Dhaka ০২:৩০ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষের শরীরের ক্ষত সারিয়েই তৃপ্তি তার

স্টাফ রিপোর্টার
  • প্রকাশের সময় : ০৯:১৬:২৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৮ জুন ২০২৪
  • / ১০৬২ জন সংবাদটি পড়েছেন

সারা শরীর নোংরায় আবৃত। হাতে বা পায়ে ঘা। রাজবাড়ী শহরের রেল স্টেশনসহ বিভিন্ন স্থানে ঘোরা ফেরা করে তারা। কখনও তীব্র যন্ত্রণায় ছটফট করে। মানসিক বিকারগ্রস্ত পরিচয় ও ঠিকানাবিহীন এ ধরনের মানুষ দেখলেই যে কেউ ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেয়। কিন্তু এগিয়ে যান চঞ্চল কুন্ডু(৫৫)। পরম যতেœ সেবা শুশ্রƒষা করেন। যতদিন শারীরিকভাবে সুস্থ করতে না পারেন ততদিন তার চিকিৎসা করেন। গোসল করানো থেকে শুরু করে খাবারও খাওয়ান। গত ১৩ বছর ধরে এভাবে প্রায় দুইশ জন মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষকে সুস্থ করেছেন। চঞ্চল কুন্ডু রাজবাড়ী শহরের রেলস্টেশন সংংলগ্ন রেলকলোনীর বাসিন্দা। একটি ওষুধ কোম্পানীর বিক্রয় কর্মী তিনি।
চঞ্চল কুন্ডু জানান, মানুষ যেমনই হোক সে মানুষ। মানুষের কষ্ট দেখে তিনি ভীষণ কষ্ট পান। আর এজন্যই তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষের সেবা শুশ্রƒষায় এগিয়ে যান। ১৩ বছর আগে তিনি শুরু করেছিলেন এ কাজ। এ পর্যন্ত এ ধরনের দুইশ মানুষকে সেবা করেছেন। যাদের কোন ঠিকানা নেই। তারা তাদের নাম পরিচয়ও বলতে পারেনা। শরীরিকভাবে সুস্থ করতে পারলেও তাদের মানসিকভাবে সুস্থ করার ক্ষমতা তার নেই। মানসিক বিকৃত এইসব মানুষদের শরীরে অনেক বড় বড় ঘা হয়। কারো কারো পোকাও হয়ে যায় ক্ষতস্থানে। এই ক্ষত সারাতে তিন থেকে চার মাস পর্যন্ত লেগে যায়। দামী ওষুধ ও ইনজেকশন দিতে হয়। তিনি নিজে যা আয় করেন তা দিয়ে সংসার চালানোই দায় হয়ে পড়ে। মানুষের কাছে সাহায্য নিয়ে তাদের সেবা করেন। সকাল ও দুপুরে নিজের বাড়ির রান্না করা খাবার খাওয়ান। কখনও কখনও রেস্তোরাঁ থেকে কিনে খাওয়ান। এই মানুষদের সারা শরীরে নোংরা থাকে। কেউ ঠিকমত জামা কাপড় পরতে পারেনা। কেউ মলমূত্র জামা কাপড়েই করে ফেলে। তাদের কাছে কেউ এগিয়ে যেতে চায়না। যাওয়ার কথাও নয়। তিনি মুখে মাস্ক লাগিয়ে তাদের গোসল করান। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা করেন। তার সেবা শুশ্রƒষায় যখন সুস্থ হয় এটাই তার আত্মতৃপ্তি।
চঞ্চল কুন্ডু বলেন, কয়েকদিন আগে ৩০ বছর বয়সী এক যুবককে দেখেন রেল স্টেশনের পশ্চিম দিকে ওভারব্রীজে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। তার সারা শরীরে নোংরা ময়লা। সে যেখানে ছিল সেখান দিয়ে লোকজন যাতায়াত করার সময় মুখে রুমাল চেপে যায়। লক্ষ্য করে দেখেন, তার বাম পায়ের অগ্রভাগে ঘা হয়েছে। তিনি তাকে নিয়ে গোসল করান। ক্ষতস্থানে চিকিৎসা করেন। সপ্তাহে তিন দিন তাকে গোসল করাচ্ছেন। নিয়মিত ঘায়ে পরিচর্যা করেন। তার অবস্থা একটু উন্নতির দিকে। সে তার নাম ঠিকানা কিছুই বলতে পারেন না। শুধু ‘মাদারীপুর’ বাড়ি এটুকু বলতে পারে।
এরও কিছুদিন আগে আরও একজনকে সুস্থ করেছেন। ঠিকানাবিহীন এই লোকটিকে সবাই ‘প্রদীপ পাগল’ বলত। প্রদীপের পায়ে এমন অবস্থা হয়েছিল যে কেউ ওদিকে তাকাতো না। যন্ত্রণায় কাতরাতো। সবাই ধরেই নিয়েছিল সে মারা যাবে। তিনি এগিয়ে যান। দীর্ঘ ছয় মাস তার সেবা শুশ্রƒষা করে তাকে সুস্থ করেছেন। প্রদীপ এখন হেঁটে বেড়ায়।
তিনি বলেন, এই ধরনের রোগীদের দায়িত্ব কেউ নিতে চায়না। হাসপাতালে নিয়ে গেলে বলে, তার দেখাশোনা কে করবে? কতদিন হাসপাতালে থাকতে হবে এর কোনো ঠিক নেই। এজন্য এখন আর হাসপাতালে পাঠানোর কথা ভাবেন না। পুলিশের কাছে গেলে তার পূর্ণ ঠিকানা জোগার করে দিতে বলে।
এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, দীর্ঘদিন ওষুধ কোম্পানীর সাথে যুক্ত থেকেছেন। ক্ষতস্থান সারাতে কী কী প্রয়োজন তা দেখে দেখে শিখেছেন। এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে তিনি চিকিৎসা দেন। অনেকেই তার এই কাজের প্রশংসা করেন। কিন্তু তার সাথে কাজ করার আগ্রহ কেউ দেখায় না। ভিপিকেএ নামের একটি প্রতিষ্ঠান তার এই কাজে সহযোগিতা করবে বলে আশ^াস দিয়েছে।
রাজবাড়ীর বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) ভিপিকেএ’র নির্বাহী পরিচালক হাফিজ আল আসাদ জানান, চঞ্চল কুন্ডু যে কাজ করেন তা সত্যিই প্রশংসনীয়। একারণে তাদের প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তিনি চাইলে তাদের প্রতিষ্ঠানে যুক্ত হয়ে এ ধরনের মানবিক কাজ করতে পারেন।
রাজবাড়ীর সিনিয়র সাংবাদিক লিটন চক্রবর্তী বলেন, চঞ্চল কুন্ডু নিজেই একজন গরীব মানুষ। নিজের সংসার চালাতেই তার নুন আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থা। এরপরও তিনি ভালো কাজ করেন। কিন্তু অর্থনৈতিক সংকটের কারণে তিনি এখন আর এই ভালো কাজটি করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে তার। তাকে সহযোগিতা করা উচিৎ।

সংবাদটি আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন-

মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষের শরীরের ক্ষত সারিয়েই তৃপ্তি তার

প্রকাশের সময় : ০৯:১৬:২৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৮ জুন ২০২৪

সারা শরীর নোংরায় আবৃত। হাতে বা পায়ে ঘা। রাজবাড়ী শহরের রেল স্টেশনসহ বিভিন্ন স্থানে ঘোরা ফেরা করে তারা। কখনও তীব্র যন্ত্রণায় ছটফট করে। মানসিক বিকারগ্রস্ত পরিচয় ও ঠিকানাবিহীন এ ধরনের মানুষ দেখলেই যে কেউ ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেয়। কিন্তু এগিয়ে যান চঞ্চল কুন্ডু(৫৫)। পরম যতেœ সেবা শুশ্রƒষা করেন। যতদিন শারীরিকভাবে সুস্থ করতে না পারেন ততদিন তার চিকিৎসা করেন। গোসল করানো থেকে শুরু করে খাবারও খাওয়ান। গত ১৩ বছর ধরে এভাবে প্রায় দুইশ জন মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষকে সুস্থ করেছেন। চঞ্চল কুন্ডু রাজবাড়ী শহরের রেলস্টেশন সংংলগ্ন রেলকলোনীর বাসিন্দা। একটি ওষুধ কোম্পানীর বিক্রয় কর্মী তিনি।
চঞ্চল কুন্ডু জানান, মানুষ যেমনই হোক সে মানুষ। মানুষের কষ্ট দেখে তিনি ভীষণ কষ্ট পান। আর এজন্যই তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষের সেবা শুশ্রƒষায় এগিয়ে যান। ১৩ বছর আগে তিনি শুরু করেছিলেন এ কাজ। এ পর্যন্ত এ ধরনের দুইশ মানুষকে সেবা করেছেন। যাদের কোন ঠিকানা নেই। তারা তাদের নাম পরিচয়ও বলতে পারেনা। শরীরিকভাবে সুস্থ করতে পারলেও তাদের মানসিকভাবে সুস্থ করার ক্ষমতা তার নেই। মানসিক বিকৃত এইসব মানুষদের শরীরে অনেক বড় বড় ঘা হয়। কারো কারো পোকাও হয়ে যায় ক্ষতস্থানে। এই ক্ষত সারাতে তিন থেকে চার মাস পর্যন্ত লেগে যায়। দামী ওষুধ ও ইনজেকশন দিতে হয়। তিনি নিজে যা আয় করেন তা দিয়ে সংসার চালানোই দায় হয়ে পড়ে। মানুষের কাছে সাহায্য নিয়ে তাদের সেবা করেন। সকাল ও দুপুরে নিজের বাড়ির রান্না করা খাবার খাওয়ান। কখনও কখনও রেস্তোরাঁ থেকে কিনে খাওয়ান। এই মানুষদের সারা শরীরে নোংরা থাকে। কেউ ঠিকমত জামা কাপড় পরতে পারেনা। কেউ মলমূত্র জামা কাপড়েই করে ফেলে। তাদের কাছে কেউ এগিয়ে যেতে চায়না। যাওয়ার কথাও নয়। তিনি মুখে মাস্ক লাগিয়ে তাদের গোসল করান। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা করেন। তার সেবা শুশ্রƒষায় যখন সুস্থ হয় এটাই তার আত্মতৃপ্তি।
চঞ্চল কুন্ডু বলেন, কয়েকদিন আগে ৩০ বছর বয়সী এক যুবককে দেখেন রেল স্টেশনের পশ্চিম দিকে ওভারব্রীজে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। তার সারা শরীরে নোংরা ময়লা। সে যেখানে ছিল সেখান দিয়ে লোকজন যাতায়াত করার সময় মুখে রুমাল চেপে যায়। লক্ষ্য করে দেখেন, তার বাম পায়ের অগ্রভাগে ঘা হয়েছে। তিনি তাকে নিয়ে গোসল করান। ক্ষতস্থানে চিকিৎসা করেন। সপ্তাহে তিন দিন তাকে গোসল করাচ্ছেন। নিয়মিত ঘায়ে পরিচর্যা করেন। তার অবস্থা একটু উন্নতির দিকে। সে তার নাম ঠিকানা কিছুই বলতে পারেন না। শুধু ‘মাদারীপুর’ বাড়ি এটুকু বলতে পারে।
এরও কিছুদিন আগে আরও একজনকে সুস্থ করেছেন। ঠিকানাবিহীন এই লোকটিকে সবাই ‘প্রদীপ পাগল’ বলত। প্রদীপের পায়ে এমন অবস্থা হয়েছিল যে কেউ ওদিকে তাকাতো না। যন্ত্রণায় কাতরাতো। সবাই ধরেই নিয়েছিল সে মারা যাবে। তিনি এগিয়ে যান। দীর্ঘ ছয় মাস তার সেবা শুশ্রƒষা করে তাকে সুস্থ করেছেন। প্রদীপ এখন হেঁটে বেড়ায়।
তিনি বলেন, এই ধরনের রোগীদের দায়িত্ব কেউ নিতে চায়না। হাসপাতালে নিয়ে গেলে বলে, তার দেখাশোনা কে করবে? কতদিন হাসপাতালে থাকতে হবে এর কোনো ঠিক নেই। এজন্য এখন আর হাসপাতালে পাঠানোর কথা ভাবেন না। পুলিশের কাছে গেলে তার পূর্ণ ঠিকানা জোগার করে দিতে বলে।
এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, দীর্ঘদিন ওষুধ কোম্পানীর সাথে যুক্ত থেকেছেন। ক্ষতস্থান সারাতে কী কী প্রয়োজন তা দেখে দেখে শিখেছেন। এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে তিনি চিকিৎসা দেন। অনেকেই তার এই কাজের প্রশংসা করেন। কিন্তু তার সাথে কাজ করার আগ্রহ কেউ দেখায় না। ভিপিকেএ নামের একটি প্রতিষ্ঠান তার এই কাজে সহযোগিতা করবে বলে আশ^াস দিয়েছে।
রাজবাড়ীর বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) ভিপিকেএ’র নির্বাহী পরিচালক হাফিজ আল আসাদ জানান, চঞ্চল কুন্ডু যে কাজ করেন তা সত্যিই প্রশংসনীয়। একারণে তাদের প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তিনি চাইলে তাদের প্রতিষ্ঠানে যুক্ত হয়ে এ ধরনের মানবিক কাজ করতে পারেন।
রাজবাড়ীর সিনিয়র সাংবাদিক লিটন চক্রবর্তী বলেন, চঞ্চল কুন্ডু নিজেই একজন গরীব মানুষ। নিজের সংসার চালাতেই তার নুন আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থা। এরপরও তিনি ভালো কাজ করেন। কিন্তু অর্থনৈতিক সংকটের কারণে তিনি এখন আর এই ভালো কাজটি করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে তার। তাকে সহযোগিতা করা উচিৎ।