Dhaka ০৮:৫৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রাজবাড়ীর ৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন পরিত্যক্ত ॥ ব্যাহত পাঠদান

সংবাদদাতা-
  • প্রকাশের সময় : ০৮:১৫:৩২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৯ অক্টোবর ২০১৯
  • / ১৬৩৪ জন সংবাদটি পড়েছেন

জনতার আদালত অনলাইন ॥ ভবন পরিত্যক্ত। কোনোটিতে ঝুঁকি নিয়ে পরিত্যক্ত ভবনে, কোনোটি সাইক্লোন সেন্টারে, কোনোটি তপ্ত গরমে টিনের ঘরে আবার কোনোটিতে গাদাগাদি করে শিক্ষার্থীদের বসিয়ে পাঠদান চলছে। রাজবাড়ী জেলার তিন উপজেলার ছয়টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন পরিত্যক্ত হওয়ায় দীর্ঘদিন ধরে বিরাজ করছে এ দুরাবস্থা। যেকারণে ছয়টি বিদ্যালয়ের দেড় হাজার শিক্ষার্থীর পাঠদান মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। শিক্ষা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, খুব শীগগীরই নতুন ভবন নির্মাণ করা হবে।
রাজবাড়ী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয় সূত্র জানায়, জেলার কালুখালী উপজেলার হরোয়া রূপসা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ঝাউগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বালিয়াকান্দি উপজেলার পদমদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং পাংশা উপজেলায় নিভাগুরুদাস সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া পাংশা উপজেলার জাগিরবাগলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও সুবর্ণকোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন পরিত্যক্ত ঘোষণার জন্য আবেদন করেছে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য গত ২৪/৪/২০১৯ তারিখে সহকারী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আমীরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত একটি চিঠি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব বরাবর প্রেরণ করা হয়েছে।
পদমদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়: বালিয়াকান্দি উপজেলার নিভৃত পল্লীতে কালজয়ী উপন্যাস বিষাদ সিন্ধু রচয়িতা মীর মশাররফ হোসেন স্মৃতি কেন্দ্রের পাশেই অবস্থিত বিদ্যালয়টি স্থাপিত হয়েছে ১৯০০ সালে। ভবন পরিত্যক্ত হওয়ায় চলতি বছরের শুরু থেকে সাইক্লোন সেন্টারে পাঠদান করা হয়। দোতলা বিশিষ্ট সাইক্লোন সেন্টারটির ওপর তলায় রয়েছে দুটি কক্ষ। একটি কক্ষে ক্লাস নেয়া হয়। অন্যটির অর্ধেক অফিস রুম এবং অর্ধেক প্রাক প্রাথমিকের শিশুদের ক্লাস নেয়া হয়। নীচ তলায় বিভাজন করে নেয়া হয় দুটি ক্লাস। তবে পার্শ্ব দেয়াল না থাকায় শিক্ষক শিক্ষার্থী উভয়কেই রোদে পুড়তে হয় আর বৃষ্টিতে ভিজতে হয়। স্যানিটেশন ব্যবস্থাও ভালো নয়।
বিদ্যালয় সূত্র জানায়, বর্তমানে বিদ্যালয়ের ছাত্রÑছাত্রীর সংখ্যা ২৯৬ জন। বিগত কয়েক বছরে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় পাশের হার শতভাগ। ২০১৭ সালে বিদ্যালয় ভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। কিন্তু পাঠদানের জায়গা না থাকায় ঝুঁকি নিয়ে দু বছর ধরে পরিত্যক্ত ভবনেই পাঠদান করা হতো। ভবনটিতে পাঠদান করানো আর সম্ভব না হওয়ায় চলতি বছরের জানুয়ারি মাস থেকে পাশের সাইক্লোন সেন্টারে পাঠদান করা হচ্ছে। তবে যদি কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দেয় তখন দুর্যোগ কবলিত মানুষের জন্য এটি ছেড়ে দিতে হবে।
শিক্ষার্থীরা জানায়, শীতের সময় ঠান্ডা বাতাস চারদিক থেকে ক্লাসরুমে প্রবেশ করে। বজ্রপাত হলে ভয়ে সব কাঁপে। গরমে রোদ্দুর ঢোকে। এভাবেই তারা ক্লাস করে।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইউনুস আলী জানান, নতুন একটি ভবনের জন্য বহু আগেই আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু এখনও সাড়া মেলেনি।
বালিয়াকান্দি উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আশরাফুল ইসলাম জানান, পদমদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ উপজেলার জরাজীর্ণ ভবনগুলোর তালিকা করে গত জুলাই মাসে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। তবে এখনও জবাব আসেনি।
হারোয়া রূপসা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়: কালুখালী উপজেলার রতনদিয়া ইউনিয়নে অবস্থিত বিদ্যালয়টির দুটি ভবনের একটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে ২০১৪ সালে। বর্তমানে অস্থায়ী একটি টিনশেড ঘর নির্মাণ করে চলছে পাঠদান।
বিদ্যালয় সূত্র জানায়, বিদ্যালয়ের মোট ছাত্রÑছাত্রীর সংখ্যা ২৩১ জন। এর মধ্যে প্রাক প্রাথমিককে ৪৭ জন, প্রথম শ্রেণিতে ৪৪ জন, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ৩০ জন, তৃতীয় শ্রেণিতে ৩৯ জন, চতুর্থ শ্রেণিতে ৩৯ জন এবং পঞ্চম শ্রেণিতে ৩২ জন। বিদ্যালয়টিতে সমাপনী পরীক্ষায় পাশের হার শতভাগ। বিদ্যালয়ে শিক্ষক রয়েছেন ছয়জন। ২০১৪ সালে বিদ্যালয়ের একটি ভবন পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। পরিত্যক্ত ভবনটিতে চারটি কক্ষ ছিল। ফলে ওই পরিস্থিতে বারান্দায় অথবা খোলা আকাশের নীচে পাঠ দান করা হতো। ২০১৫Ñ১৬ অর্থ বছরে এক লাখ ৩০ হাজার টাকা বরাদ্দ পাওয়ার পর ছোট একটি টিনশেড ঘর নির্মাণ করা হয়। টিনশেড ঘরটিতে দুই শিফটে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ক্লাস নেয়া হয়। অপর একটি ভবনে দুটি কক্ষ রয়েছে। একটিতে পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস এবং অন্যটি অফিস রুম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। প্রাক প্রাথমিকের শিশুদের অফিস কক্ষে বসিয়ে ক্লাস নেয়া হয়।
বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সীমা পারভীন ও স্বর্ণালী খাতুন জানান, টিনশেড ঘরটিতে ক্লাস নেয়া এক প্রকার দুরূহ। প্রচন্ড গরমে সেখানে দাঁড়ানোই দুষ্কর হয়ে পড়ে। একটি বেঞ্চে দুজনের জায়গায় চারজন গাদাগাদি করে বসে। তাদেরও প্রচন্ড সমস্যা হয়। বৃষ্টি হলে কেঁচো চলে আসে শ্রেণিকক্ষে। এভাবে পাঠদান করা খুবই কঠিন।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুচরিতা সাহা জানান, সকালের শিফটে কোনো মতে ক্লাস নেয়া যায়। দুপুরের শিফটে অসহ্য গরমে বসাই দায়। বিষয়টি তারা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, শিক্ষা কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন বহুবার। তারা এসে বিদ্যালয় পরিদর্শনও করে গেছেন। ইঞ্জিনিয়াররা এসে ছবি তুলে নিয়ে গেছে। কিন্তু কিছুই হয়নি।
ঝাউগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঃ কালুখালী উপজেলার কালিকাপুর ইউনিয়নের এ বিদ্যালয়ে পরিত্যক্ত ভবনেই ঝুঁকি নিয়ে চলছে পাঠদান।
বিদ্যালয় সূত্র জানায়, ১৯৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ের ছাত্রÑছাত্রী প্রায় তিনশ। শিক্ষক রয়েছেন ছয়জন। বিদ্যালয়টিতে রয়েছে দুটি ভবন। যার একটি ২০০৭ সালে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, পরিত্যক্ত ভবনটির তিনটির কক্ষ তালাবদ্ধ। একটি কক্ষে তৃতীয় শ্রেণির পাঠদান করানো হচ্ছে। এ বিদ্যালয়ে আগে প্রায় পাঁচশ ছাত্র ছাত্রী ছিল। যথেষ্ঠ পরিমাণ জায়গা না থাকায় ছাত্রÑছাত্রীর সংখা কমে গেছে।
বিদ্যলয়ের সহকারী শিক্ষক আফরোজা নাহার ও আব্দুল আলিম জানান, ভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষণার পর একটি টিনের ছাপড়া ঘর তোলা হয়েছিল। পরে সেটি ঝড়ে ভেঙে যায়। বাধ্য হয়ে তারা ঝুঁকিপূর্ণ ভবনটিতে পাঠদান করাচ্ছেন। এখানে পাঠদান করানো খুবই সমস্যা। মাঝে মধ্যেই ছাদ থেকে পলেস্তারা খসে পড়ে। এছাড়া তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র ছাত্রীর সংখ্যা ৫৭ জন। সবাইকে বসানো কঠিন হয়ে পড়ে। বিদ্যালয়ের নতুন ভবনের জন্য তারা আবেদন করেছেন। খুব তাড়াতাড়ি ভবন নির্মাণ হবে বলে তারা আশাবাদী।
কালুখালী উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুর রশিদ বলেন, দুটি বিদ্যালয়ের নতুন ভবনের জন্য চাহিদা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে কয়েক মাস আগে। এর মধ্যে ঝাউগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নতুন ভবন পাশ হয়েছে। হারোয়া রূপসা প্রাথমিক বিদ্যালয়টির নতুন ভবন খুব শীগগীরই পাশ হবে বলে আশাবাদী।
নিভাগুরুদাস সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ঃ পাংশা উপজেলায় পাট্টা ইউনিয়ন এলাকায় বিদ্যালয়টির ভবন পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে এক বছর আগে। দীর্ঘ এক বছর ধরে পরিত্যক্ত ভবনেই চলেছে পাঠদান। কয়েকদিন আগে শিক্ষা কর্মকর্তার পরিদর্শনের পর ওই ভবনে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টির ছাত্র ছাত্রীর সংখ্যা ১৮০ জন।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রূপালী বিশ্বাস জানান, ১৯৯৩ সালে বিদ্যালয়ের ভবনটি নির্মাণ করা হয়। দুটি ভবন আছে তাদের বিদ্যালয়ে। পরিত্যক্ত ভবনটিতেই শিক্ষার্থীদের পাঠদান করা হতো। এক বছর আগে প্রকৌশলী পরিদর্শনে এসে ভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করেন। তারপরও জায়গার অভাবে সেখানেই পাঠদান করা হতো। গত ১২ সেপ্টেম্বর তারিখে একজন শিক্ষা কর্মকর্তা পরিদর্শনে এসে ভবনটিতে আর পাঠদান না করার জন্য নির্দেশ দিয়ে যান। তারপর থেকে অন্য ভবনে চলে যান। এই ভবনে তিনটি কক্ষ রয়েছে। একটি কক্ষে অফিস এবং চতুর্থ শ্রেণির পাঠদান করা হয়। অন্য দুটিতে তৃতীয় ও পঞ্চম শ্রেণির পাঠদান চলে। ছোট ছোট কক্ষে ছাত্র ছাত্রীদের বসাতে খুবই সমস্যা হয়। উপায় নেই। গাদাগাদি করে বসিয়ে তাই এভাবেই পাঠদান করাতে হচ্ছে। এক বছর ধরেই তারা ভবনের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছেন। কিন্তু এখনও কোনো সাড়া পাননি।
সুবর্ণকোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ঃ পাংশা উপজেলার কসবামাজাইল ইউনিয়নে বিদ্যালয়টির জারজীর্ণ ভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষণার জন্য আবেদন করা হয়েছে। অনেকটা ঝুঁকি নিয়েই ক্লাস চলছে ভবনটিতে।
বিদ্যালয় সূত্র জানায়, ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টির ছাত্র ছাত্রীর সংখ্যা ২৬৪ জন। ১৯৯৪ সালে ভবনটি নির্মাণ হওয়ার পর কোনো সংষ্কার বা মেরামত করা হয়নি।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আলমগীর হোসেন জানান, ভবনটির বিমে ফাটল ধরেছে। ছাদ থেকে পলেস্তারা খসে পড়ে। ক্লাস চলাকালীন এ ঘটনা ঘটেছে কয়েকবার। এক বছর আগে ভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষণার জন্য উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে আবেদন করেছিলেন। তবে শিক্ষা অফিস থেকে জানানো হয়েছিল, পরিত্যক্ত নয়। মেরামত করলেই চলবে। কিন্তু সে মেরামতও করা হয়নি। এই ভবনটির চারটি কক্ষের একটিতে অফিস কক্ষ, দুটি শ্রেণি কক্ষ এবং একটি স্টোর রুম হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
এ উপজেলার মৌরাট ইউনিয়নের জাগীরবাগলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবনটিও জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। ভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষণার জন্য আবেদন করেছে স্কুল কর্তৃপক্ষ।
পাংশা উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বশির উদ্দিন বলেন, নিভাগুরুদাস সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নতুন ভবন হবে। এ বিষয়ে চিঠি পেয়েছেন। খুব শীগগীরই ভবন তৈরির কাজ শুরু হবে। সুবর্ণকোলা ও জাগীরবাগলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবনের জন্য তালিকা করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। বরাদ্দ পেলে ওই দুটি বিদ্যালয়ের নতুন ভবন তৈরি হবে।
রাজবাড়ী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা হোসনে ইয়াসমীন করিমী বলেন, বিষয়টি সংশ্লিষ্ট উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের দেখতে বলা হয়েছে। ভবন নির্মাণের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছেও চিঠি পাঠানো হয়েছে।

Tag :

সংবাদটি আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন-

রাজবাড়ীর ৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন পরিত্যক্ত ॥ ব্যাহত পাঠদান

প্রকাশের সময় : ০৮:১৫:৩২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৯ অক্টোবর ২০১৯

জনতার আদালত অনলাইন ॥ ভবন পরিত্যক্ত। কোনোটিতে ঝুঁকি নিয়ে পরিত্যক্ত ভবনে, কোনোটি সাইক্লোন সেন্টারে, কোনোটি তপ্ত গরমে টিনের ঘরে আবার কোনোটিতে গাদাগাদি করে শিক্ষার্থীদের বসিয়ে পাঠদান চলছে। রাজবাড়ী জেলার তিন উপজেলার ছয়টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন পরিত্যক্ত হওয়ায় দীর্ঘদিন ধরে বিরাজ করছে এ দুরাবস্থা। যেকারণে ছয়টি বিদ্যালয়ের দেড় হাজার শিক্ষার্থীর পাঠদান মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। শিক্ষা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, খুব শীগগীরই নতুন ভবন নির্মাণ করা হবে।
রাজবাড়ী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয় সূত্র জানায়, জেলার কালুখালী উপজেলার হরোয়া রূপসা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ঝাউগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বালিয়াকান্দি উপজেলার পদমদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং পাংশা উপজেলায় নিভাগুরুদাস সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া পাংশা উপজেলার জাগিরবাগলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও সুবর্ণকোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন পরিত্যক্ত ঘোষণার জন্য আবেদন করেছে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য গত ২৪/৪/২০১৯ তারিখে সহকারী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আমীরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত একটি চিঠি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব বরাবর প্রেরণ করা হয়েছে।
পদমদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়: বালিয়াকান্দি উপজেলার নিভৃত পল্লীতে কালজয়ী উপন্যাস বিষাদ সিন্ধু রচয়িতা মীর মশাররফ হোসেন স্মৃতি কেন্দ্রের পাশেই অবস্থিত বিদ্যালয়টি স্থাপিত হয়েছে ১৯০০ সালে। ভবন পরিত্যক্ত হওয়ায় চলতি বছরের শুরু থেকে সাইক্লোন সেন্টারে পাঠদান করা হয়। দোতলা বিশিষ্ট সাইক্লোন সেন্টারটির ওপর তলায় রয়েছে দুটি কক্ষ। একটি কক্ষে ক্লাস নেয়া হয়। অন্যটির অর্ধেক অফিস রুম এবং অর্ধেক প্রাক প্রাথমিকের শিশুদের ক্লাস নেয়া হয়। নীচ তলায় বিভাজন করে নেয়া হয় দুটি ক্লাস। তবে পার্শ্ব দেয়াল না থাকায় শিক্ষক শিক্ষার্থী উভয়কেই রোদে পুড়তে হয় আর বৃষ্টিতে ভিজতে হয়। স্যানিটেশন ব্যবস্থাও ভালো নয়।
বিদ্যালয় সূত্র জানায়, বর্তমানে বিদ্যালয়ের ছাত্রÑছাত্রীর সংখ্যা ২৯৬ জন। বিগত কয়েক বছরে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় পাশের হার শতভাগ। ২০১৭ সালে বিদ্যালয় ভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। কিন্তু পাঠদানের জায়গা না থাকায় ঝুঁকি নিয়ে দু বছর ধরে পরিত্যক্ত ভবনেই পাঠদান করা হতো। ভবনটিতে পাঠদান করানো আর সম্ভব না হওয়ায় চলতি বছরের জানুয়ারি মাস থেকে পাশের সাইক্লোন সেন্টারে পাঠদান করা হচ্ছে। তবে যদি কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দেয় তখন দুর্যোগ কবলিত মানুষের জন্য এটি ছেড়ে দিতে হবে।
শিক্ষার্থীরা জানায়, শীতের সময় ঠান্ডা বাতাস চারদিক থেকে ক্লাসরুমে প্রবেশ করে। বজ্রপাত হলে ভয়ে সব কাঁপে। গরমে রোদ্দুর ঢোকে। এভাবেই তারা ক্লাস করে।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইউনুস আলী জানান, নতুন একটি ভবনের জন্য বহু আগেই আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু এখনও সাড়া মেলেনি।
বালিয়াকান্দি উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আশরাফুল ইসলাম জানান, পদমদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ উপজেলার জরাজীর্ণ ভবনগুলোর তালিকা করে গত জুলাই মাসে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। তবে এখনও জবাব আসেনি।
হারোয়া রূপসা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়: কালুখালী উপজেলার রতনদিয়া ইউনিয়নে অবস্থিত বিদ্যালয়টির দুটি ভবনের একটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে ২০১৪ সালে। বর্তমানে অস্থায়ী একটি টিনশেড ঘর নির্মাণ করে চলছে পাঠদান।
বিদ্যালয় সূত্র জানায়, বিদ্যালয়ের মোট ছাত্রÑছাত্রীর সংখ্যা ২৩১ জন। এর মধ্যে প্রাক প্রাথমিককে ৪৭ জন, প্রথম শ্রেণিতে ৪৪ জন, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ৩০ জন, তৃতীয় শ্রেণিতে ৩৯ জন, চতুর্থ শ্রেণিতে ৩৯ জন এবং পঞ্চম শ্রেণিতে ৩২ জন। বিদ্যালয়টিতে সমাপনী পরীক্ষায় পাশের হার শতভাগ। বিদ্যালয়ে শিক্ষক রয়েছেন ছয়জন। ২০১৪ সালে বিদ্যালয়ের একটি ভবন পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। পরিত্যক্ত ভবনটিতে চারটি কক্ষ ছিল। ফলে ওই পরিস্থিতে বারান্দায় অথবা খোলা আকাশের নীচে পাঠ দান করা হতো। ২০১৫Ñ১৬ অর্থ বছরে এক লাখ ৩০ হাজার টাকা বরাদ্দ পাওয়ার পর ছোট একটি টিনশেড ঘর নির্মাণ করা হয়। টিনশেড ঘরটিতে দুই শিফটে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ক্লাস নেয়া হয়। অপর একটি ভবনে দুটি কক্ষ রয়েছে। একটিতে পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস এবং অন্যটি অফিস রুম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। প্রাক প্রাথমিকের শিশুদের অফিস কক্ষে বসিয়ে ক্লাস নেয়া হয়।
বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সীমা পারভীন ও স্বর্ণালী খাতুন জানান, টিনশেড ঘরটিতে ক্লাস নেয়া এক প্রকার দুরূহ। প্রচন্ড গরমে সেখানে দাঁড়ানোই দুষ্কর হয়ে পড়ে। একটি বেঞ্চে দুজনের জায়গায় চারজন গাদাগাদি করে বসে। তাদেরও প্রচন্ড সমস্যা হয়। বৃষ্টি হলে কেঁচো চলে আসে শ্রেণিকক্ষে। এভাবে পাঠদান করা খুবই কঠিন।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুচরিতা সাহা জানান, সকালের শিফটে কোনো মতে ক্লাস নেয়া যায়। দুপুরের শিফটে অসহ্য গরমে বসাই দায়। বিষয়টি তারা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, শিক্ষা কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন বহুবার। তারা এসে বিদ্যালয় পরিদর্শনও করে গেছেন। ইঞ্জিনিয়াররা এসে ছবি তুলে নিয়ে গেছে। কিন্তু কিছুই হয়নি।
ঝাউগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঃ কালুখালী উপজেলার কালিকাপুর ইউনিয়নের এ বিদ্যালয়ে পরিত্যক্ত ভবনেই ঝুঁকি নিয়ে চলছে পাঠদান।
বিদ্যালয় সূত্র জানায়, ১৯৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ের ছাত্রÑছাত্রী প্রায় তিনশ। শিক্ষক রয়েছেন ছয়জন। বিদ্যালয়টিতে রয়েছে দুটি ভবন। যার একটি ২০০৭ সালে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, পরিত্যক্ত ভবনটির তিনটির কক্ষ তালাবদ্ধ। একটি কক্ষে তৃতীয় শ্রেণির পাঠদান করানো হচ্ছে। এ বিদ্যালয়ে আগে প্রায় পাঁচশ ছাত্র ছাত্রী ছিল। যথেষ্ঠ পরিমাণ জায়গা না থাকায় ছাত্রÑছাত্রীর সংখা কমে গেছে।
বিদ্যলয়ের সহকারী শিক্ষক আফরোজা নাহার ও আব্দুল আলিম জানান, ভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষণার পর একটি টিনের ছাপড়া ঘর তোলা হয়েছিল। পরে সেটি ঝড়ে ভেঙে যায়। বাধ্য হয়ে তারা ঝুঁকিপূর্ণ ভবনটিতে পাঠদান করাচ্ছেন। এখানে পাঠদান করানো খুবই সমস্যা। মাঝে মধ্যেই ছাদ থেকে পলেস্তারা খসে পড়ে। এছাড়া তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র ছাত্রীর সংখ্যা ৫৭ জন। সবাইকে বসানো কঠিন হয়ে পড়ে। বিদ্যালয়ের নতুন ভবনের জন্য তারা আবেদন করেছেন। খুব তাড়াতাড়ি ভবন নির্মাণ হবে বলে তারা আশাবাদী।
কালুখালী উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুর রশিদ বলেন, দুটি বিদ্যালয়ের নতুন ভবনের জন্য চাহিদা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে কয়েক মাস আগে। এর মধ্যে ঝাউগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নতুন ভবন পাশ হয়েছে। হারোয়া রূপসা প্রাথমিক বিদ্যালয়টির নতুন ভবন খুব শীগগীরই পাশ হবে বলে আশাবাদী।
নিভাগুরুদাস সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ঃ পাংশা উপজেলায় পাট্টা ইউনিয়ন এলাকায় বিদ্যালয়টির ভবন পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে এক বছর আগে। দীর্ঘ এক বছর ধরে পরিত্যক্ত ভবনেই চলেছে পাঠদান। কয়েকদিন আগে শিক্ষা কর্মকর্তার পরিদর্শনের পর ওই ভবনে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টির ছাত্র ছাত্রীর সংখ্যা ১৮০ জন।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রূপালী বিশ্বাস জানান, ১৯৯৩ সালে বিদ্যালয়ের ভবনটি নির্মাণ করা হয়। দুটি ভবন আছে তাদের বিদ্যালয়ে। পরিত্যক্ত ভবনটিতেই শিক্ষার্থীদের পাঠদান করা হতো। এক বছর আগে প্রকৌশলী পরিদর্শনে এসে ভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করেন। তারপরও জায়গার অভাবে সেখানেই পাঠদান করা হতো। গত ১২ সেপ্টেম্বর তারিখে একজন শিক্ষা কর্মকর্তা পরিদর্শনে এসে ভবনটিতে আর পাঠদান না করার জন্য নির্দেশ দিয়ে যান। তারপর থেকে অন্য ভবনে চলে যান। এই ভবনে তিনটি কক্ষ রয়েছে। একটি কক্ষে অফিস এবং চতুর্থ শ্রেণির পাঠদান করা হয়। অন্য দুটিতে তৃতীয় ও পঞ্চম শ্রেণির পাঠদান চলে। ছোট ছোট কক্ষে ছাত্র ছাত্রীদের বসাতে খুবই সমস্যা হয়। উপায় নেই। গাদাগাদি করে বসিয়ে তাই এভাবেই পাঠদান করাতে হচ্ছে। এক বছর ধরেই তারা ভবনের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছেন। কিন্তু এখনও কোনো সাড়া পাননি।
সুবর্ণকোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ঃ পাংশা উপজেলার কসবামাজাইল ইউনিয়নে বিদ্যালয়টির জারজীর্ণ ভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষণার জন্য আবেদন করা হয়েছে। অনেকটা ঝুঁকি নিয়েই ক্লাস চলছে ভবনটিতে।
বিদ্যালয় সূত্র জানায়, ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টির ছাত্র ছাত্রীর সংখ্যা ২৬৪ জন। ১৯৯৪ সালে ভবনটি নির্মাণ হওয়ার পর কোনো সংষ্কার বা মেরামত করা হয়নি।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আলমগীর হোসেন জানান, ভবনটির বিমে ফাটল ধরেছে। ছাদ থেকে পলেস্তারা খসে পড়ে। ক্লাস চলাকালীন এ ঘটনা ঘটেছে কয়েকবার। এক বছর আগে ভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষণার জন্য উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে আবেদন করেছিলেন। তবে শিক্ষা অফিস থেকে জানানো হয়েছিল, পরিত্যক্ত নয়। মেরামত করলেই চলবে। কিন্তু সে মেরামতও করা হয়নি। এই ভবনটির চারটি কক্ষের একটিতে অফিস কক্ষ, দুটি শ্রেণি কক্ষ এবং একটি স্টোর রুম হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
এ উপজেলার মৌরাট ইউনিয়নের জাগীরবাগলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবনটিও জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। ভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষণার জন্য আবেদন করেছে স্কুল কর্তৃপক্ষ।
পাংশা উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বশির উদ্দিন বলেন, নিভাগুরুদাস সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নতুন ভবন হবে। এ বিষয়ে চিঠি পেয়েছেন। খুব শীগগীরই ভবন তৈরির কাজ শুরু হবে। সুবর্ণকোলা ও জাগীরবাগলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবনের জন্য তালিকা করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। বরাদ্দ পেলে ওই দুটি বিদ্যালয়ের নতুন ভবন তৈরি হবে।
রাজবাড়ী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা হোসনে ইয়াসমীন করিমী বলেন, বিষয়টি সংশ্লিষ্ট উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের দেখতে বলা হয়েছে। ভবন নির্মাণের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছেও চিঠি পাঠানো হয়েছে।