা আকাশের নীচে দিন কাটাচ্ছেন।
দৌলতদিয়া মডেল হাইস্কুল মাঠে ৫০/৬০টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছেন। সেখানে তাবু করে আশ্রয় নিয়েছেন মাজেদা বেগম। ছোট্ট তাবুর মাঝে তিনটি ছেলে, একটি মেয়ে ও তারা স্বামী-স্ত্রী মিলে গত কয়েকদিন মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন। খাবার পানি, গোসল ও প্রসাব-পায়খানার কোন ব্যবস্থা নেই। রওশনারা জানান, সকালে কোন রকম রান্না করতে পারলেও রাতে রান্নার মতো চাল বা অন্য কিছু তার কাছে নেই। এসময় সেখানে খোলা আকাশে নিচে আশ্রয় নেয়া একাধিক অসহায় মানুষ চোখে মুখে হতাশার ছাপ নিয়ে জানায়, হাতেম মন্ডলের পাড়ার ওহাব মন্ডল, আবু বক্কার মোল্লা, নতুন পাড়ার মোঃ ধনী প্রামানিক, আঃ রাজ্জাক, ঢল্লা পাড়ার কবির সরদার, আঃ রশিদ সরদার, আব্দুল সরদার, শাহ বেপারী পাড়ার আমজাদ শেখ, আবুল ডাক্তার, মজনু সরদার, হাসেম বেপারী, কাসেম ফকীর, মানিক শেখ, কালাম সরদার, লুৎফর সরদার, আঃ রশিদ সরদার সহ প্রায় ১৫০টি পরিবার বিভিন্ন স্থানে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছেন। এদের ঘর তোলার মত কোন জায়গা জমি নাই। এরা সবাই দিন এনে দিন খায়। ফের ঘর তুলে মাথাগোজার মত কোন ব্যবস্থা নাই।
দৌলতদিয়া ইউনিয়নের ঢল্লা পাড়া গ্রামের রেজাউল করিম জানান, এক সময় তাদের প্রায় শতাধিক বিঘা জমি ছিল। কয়েক বছরের ভাঙনের পর প্রায় ২০ বিঘা জমি অবশিষ্ট ছিল। এবারের ভাঙনে তাও বিলীন হয়ে গেছে। গত এক সপ্তাহ ধরে অন্যের জমিতে ঘরগুলো ভেঙে এনে স্তুপ করে রাখা হয়েছে। ঘর তোলার মাত কোন জায়গা পাচ্ছেন না।
এদিকে দৌলতদিয়া ১নং ও ২নং ফেরি এলাকার শত শত বাড়িঘর অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন। চোখের জল আর গায়ে ঘাম যেন এক হয়ে গেছে। কারো কোন কথা বলার সময় নেই। সবারই একটাই চাওয়া, সর্বস্ব নদীতে বিলীন হওয়ার আগে যতটুকু সরানো যায়। এ সময় অসহায় মানুষগুলোর আহাজারিতে সেখানে হৃদয়-বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়।
১নং ফেরিঘাটের মাথায় ভাঙনের একেবারে মুখে থাকা দুই ভাই আরশাদ সিকদার ও খবির সিকদার তাদের বিরাট দুটি টিনের ঘর ভাঙছিলেন। তাদেরকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছেন আত্মীয়-স্বজনরা। কথা বলার সময় শিশুর মতো হাউ-মাউ করে কেঁদে ওঠেন আরশাদ সিকদার।
এদিকে সরকারি হিসেবে গত শনিবার পর্যন্ত দৌলতদিয়া ও দেবগ্রাম ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম ও ফেরি ঘাটসহ আশপাশ এলাকার ৫৫৮টি পরিবার ভাঙনের শিকার হয়েছেন। ভাঙন আতঙ্কে অন্যত্র সরে গেছে আরো কয়েকশ পরিবার। এখনো নিরাপদ স্থানে যাবার চেষ্টা করছেন আরো অনেক পরিবার।
গোয়ালন্দ উপজেলা কৃষি অফিসার শিকদার মুহা. মুহায়মেন আক্তার জানান, গত এক সপ্তাহের নদী ভাঙনে ১৮০ হেক্টর জমির ফসল নদী গর্ভে চলে গেছে। এছাড়া আকষ্মিক বন্যায় ২৫ হেক্টর জমির ফসল সম্পন্ন নষ্ট হয়ে গেছে।
গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী অফিসার রুবায়েত হায়াত শিপলু জানান, আমরা শনিবার পর্যন্ত ৫৫৮টি পরিবারের নদী ভাঙনে সর্বস্ব হারানোর তথ্য পেয়েছি। তাদের জন্য নগদ অর্থ, ঢেউটিন ও খাদ্য সাহায্য চেয়ে জেলা প্রশাসনে আবেদন জানানো হয়েছে। এছাড়া ইতিপূর্বে তালিকা করা ৫৯টি পরিবারের জন্য শুকনো খাবারের বরাদ্দ পাওয়া গেছে। দুর্গতদের দৌলতদিয়া আক্কাস আলী হাইস্কুল, দৌলতদিয়া ইউনিয়ন পরিষদ সংলগ্ন হেলিপ্যাডের উচু স্থান, দেবগ্রাম আশ্রয় কেন্দ্র, গুচ্ছগ্রামসহ অন্যান্য স্থানে আশ্রয় নেয়ার জন্য তিনি পরামর্শ দিয়ে জানান, প্রকৃতিক দুর্যোগে গৃহহীন হয়ে পড়া এ সকল পরিবারের মধ্যে সরকারী খাস জমি চি‎িহ্নত করে বন্দোবস্থ দেয়ার চিন্তা ভাবনা করা হচ্ছে।

Tag :

সংবাদটি আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন-

গোয়ালন্দে পদ্মার ভাঙনে গৃহহারা হাজারো মানুষের দুর্দশার শেষ কোথায়?

প্রকাশের সময় : ০৭:৪১:৪৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ৯ অক্টোবর ২০১৯


জনতার আদালত অনলাইন ॥
শরীরে প্রচন্ড দুর্বলতার ছাপ স্পষ্ট। কথা বলতে গিয়েই বোঝা গেল তিনি অন্ত্বসত্ত্বা। নাম জিজ্ঞাসা করতেই রাজ্যের লজ্জাভরা কণ্ঠে বললেন রওশনারা। চোখে মুখে তার রাজ্যের হতাশা। অন্যান্যদের সাথে তাদেরও আশ্রয় হয়েছে দৌলতদিয়া মডেল হাইস্কুল মাঠের এক পাশে। আশ্রয় বলতে বসতঘরের টিনের দুখানা চাল আড়াআড়ি করে তাবুর মতো করে স্থাপন করা। তার মাঝে কাঠের একখানা চৌকি পাতা। সাথে ঘর-গৃহস্থের কিছু জরুরী জিনিসপত্র। তখন বেলা প্রায় ৩টা। সকালে সামান্য কিছু খেলেও তখনো দুপুরের খাওয়া হয়নি। ৪/৫ দিন আগে ১নং ফেরি ঘাট এলাকা থেকে ভাঙনে ভিটে-মাটি হারিয়ে খোলা আকাশের নীচে তাদের ঠাঁই হয়েছে।
আলাপকালে রওশনারা জানান, তার স্বামী দিনমুজুর মমিন মন্ডল গেছেন ভাঙন থেকে তার বোনের বাড়ী-ঘর উদ্ধার করতে। তার শ্বশুর-শ্বাশুরী আশ্রয় নিয়েছেন আমার এক চাচা শ্বশুরের বাড়ীতে। এখানে খুবই অসহায় অবস্থায় আছে সে। শরীরের এই অবস্থায় কখন কি হয়ে যায় সে চিন্তাই শুধু তাকে তাড়া করে বেড়ায়। ভাঙনে সাজানো সংসার ও সহায় সম্বল হারানোর কথা বলতে বলতে অঝোরে কেঁদে ফেলেন রওশনারা।
সরেজমিন গোয়ালন্দ উপজেলার দেবগ্রাম ইউনিয়নের আরপিডিএস মাঠে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে শতাধিক পরিবার তাদের বসত ঘর সরিয়ে এনে স্তুপ করে রেখেছে। স্তুপ করে রাখা ঘরের চালা ও আসবাবপত্রের ফাঁক-ফোকরে তাদের চরম মানবেতর দিন-রাত কাটছে। সবার চোখে-মুখে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ভাবনা। কোথায় যাবে, কি ভাবে কাটবে তাদের আগামী দিন তা তারা কেউ জানেন না। চোখে পড়ল স্তুপ করে রাখা একটি ঘরের পাশে বসে ঘাসযুক্ত মাটি তুলে একটি পাত্রে রাখছেন বৃদ্ধ দম্পতি। নাম জিজ্ঞেসা করলে জানান, আব্দুল কুদ্দুস খা (৭০) ও হাসনা বেগম (৬৫)। কি করছেন বলতেই রাজ্যের হতাশা নিয়ে জানালেন, পাশের গ্রাম থেকে কিছু ধান চেয়ে এনেছিলাম, সে ধান ঘাসের মধ্যে পড়ে গেছে, তাই ঘাস-মাটিসহ ধান তুলে পানিতে ধুয়ে ধান আলাদা করব। কবে এখানে এসেছেন জানতে চাইলে তারা শুরু করলেন তাদের দুঃখগাঁথা। জানালেন, দেবগ্রাম ইউনিয়রেন আজিজ সরদারের পাড়ায় তাদের বাড়ি ছিল। নদী ভাঙনের শিকার হয়ে এক সপ্তাহ আগে এখানে আশ্রয় নিয়েছেন। বৃদ্ধ আব্দুল কুদ্দুস দৌলতদিয়া ঘাটে কুলির কাজ করতেন। কাজ করার সময় একটি হাত ভেঙে যাওয়ায় আর কাজ করতে পারেন না। একটি ছেলে সেলুনে কাজ করে, আরেকজন রিক্সা চালায়। তাদের আয়ে তাদের সংসারই চলে না। রিক্সা চালক ছেলে রফিক খা’র রিক্সাটিও বিকল হয়ে থাকায় রোজগার নেই বললেই চলে। এরমধ্যে রফিকের ঘরে একটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। ১৯ দিন বয়সী সেই সন্তানকে নিয়ে এখানে আশ্রয় নিয়েছি। শিশু নাতি কেমন আছে জানতে চাইলে বৃদ্ধা হাসনা বেগম বলেন, ‘কেমন আর থাকব বাবা, নিজেরা খাওন পাইনা, ছেলের বৌকে কি খাওয়াব? আর নাতির মা যুদি খাওন না পায় কোলের পোলার খাওনের দুধ আসপো কোহানথনে। এক ফোটা বুহির দুধির জন্নি নাতিটা খালি চিল্লায়।’ এ রকম শত শত গল্প এখন পদ্মা পাড়ের ঘরে ঘরে।
এখানে আশ্রয় নেয়া হাবিব খা, নাজিমদ্দিনসহ অনেকেই জানান, এই খোলা মাঠে তারা অত্যন্ত মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এখানে নেই কোনা টিউবওয়েল ও পায়খানা। তাদের কয়েকশ অসহায় মানুষের কথা চিন্তা করে যদি এখানে কয়েকটি টিউবওয়েল ও পায়খানা স্থাপন করা হয় তবে তারা কিছুটা স্বস্তি পেত।
গত কয়েক দিনে পদ্মার ভাঙনে গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া ও দেবগ্রাম ইউনিয়নের প্রায় ১ হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে হাজার হাজার বিঘা ফসলী জমি। গত এক সপ্তাহে শত শত পরিবার ভিটেমাটি ছাড়া হয়ে বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। এদের মধ্যে বেশীর ভাগ পরিবার বিভিন্ন সড়ক, মহাসড়ক, স্কুলের মাঠে খোলা আকাশের নীচে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। সামান্য আয়ের দিন মজুর মানুষ গুলি তাদের পরিবারের প্রয়োজনীয় জিনিষ পত্র গরু ছাগল নিয়ে খোলা আকাশের নীচে দিন কাটাচ্ছেন।
দৌলতদিয়া মডেল হাইস্কুল মাঠে ৫০/৬০টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছেন। সেখানে তাবু করে আশ্রয় নিয়েছেন মাজেদা বেগম। ছোট্ট তাবুর মাঝে তিনটি ছেলে, একটি মেয়ে ও তারা স্বামী-স্ত্রী মিলে গত কয়েকদিন মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন। খাবার পানি, গোসল ও প্রসাব-পায়খানার কোন ব্যবস্থা নেই। রওশনারা জানান, সকালে কোন রকম রান্না করতে পারলেও রাতে রান্নার মতো চাল বা অন্য কিছু তার কাছে নেই। এসময় সেখানে খোলা আকাশে নিচে আশ্রয় নেয়া একাধিক অসহায় মানুষ চোখে মুখে হতাশার ছাপ নিয়ে জানায়, হাতেম মন্ডলের পাড়ার ওহাব মন্ডল, আবু বক্কার মোল্লা, নতুন পাড়ার মোঃ ধনী প্রামানিক, আঃ রাজ্জাক, ঢল্লা পাড়ার কবির সরদার, আঃ রশিদ সরদার, আব্দুল সরদার, শাহ বেপারী পাড়ার আমজাদ শেখ, আবুল ডাক্তার, মজনু সরদার, হাসেম বেপারী, কাসেম ফকীর, মানিক শেখ, কালাম সরদার, লুৎফর সরদার, আঃ রশিদ সরদার সহ প্রায় ১৫০টি পরিবার বিভিন্ন স্থানে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছেন। এদের ঘর তোলার মত কোন জায়গা জমি নাই। এরা সবাই দিন এনে দিন খায়। ফের ঘর তুলে মাথাগোজার মত কোন ব্যবস্থা নাই।
দৌলতদিয়া ইউনিয়নের ঢল্লা পাড়া গ্রামের রেজাউল করিম জানান, এক সময় তাদের প্রায় শতাধিক বিঘা জমি ছিল। কয়েক বছরের ভাঙনের পর প্রায় ২০ বিঘা জমি অবশিষ্ট ছিল। এবারের ভাঙনে তাও বিলীন হয়ে গেছে। গত এক সপ্তাহ ধরে অন্যের জমিতে ঘরগুলো ভেঙে এনে স্তুপ করে রাখা হয়েছে। ঘর তোলার মাত কোন জায়গা পাচ্ছেন না।
এদিকে দৌলতদিয়া ১নং ও ২নং ফেরি এলাকার শত শত বাড়িঘর অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন। চোখের জল আর গায়ে ঘাম যেন এক হয়ে গেছে। কারো কোন কথা বলার সময় নেই। সবারই একটাই চাওয়া, সর্বস্ব নদীতে বিলীন হওয়ার আগে যতটুকু সরানো যায়। এ সময় অসহায় মানুষগুলোর আহাজারিতে সেখানে হৃদয়-বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়।
১নং ফেরিঘাটের মাথায় ভাঙনের একেবারে মুখে থাকা দুই ভাই আরশাদ সিকদার ও খবির সিকদার তাদের বিরাট দুটি টিনের ঘর ভাঙছিলেন। তাদেরকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছেন আত্মীয়-স্বজনরা। কথা বলার সময় শিশুর মতো হাউ-মাউ করে কেঁদে ওঠেন আরশাদ সিকদার।
এদিকে সরকারি হিসেবে গত শনিবার পর্যন্ত দৌলতদিয়া ও দেবগ্রাম ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম ও ফেরি ঘাটসহ আশপাশ এলাকার ৫৫৮টি পরিবার ভাঙনের শিকার হয়েছেন। ভাঙন আতঙ্কে অন্যত্র সরে গেছে আরো কয়েকশ পরিবার। এখনো নিরাপদ স্থানে যাবার চেষ্টা করছেন আরো অনেক পরিবার।
গোয়ালন্দ উপজেলা কৃষি অফিসার শিকদার মুহা. মুহায়মেন আক্তার জানান, গত এক সপ্তাহের নদী ভাঙনে ১৮০ হেক্টর জমির ফসল নদী গর্ভে চলে গেছে। এছাড়া আকষ্মিক বন্যায় ২৫ হেক্টর জমির ফসল সম্পন্ন নষ্ট হয়ে গেছে।
গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী অফিসার রুবায়েত হায়াত শিপলু জানান, আমরা শনিবার পর্যন্ত ৫৫৮টি পরিবারের নদী ভাঙনে সর্বস্ব হারানোর তথ্য পেয়েছি। তাদের জন্য নগদ অর্থ, ঢেউটিন ও খাদ্য সাহায্য চেয়ে জেলা প্রশাসনে আবেদন জানানো হয়েছে। এছাড়া ইতিপূর্বে তালিকা করা ৫৯টি পরিবারের জন্য শুকনো খাবারের বরাদ্দ পাওয়া গেছে। দুর্গতদের দৌলতদিয়া আক্কাস আলী হাইস্কুল, দৌলতদিয়া ইউনিয়ন পরিষদ সংলগ্ন হেলিপ্যাডের উচু স্থান, দেবগ্রাম আশ্রয় কেন্দ্র, গুচ্ছগ্রামসহ অন্যান্য স্থানে আশ্রয় নেয়ার জন্য তিনি পরামর্শ দিয়ে জানান, প্রকৃতিক দুর্যোগে গৃহহীন হয়ে পড়া এ সকল পরিবারের মধ্যে সরকারী খাস জমি চি‎িহ্নত করে বন্দোবস্থ দেয়ার চিন্তা ভাবনা করা হচ্ছে।