কালুখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স
ডাক্তার সংকটে ব্যাহত স্বাস্থ্যসেবা
- প্রকাশের সময় : ০৪:৫৫:০৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ১ ডিসেম্বর ২০২৪
- / ১০৪৯ জন সংবাদটি পড়েছেন
রাজবাড়ীর কালুখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডাক্তার সংকটে ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসাসেবা। মাত্র তিনজন ডাক্তার দিয়ে চলছে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি। ডাক্তার সংকটের কারণে রোগীও খুব একটা যায়না। দোরগোড়ায় হাসপাতাল থাকলেও তার সুফল খুব একটা ভোগ করতে পারছে না উপজেলাবাসী। একটু বেশি সমস্যা হলেই উপজেলার বাসিন্দারা ছেটেন রাজবাড়ী শহর অথবা ফরিদপুর। স্থানীয়রা বলছেন, খুব দায়ে না পড়লে কেউ চিকিৎসা নিতে যায়না সেখানে। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা ডাক্তার চেয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছেন।
সাতটি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত কালুখালী উপজেলার জনসংখ্যা এক লাখ ৬০ হাজার জন। যাদের বেশির ভাগই দরিদ্র। দরিদ্রসীমার নিচে বাস করা মানুষের সংখ্যাও কম নয়। এসব মানুষের সাধ্য নেই দূরবর্তী জায়গায় গিয়ে চিকিৎসা করানোর। দৌলতদিয়া-কুষ্টিয়া আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে কালুখালী উপজেলার বোয়ালিয়া নামক স্থানে অবস্থিত ৫০ শয্যা বিশিষ্ট কালুখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। সম্প্রতি সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, নীচতলায় বহিঃ বিভাগে প্রায় একশ জন রোগী ডাক্তারের অপেক্ষায় রয়েছে। দ্বিতীয় তলায় স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাসহ অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কক্ষ। তৃতীয় তলায় এক পাশে শিশু ওয়ার্ড, অপর পাশে নারী ওয়ার্ড। চতুর্থ তলায় পুরুষ ওয়ার্ড। শিশু ও পুরুষ ওয়ার্ডে কোনো রোগী নেই। নারী ওয়ার্ডে মাত্র তিনজন রোগী ভর্তি।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্র জানায়, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১০ জন মেডিকেল অফিসার থাকার কথা। সেখানে রয়েছেন মাত্র তিনজন। আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা পদটি শূন্য রয়েছে ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে। জুনিয়র কনসালটেন্ট (সার্জারী) আক্তার হোসেন ডেপুটেশনে রাজবাড়ী সদর হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করছেন। তবে, নার্সের কোনো ঘাটতি নেই। ৩০ জন নার্স রয়েছেন এখানে। এাছাড়া পরিচ্ছন্নতা কর্মীর সংকট রয়েছে। আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে দুজনকে নিয়োগ দিয়ে কাজ চালানো হচ্ছে। আয়া ও ওয়ার্ড বয় দুজনকে করে থাকার কথা। নেই একজনও।
স্থানীয়রা জানান, মহাসড়কের পাশে হাসপাতালটির অবস্থান হওয়ায় এর গুরুত্ব অনেক। মাঝে মধ্যে ছোট বড় দুর্ঘটনা ঘটে মহাসড়কে। আহতদের ত্বরিৎ চিকিৎসার জন্য সেখানে নেওয়া যায় সহজেই। কিন্তু ডাক্তারই যদি না থাকে তাহলে নিয়ে কী হবে। সেখান থেকে হয় রাজবাড়ী নয়তো ফরিদপুর পাঠাবে। এতে সময় নষ্ট হয়। একারণে অনেকেই আগেভাগেই রাজবাড়ী অথবা ফরিদপুর নিয়ে যায়।
তবে, হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের খুব একটা অভিযোগ নেই। হাসপাতালে ভর্তি আকলিমা খাতুন জানান, পেটের ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। ডাক্তাররা চিকিৎসা দিয়েছেন। এখন একটু ভালোর দিকে। ডাক্তার এবং নার্সরা তার খোঁজ খবর নিয়েছেন।
কথা হয় বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা কয়েকজনের সাথে। রোহান হোসেন নামে একজন জানালেন, তার নানীর জ¦র। পাঁচ টাকা টিকিট কেটে ডাক্তার দেখিয়েছেন। কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে দিয়েছেন। ওষুধও হাসপাতাল থেকেই দিয়েছে।
রতনদিয়া গ্রামের বাসিন্দা লুৎফা বেগম জানান, তার বোনকে গাইনী ডাক্তার দেখাতে এসেছেন। প্রায় এক ঘণ্টা হয়ে গেছে। এখনও সিরিয়াল পাননি।
হাসপাতালের সামনে মুদি দোকানী হযরত আলী জানান, আগে ডাক্তার ছিল। রোগীও ছিল। এখন ডাক্তার নেই। তাই রোগীও কম আসে। ডাক্তার কবে আসে কবে চলে যায়। কিছুই বোঝা যায়না। এভাবে একটা হাসপাতাল চলেনা। হাসপাতালে চিকিৎসাসেবার মান বাড়ানোর জন্য তিনি দাবি জানান। একই দাবি জানান বহরের কালুখালী গ্রামের বাসিন্দা ভ্যানচালক দিলবার হোসেন। তিনি বলেন, হাসপাতালে ডাক্তার থাকলে সেবা পাওয়া গেলে মানুষকে কষ্ট করে রাজবাড়ী, ফরিদপুর যেতে হয়না। হাতের কাছে চিকিৎসা পেলে বাইরে কেন যাবে।
কালুখালী উপজেলার সাংস্কৃতিক সংগঠক জাহিদ হোসেন বলেন, কালুখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে হরেক রকম সমস্যা। ডাক্তার নেই বলে সাধারণ রোগীরাও বাইরে চলে যাচ্ছে। তাদের যাতায়াত খরচ যেমন লাগছে তেমনি ভোগান্তিও হচ্ছে। এছাড়া হাসপাতালে স্যানিটেশন একটি বড় সমস্যা। এসব সমস্যা দূর করে একটি আধুনিক হাসপাতাল গড়ার দাবি করেন তিনি।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দায়িত্বরত একজন চিকিৎসক (নাম প্রকাশে রাজী হননি) জানান, একটি হাসপাতাল চালাতে কতজন ডাক্তার দরকার সে বিষয়ে সবারই ধারণা আছে। জরুরি বিভাগে একজন সকালে, একজন সন্ধ্যায়, একজন রাতে দায়িত্ব পালন করেন। রাতে যিনি দায়িত্ব পালন করবেন তিনি পরদিন সকালে ছুটি পাবেন। সেখানে আছেনই তিনজন ডাক্তার। কে কীভাবে দায়িত্ব পালন করবেন। এখন আছে দুজন। একজন বহিঃবিভাগে রোগী দেখছেন। আরেকজন জরুরি বিভাগে রয়েছেন।
কালুখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. ইসরাত জাহান উম্মন বলেন, কালুখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মেডিকেল অফিসার পদ ১০ জন। রয়েছেন মাত্র তিনজন। এটা অনেক বড় সংকট। তিনজনকে দিয়ে চালানো খুবই সমস্যা হচ্ছে। মর্নিং, ইভেনিং, নাইট তিন শিফট চালানো খুবই দুষ্কর হয়ে পড়ছে। যারা দায়িত্ব পালন করছেন তাদের জন্যও কষ্ট হচ্ছে। পরপর তিনদিন তিনি নিজে রাতে ডিউটি করেছেন। এখন কিছু করার নেই। যত জায়গায় আবেদন করা যায়, ফোনে বলা যায় তিনি বলছেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। একজনকে পদায়ন করেছিল। কিন্তু তিনি যোগ দিচ্ছেন না। ডাক্তার না থাকার কারণে রোগী কম হবে এটা খুবই স্বাভাবিক। রোগী বা তার স্বজন যখন দেখবে একজন ডাক্তার সব দিকে দৌড়াচ্ছে সে আস্থা পাবেনা। আগে ৩০ থেকে ৩৫ জন রোগী ভর্তি থাকত। ডাক্তার সংকটের কারণে আস্থাহীনতার জায়গা তৈরি হচ্ছে। বহিঃবিভাগে প্রতিদিন প্রায় আড়াইশ জন রোগী আসছে। তাদের দেখছেন মাত্র দুজন ডাক্তার। তাকে প্রশাসনিক বিষয়টি দেখতে হচ্ছে। মাঝে মধ্যে মিটিংসহ প্রশাসনিক কাজে হাসপাতালের বাইরে যেতে হচ্ছে। ডাক্তার ছাড়া আর কোনো কিছুর তেমন সমস্যা নেই। দুজন পরিচ্ছন্নতা কর্মী আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ দিয়ে কাজ চালানো হয়েছে।
রাজবাড়ীর সিভিল সার্জন ডা. ইব্রাহীম টিটন বলেন, কালুখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডাক্তার সংকট রয়েছে। মাত্র তিনজন ডাক্তার আছে সেখানে। নতুন একজনের অর্ডার হয়েছিল। তিনি যোগ দেননি। আমরা ডাক্তার চেয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে চিঠি পাঠিয়েছি। পরিচ্ছন্নতা কর্মী নিয়োগের জন্য মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন পাওয়া গেছে।