এখন সময় কারিগরি শিক্ষার
- প্রকাশের সময় : ০১:৫৫:০৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ৯ নভেম্বর ২০১৯
- / ১৯২০ জন সংবাদটি পড়েছেন
আশিফ মাহমুদ
বেশ কিছুদিন আগে, নিজ অফিসে প্রচন্ড কর্মব্যস্ত ছিলাম। হঠাৎ করে মুঠোফোনের রিংটোনটা বেজে উঠল। ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে আনন্দের বার্তা শোনালো সদ্য ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করা আমারই এক ছাত্র। স্যার, ‘আমার চাকরি হয়েছে’। আমাদের দেশেরই স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান ‘করিম গ্রুপ’ এর কনস্ট্রাকশন সেকশনে। এবং সে আরও জানালো যে, তার প্রথম কর্মস্থল পড়েছে বর্তমানে নির্মাণাধীন পদ্মা সেতুর এপ্রোচ রোডে, মুন্সিগঞ্জের দিকে। ফোনে কথা বলতে বলতে সে অবশ্য বেশ আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়ছিল বারবার। আমিও তার উচ্ছাসে নিজের প্রতি একধরনের গর্ব অনুভব করলাম সে সময়। সাথে সাথে তাকে কনগ্র্যাচুলেশন জানিয়ে উইশ করতেও ভূল করলাম না।
এবার ছাত্রটির প্রসংগে আসা যাক। সে আমার ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং প্রতিষ্ঠান ‘রাজবাড়ী বেসরকারি পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট’ এর ২০১২-১৩ সেশনের সিভিল ডিপার্টমেন্টের ছাত্র ছিল। ২০১২-১৩ সেশনটাই ছিল আমার প্রথম ব্যাচ। ২০১৬ সালের ফাইনাল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বর্তমানে সে ইঞ্জিনিয়র।
আমার প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই ছেলেটাকে প্রায়ই আমি আমার নজরদারির মধ্যে রাখতাম আমার আর সব ছাত্রের মতো। তবে ওর প্রতি নজরদারিটা একটু বেশীই ছিল বলা চলে। আর সেটির কারন ছিল ওর মেধার ক্ষেত্রে দূর্বলতার কারনে। সব সময় সংশয়ে থাকতাম ওকি একজন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়র হতে পারবে? আর ওর ভবিষ্যৎই বা কি হবে? আমার সংশয়ের দোলাচলের কারণে তাকে মাঝে মাঝেই আমার রুমে ডেকে আনতাম। পাশাপাশি তাগিদ দিতাম পড়াশোনায় প্রচুর পরিশ্রম করার জন্য। তখন সে বলতো, স্যার আমার জন্য দোয়া করবেন। আমি বলতাম দোয়া করব ঠিকই, তবে সেটা যেন বিফলে না যায়। তবে চেস্টা এবং পরিশ্রম করতে হবে বেশী করে। পরামর্শ দিতাম প্রচুর পড়াশোনা করার জন্য। ছেলেটা মাথা নিচু করে আমার কথায় সায় দিয়ে একসময় চলে যেত। প্রায়শ:ই তাকে এভাবে আমার পিয়নকে দিয়ে ডেকে পাঠাতাম আমার রুমে আর পড়াশোনার বিষয়টি স্মরন করিয়ে দিতাম। তবে সে কিন্তু আমার মুখ উজ্জ্বল করেছে তার চেষ্টা এবং পরিশ্রম দিয়ে। আর সেই সংগে আমার তার ব্যাপারে যে সংশয়টি ছিল তা ক্ষীণ হয়ে গেছে, এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
আসলে আমি উল্লিখিত ছাত্রের প্রসংগটি কেন আমার লেখায় অবতারণা করছি, তার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হল, বর্তমানে আমাদের দেশের কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থায় কম মেধা সম্পন্ন ছাত্ররাও যে জাতীয় উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখতে পারে বা রাখছে, সে প্রসংগটিকে সামনে রেখে। এবং তার প্রকৃত প্রমাণ হল আমার এই ছাত্রটি। তবে এ ক্ষেত্রে যে বিষয়টি উল্লেখ না করলেই না, সেটি হলো যদি কোন কারনে সে ডিপ্লোমা-ইন- ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সুযোগ না পেত, তাহলে তার ভবিষ্যৎ কোথায় যেত, আমার জানা নেই। কোন অজানা শংকায় তার জীবন অতিবাহিত হোত অনিশ্চয়তার মুখে, সেটিও আমার জানা নেই। তবে ডিপ্লোমা পাশ করার পর সে যে একটা নিশ্চিত জীবন পেয়েছে, সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।
আসলে আমার এই ছাত্রের প্রসংগটি তুলে আনার যৌক্তিক কারন হিসেবে আমি দেখি যে, বর্তমানে আমাদের দেশে অপেক্ষাকৃত কম মেধাসম্পন্ন ছাত্র-ছাত্রীদের অবশ্যই কারিগরি শিক্ষাটা গ্রহণ করা উচিত। এবং তাদের জন্য কারিগরি শিক্ষাটা বাধ্যতামূলক করা এখন সময়ের দাবী। তাদের উচিত উচ্চ শিক্ষার দিকে না তাকিয়ে কারিগরি শিক্ষাটা গ্রহণ করে নিজের উন্নয়ন ঘটানোর পাশাপাশি দেশের উন্নয়নে ব্যাপক ভ’মিকা রাখা। প্রসংগত উল্লেখ্য যে, খোদ আমেরিকাতেও উচ্চতর শিক্ষার প্রবেশাধিকার কেবলমাত্র মেধাবীদের জন্য সীমিত। অন্যরা সার্টিফিকেট পরীক্ষার পর ভোকেশনাল ট্রেনিং নিয়ে কর্মক্ষেত্রে ঢুকে পড়ে। সিংগাপুরেও শতকরা ৭০ ভাগ শিক্ষার্থীকে কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ বাধ্যতামূলক। বাকিরা উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করে। এছাড়াও পৃথিবীর আরও কয়েকটি দেশের কথা উল্লেখযোগ্য। বিষয়টি নিয়ে আমাদের অভিবাবকদের এখন থেকেই ভাবতে হবে এবং অধিকতর সচেতন হতে হবে
তবে সুখের বিষয় যেটি, সেটি আমাদের দেশে বর্তমানে কারিগরি শিক্ষার প্রসারে সরকারি পলিটেকনিকগুলোর পাশাপাশি বেসরকারি পলিটেকনিকগুলোও সমান তালে এগিয়ে চলছে। বে-সরকারি পলিটেকনিকগুলোর অবদানও অনস্বীকার্য। সরকারি পলিটেকনিকগুলোতে মেধাবি ছাত্র-ছাত্রীদের স্থান সংকুলান হলেও বেসরকারি পলিটেকনিকগুলোতে কিন্তু অপেক্ষাকৃত কম মেধাবি সম্পন্ন ছাত্র-ছাত্রীদের ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার যথেষ্ট সুযোগ বর্তমানে রয়েছে। কারিগরি শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের জন্য কারিগরি শিক্ষা বোর্ড দেশব্যাপী অনেকগুলো বেসরকারি পলিটেকনিক এর অনুমোদন দিয়েছে। যা সংখ্যার দিক দিয়ে প্রায় পাঁচশ এর কাছাকাছি।
পৃথিবীর যে সমস্ত দেশ কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্ব এবং প্রাধান্য দিয়েছে তারা আজ উন্নতির সোপানে উঠে গেছে অনেকখানি। উদাহরণস্বরুপ জাপান, জার্মানি, সিংগাপুর, মালয়শিয়ার কথা উঠে আসে। এ সমস্ত দেশে কারিগরি শিক্ষা বাধ্যতামূলক। সুতরাং আমাদেরও এখন ভাবার সময় এসে গেছে যে, আমাদের যদি উন্নতির সোপানে উঠতে হয় তবে অবশ্যই কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্ব এবং প্রাধান্য অবশ্যম্ভাবিভাবে দিতে হবে। আসলে যে বিষয়টি মূলত: প্রণিধাণযোগ্য, সেটি হলো আমাদের দেশের যে জনশক্তি রয়েছে তারা মূলত: আমাদের জন্য বোঝা নয়। উপযুক্ত কারিগরি প্রশিক্ষণ পেলে তাদের মাধ্যমে আমাদের দেশ একটি অপার সম্ভাবনার দেশ হিসেবে পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে। কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত লোকজন প্রকৃতপক্ষে দেশ গড়ার কারিগর। বিশ্বের উন্নত দেশের সংগে প্রতিযোগীতায় নিজেকে দক্ষভাবে গড়ে তুলতে হলে এবং দেশকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশালী করতে হলে কারিগরি শিক্ষার বিকল্প নাই। তাই কারিগরি শিক্ষার মানোন্নয়নে সামগ্রিকভাবেই কাজ করতে হবে।
তবে কারিগরি শিক্ষার প্রসার এর ক্ষেত্রে বর্তমানে কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়ে গেছে, যা নিয়ে এখন সময় এসেছ কাজ করার। বর্তমানে বেসরকারি পলিটেকনিকগুলোতে ভর্তির ক্ষেত্রে ছাত্রÑছাত্রী’র জন্য এক ধরনের অসম প্রতিযোগিতা চলছে। আশানুরুপ এবং কাংখিত ছাত্রÑছাত্রী অনেক বেসরকারি পলিটেকনিকগুলো ঠিকমতো পাচ্ছে না। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহন জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে এ মুহুর্তে। মেডিক্যাল কলেজ সমূহে যেভাবে ছাত্রÑছাত্রী ভর্তি করা হয় সরকারি-বেসরকারি পলিটেকনিকগুলোতে সেই ভর্তি প্রক্রিয়া অনুসরণ করলে অন্তত: পক্ষে বেসরকারি পলিটেকনিকগুলোকে আর ছাত্র সংকটে ভূগতে হবে না। পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষার প্রসারে প্রচার এর জন্য আরও অধিক গুরুত্ব দিতে হবে সকলকে। এত করে কারিগরি শিক্ষার প্রসার দিন দিন আরও বাড়বে।